সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীরা হঠাৎ করে একটা উলটপালট আলোড়নের মধ্যে পড়ে গেছে। তারা বরাবরই নানামুখী চাপেই থাকে। সেই প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি নারীকে দমন, পেষণের মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে কিন্তু এই একবিংশ শতকে এসে, সভ্যতার চরম বিকাশকালে ক্ষুদ্র ঘটনাকে উপলক্ষ করে নারীকে অন্তরীণ করার প্রয়াস ভীষণ বেমানান। মাঝে মাঝে ভুলেই যাই কোন সময়ে আমাদের বাস, আমরা প্রাক-ইতিহাসের কোন সময়ে আছি!
গহীনতম অরণ্য থেকে ভয়ংকরতম পর্বতমালা, উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু, সু-গভীর সমুদ্রতল থেকে মহাকাশের অতলান্তে নারীর যখন অবাধ বিচরণ তখন নারীকে শক্তিহীন করার প্রয়াস চিন্তার স্রোতকে উলটপালট করে দেয় বটে। নারী শক্তিকে উন্মোচন করার প্রয়াস উত্তরোত্তর বৃদ্ধির পথ রোধ করে তাদের উল্টো পথে গৃহে অন্তরীণ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা কেমন বোধহীন করে তোলে।
হঠাৎ কী এমন হলো ইসলামিক ইরানে যে নারীরা ক্ষোভে, দ্রোহে ফেটে পড়লো! মৃত্যুকে পরোয়া না করে রাস্তায় নেমে এলো হাজার হাজার নারী এবং সাথে পুরুষ। কঠোর আইনের তোয়াক্কা না করে কেনো পোড়াতে থাকে এতদিনের নৈতিক এবং ধর্মীয় আচারের আবশ্যিক অনুষঙ্গ ‘হিজাব’, খুলে ফেলে তাদের আব্রু! কীসের আগুন, কীসের দ্রোহ! এই নারীরাই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, মাথায় তুলে নিয়েছিল ‘হিজাব’। শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদকে রুখে দিতে যে নারীরা ইসলামিক বিপ্লবের সাথে যোগ দিয়েছিল সেই বিপ্লব তাদের যোগ্য প্রতিদান দেয়নি। বিপ্লবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জয় হলেও নারীদের জীবনের মুক্তি আসেনি। কঠোর নিয়মের, আইনের দড়িতে বেঁধে তাদের জীবনকে করা হয়েছিল সীমাবদ্ধ। তাই নৈতিক পুলিশের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে মাশা আমিনীর মৃত্যুতে ফুঁসে উঠেছে সমগ্র ইরান প্রজাতন্ত্র। শুধু তাই না এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে সিরিয়া, তুরস্ক এবং ইরাকে। কুর্দি নারীরা ‘জিন, জিয়ান, আজাদী’ শব্দে আলোড়িত করে আকাশ-বাতাস। অনেকদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ লাভার মতো উদগীরণ ঘটে।
২২ বছর বয়সী মাশা আমিনী সঠিক নিয়মে হিজাব না পরার কারণে ম্যোরাল পুলিশের হাতে নির্যাতিত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। একটা রিপাবলিক রাষ্ট্র কাঠামোতে ম্যোরাল পুলিশের মতো ধারণা থাকতে পারেইবা কীভাবে! নৈতিকতা গড়ে উঠে সামাজিক ব্যবস্থায়। যে সমাজের যেমন সামাজিক ব্যবস্থা তার নীতি এবং নৈতিকতা সেভাবেই তৈরি হয় বরং আইন প্রয়োগ করে যেটা হয় ‘বজ্র আঁটুনি, ফোস্কা গেরো’। কঠোর নিয়মের অন্তরালে তৈরি হয় নিয়ম ভাঙার প্রচেষ্টা। কঠোর নৈতিক শাসন ব্যবস্থায় ভেতরে ভেতরে তৈরি হয় বিদ্রোহের আগুন আর অপেক্ষা করে স্ফুলিঙ্গের। মাশা আমিনীর ঘটনা একটা স্ফুলিঙ্গ মাত্র। এই দ্রোহ তৈরি হয়ে-ই ছিল। বহু প্রাণ গেছে হয়তো আরো যাবে। হাজার মানুষ কারাবন্দী এবং সরকারের কঠোর শাস্তির ঘোষণা তথাপি বিক্ষোভ চলছে। বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে শুধু পর্যবেক্ষণ-ই করে যাচ্ছে কারণ নারীদের এমন ফুঁসে উঠতে খুব একটা বেশি দেখা যায় না। পর্দার আড়ালে রাখা এই নারীদের বিক্ষুব্ধ চেহারায় একটা ভয়ংকর কাঠিন্য। কী থেকে তৈরি হয়েছে এই রুঢ়তা এটা এক স্বাভাবিক প্রশ্ন। এই প্রতিবাদ এক বার্তা দিয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়। শাসকেরা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবে নারীর অফুরান শক্তি নিয়ে আর পোশাকের মত অহেতুক বিষয়ে নারীকে সীমাবদ্ধ না করে নারী শক্তিকে কাজে লাগালে পরোক্ষে রাষ্ট্রের-ই মঙ্গল।