মার্চ মানেই উত্তাল ও বিক্ষুব্ধ এক সময়। প্রতিবাদ–প্রতিরোধ, সাহস ও আত্মত্যাগের গৌরবগাথা কোনো কোনো কাল কখনও কখনও নিয়ে আসে যুগান্তরের সম্ভাবনা। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে মার্চ মাস তেমনই এক মহাকাল যা সংগ্রামের জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় উজ্জ্বল এবং রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। এ মাস ইতিহাসের কেবল একটি বিবর্ণ মাস নয়, জাতির ইতিহাসের ধারায় নিরন্তর গতিময়, প্রাণবন্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ। একে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে জাতিসত্তায় এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামী চেতনার জন্ম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আকাঙ্ক্ষা এই দেশের মানুষের বুকে জাগিয়েছিলেন। আর তা অর্জনের লক্ষ্যে ঘাত–প্রতিঘাত, বাধা–বিপত্তি, রাজনৈতিক কুচাল, শোষণ–নিপীড়ন সবকিছু পরাভূত করে অসম্ভব ধৈর্য ও সুকৌশলে সুদীর্ঘকাল ধরে তিনি জাতিকে সংগ্রামের যে কণ্ঠকিত পথে এগিয়ে নিয়েছেন, মার্চ মাসে জাতির অগ্নিঝরা মহাজাগরণে তার পরিপূর্ণতার বিজয়ঘণ্টা বেজে উঠেছিল।
১৯৪০ সালে ‘লাহোর প্রস্তাব’–এ ঠিক করা হয়েছিল ভারতবর্ষের যে অঞ্চলগুলোতে মুসলমান বেশি, সেরকম দুটি অঞ্চলকে নিয়ে দুটি দেশ এবং বাকি অঞ্চলটিকে নিয়ে আর একটি দেশ তৈরি করা হবে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা দুটি নিয়ে দুটি ভিন্ন দেশ না হয়ে ‘পাকিস্তান’ নামে একটি দেশ এবং ১৫ আগস্ট বাকি অঞ্চলকে ‘ভারত’ নামে অন্য একটি দেশে ভাগ করে দেয়া হলো। পাকিস্তান নামে এমন বিচিত্র একটি দেশের জন্ম হলো, যে দেশের দুটি অংশ দুই জায়গায়। বর্তমান ‘পাকিস্তান’ এর নাম ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ এবং বর্তমান ‘বাংলাদেশ’ এর নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’। দু’অঞ্চলের মধ্যে যেমন প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্ব, তেমনি মানুষগুলোর ভেতরের দূরত্বও ছিল বিশাল। চেহারা, ভাষা, খাবার, পোশাক, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছু ছিল ভিন্ন। শুধু একটি বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষগুলোর মাঝে মিল ছিল–সেটি হচ্ছে ধর্ম। দেশভাগের সময় পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে দুই কোটি ও চার কোটি। কাজেই সকল সরকারি অফিসে দু’অঞ্চলের লোকসংখ্যার অনুপাতে অবস্থান থাকার কথা, কিন্ত বাস্তবতা ঠিক তার উল্টা। সবক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের লোকের অবস্থান সর্বাধিক ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব আয় বেশি সত্ত্বেও বাজেটের ৭৫% ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। ভয়ংকরভাবে লক্ষ্যণীয় ছিল সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যের সংখ্যা ছিল ২৫ গুণ বেশি। বাঙালি মুসলমানদেরকেও পাকিরা আপন করে নিতে পারল না। এভাবে বাঙালিদের সাথে ক্রমে বেড়ে উঠা বিভেদ, বৈষম্য, শোষণ আর ষড়যন্ত্রের বন্ধুর পথে রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় পূর্ববাংলার সমগ্র বাঙালির বিশ্বাস–ভালোবাসা সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ৭১ এর মার্চে উপনীত হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ আসনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ১৬০টি (৩১৩টি আসনের মাঝে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি) আসন পেয়েছে। নির্বাচনের এ ফলাফল দেখে ইয়াহিয়া খানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার ঘোষণা দিলেন, ‘তিনি ছয় দফার কথা বলে জনগণের ভোট পেয়েছেন এবং তিনি শাসনতন্ত্র রচনা করবেন ছয় দফার ভিত্তিতে, দেশ শাসিত হবে ছয় দফার ভিত্তিতে’। আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছিল তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য, কিন্তু ছয় দফা বাস্তবায়ন হবেই, এটা বুঝতে পেরে তারা আতঙ্কিত হয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। গণতন্ত্র নয়, স্বেচ্ছাচারিতাই ছিল পাকিদের শক্তি। তারা যুক্তির ভাষা বোঝে না, তারা জোরের ভাষায় অভ্যস্ত। শেখ মুজিবকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়ে পাকিস্তান শাসন করবে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃদ–এ তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। পাক নেতৃবৃন্দ নির্বাচনের ফল বানচাল করার জোরালো চেষ্টা করছে। তারা জানুয়ারির শেষ দিকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার কথা বললে তারা আরও আলোচনার কথা বলে কালক্ষেপণের কৌশল নেন। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হলো কিন্তু ৬ দফার ইস্যুতে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর আসল মতলব বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝলেন।
পাক নকশা অনুযায়ী ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলেন ইয়াহিয়া। এ ঘোষণা রেডিওতে প্রচার হবার সাথে সাথে বাংলাদেশের ছাত্র–জনতা তীব্র বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে পড়ে। স্কুল–কলেজ, অফিস–আদালত, দোকান–পাট সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। পুরো ঢাকা শহর দেখতে দেখতে মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়ে যায়। মুখে মুখে স্বাধীনতার শ্লোগান: ‘জয় বাংলা’ ,‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজে ব্যস্ত থাকা বঙ্গবন্ধু বিক্ষোভ মিছিলে জনতার সামনে উপস্থিত হয়ে আন্দোলন জোরদার করার পরামর্শ দেন এবং ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা বাংলায় দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতালের ডাক দেন। সংগ্রামী ছাত্র সমাজের উদ্যোগে ২ মার্চ বিক্ষোভ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে বটতলায়। ঐ সভামঞ্চে প্রথম বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হলো। সেদিন দুপুরে ও রাতে যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ঢাকা এবং সারাদেশে ৫ দিনের হরতাল ও অনিদিষ্টকালের জন্যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সেই অসহযোগ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারকে কোনোভাবে সাহায্য না করার ঘোষণা দেন, সাথে সাথে সারা পূর্ব পাকিস্তান বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে গেল। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে রাতে পাকিস্তান রেডিওতে ঢাকায় কারফিউ জারির ঘোষণা এসেছিল। কারফিউ ভেঙে জনতা দলে দলে পথে নেমে বিক্ষোভের ঝড় তুলল। চারিদিকে মিছিল আর শ্লোগান। সেনাবাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছে তবুও কেউ থামল না। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয় এবং জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি নির্বাচন করা হলো।
৭ মার্চ আমাদের গৌরবের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দানে) ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এ ভাষণ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে যার যা আছে তা–ই নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ্’। এটা ছিল এক আত্মপ্রত্যয়ী নেতার দৃঢ় অঙ্গীকার। ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি’ বলে বঙ্গবন্ধু আসলে অনেক কিছুই বলেছিলেন ৭ মার্চ। এ ভাষণ সেদিন দেশের সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশকে স্বাধীন করার শক্তি জুগিয়েছিল। ২৫ মার্চ ইতিহাসের বিভীষিকাপূর্ণ কাল রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’– নীলনকশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরানো ঢাকার হিন্দু প্রধান এলাকা, বিভিন্ন মন্দিরসহ ঢাকা শহরে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। অপারেশন সার্চলাইটের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করা। কমান্ডো বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাবার আগে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন মধ্যরাত পার হয়ে ২৬ মার্চ হয়ে গেছে, তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের পক্ষে আবার স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করা হয়। পরবর্তী দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাস; স্বাধীন বাংলার স্বপ্নে বিভোর মুক্তিপাগল বাঙালি জনতার সাহসী আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয়ের ইতিহাস। সবুজ বাংলার বুকে লাল রক্ত খচিত স্বাধীন পতাকার ইতিহাস।
লেখক: প্রাবন্ধিক; উপমহাব্যবস্থাপক, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড