১৯৫৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত এদেশে সর্বজনস্বীকৃত যত নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে প্রত্যেকটির পেছনে ছিল তীব্র গণ–আন্দোলনের চাপ। আজ সরকার যেমন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ক্ষমতার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে তেমনি বিরোধী দল চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে গণ আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করে নিতে। এ প্রেক্ষিতে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা ও আভ্যন্তরীণ রাজনীতি তথা নির্বাচন নিয়ে একটি বৃহৎ শক্তির এই নগ্ন হস্তক্ষেপ ক্ষমতা প্রত্যাশী বিএনপিকে খুশি করেছে নিঃসন্দেহে এবং সরকার বিরোধী আন্দোলনে এ পর্যন্ত গণমানুষকে সম্পৃক্ত করতে না পেরে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের একটি নিষেধাজ্ঞা চাইছিল যাতে দলকে চাঙ্গা ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলা যায়। কিন্তু সবচেয়ে কৌতুহলের বিষয় হল শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া। তারা দেশের সার্বভৌমত্ব, আত্মমর্যাদা সর্বোপরি কুটনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত এবং কার্যতঃ তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত এ পদক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান না করে উল্টো বিএনপি’র মত স্বাগত জানিয়ে একে বিএনপি বিরোধী ব্যবস্থা বলে অভিহিত করছে বিশেষ করে জনাব ওবায়দুল কাদেরের অপ্রয়োজনীয় অতিকথা মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের প্রকৃত অনুসারীদের নিয়ত বিরক্ত ও উত্যক্ত করছে। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্টেট ডিপার্টমেন্টের ঘোষিত ভিসা নীতি নিয়ে এখনো প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে কোন মন্তব্য প্রকাশ্যে করেননি বরং কিছুদিন আগে নাম উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির সাহসী সমালোচনা করেছেন। ইতোপূর্বে ২০১৪ সালে এরশাদকে নির্বাচনে নিয়ে আসার জন্য ভারতের অপতৎপরতা ও হস্তক্ষেপ দেশে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নজিরবিহীনভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের উল্লেখ করে বলেছেন ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ছিল এবং সেদিনের দন্ডপ্রাপ্ত একজন খুনিকে এখনো যুক্তরাষ্ট্র নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের সর্বশেষ ঘোষিত ভিসা নীতি সম্পর্কে আগাম তথ্য পেয়েই সম্ভবত সরকার প্রধান এ বক্তব্য রেখেছেন বলে ধরে নেয়া যায়। তিনি যথার্থভাবেই প্রশ্ন তুলে বলেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাইডেনকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসাবে যেখানে এখনো মেনে নেননি সেখানে বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিষয়ে কথা বলার অধিকার কি তাদের আছে? সে দেশের শাসক গোষ্ঠী স্রেফ অর্থ ও শক্তির জোরে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে জড়িয়ে বিগত প্রায় ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সারা দুনিয়ায় পুলিশী ভূমিকা ও দস্যুবৃত্তি করে যাচ্ছে। আর্থ–সামাজিক দিক থেকে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অতি উন্নত হয়েও বিশ্বব্যাপী সমাজ প্রগতিকে ঠেকানোর জন্য সব চেয়ে পশ্চাদপদ ধর্মান্ধ ভাবাদর্শকে অনুন্নত, অশিক্ষিত, জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পাকিস্তান ও আফগাস্তিনের মত দেশগুলোতে একটা সামাজিক রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। গুজরাটে গণহত্যার জন্য দায়ী যে মোদিকে এক সময় মার্কিন ভিসা দেয়া হয়নি মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতায় এখনো বিশ্বাসী সেই ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী মোদি এখন জো বাইডেনের সবচেয়ে প্রশংসিত রাষ্ট্রনায়ক। নির্বাচিত বলে নয় বস্তুত ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদ ও লুটেরা পুঁজির প্রতিনিধি হিসেবে তিনি মার্কিন প্রশংসায় আপ্লুত হচ্ছেন, নয়তো আলেন্দে, বঙ্গবন্ধু, সুকর্ন কি অনির্বাচিত ছিলেন যাঁদের মার্কিন মদদে হত্যা করা হলো? ১৯৭০ সালে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে এ দেশে চাপিয়ে দেয়া গণহত্যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক তো ছিল সরাসরি তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সন। আমেরিকা এ পর্যন্ত এ ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি যেমন করেনি পাকিস্তান। গণতন্ত্রের নামে গাদ্দাফী ও সাদ্দামকে হত্যা করে লিবিয়া ও ইরাককে মিথ্যা অজুহাতে ধ্বংস করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধুসহ দেশে দেশে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়কদের হত্যাকারী আমেরিকা এখন এদেশে গণতন্ত্রের স্বঘোষিত ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ।
একটি দেশের নির্বাচন অবাধ হয়েছে কিনা তা বিচারের ভার প্রথমত সে দেশের জনগণ, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বিরোধীদল, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল সর্বোপরি আইন ও আদালতের বিষয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ত্রুটি দুর্বলতা, পক্ষপাতিত্ব, অসচ্ছ্বতা, নিস্ক্রিয়তা থাকতেই পারে। কিন্তু শেষ বিচারে পরিস্থিতি পরিবর্তনের ভার সংশ্লিষ্ট দেশ ও জনগণের উপর বর্তায়। অতীতে আমাদের দেশের জনগণ বার বার সে ভূমিকা পালন করেছে। অন্য কোন দেশ ও সরকারের বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের উপর তা নির্ভর করে না। গণতন্ত্র চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়– যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে ও আফগানিস্তানে “গণতন্ত্র” চাপিয়ে দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশ দুটোকে ধর্মান্ধ অগণতান্ত্রিক শক্তির কাছে ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি চীনে এক দলীয় শাসনের অধীনে বলতে গেলে কোন নির্বাচনী ব্যবস্থাই নেই। যুক্তরাষ্ট্র কি চীনের শাসকগোষ্ঠীকে ভিসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা রাখে? নির্বাচনবিহীন সৌদি রাজতন্ত্রকে আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন করে চলেছে তেল সম্পদের কারণে। চিলিতে পিনোচেটের মত খুনিকে খোলাখুলি সমর্থন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ’৭৫ পরবর্তী দুই জেনারেলের দীর্ঘ সামরিক শাসন তাদের কাছে বৈধতা পেয়েছে যে সামরিক শাসনের লিগেসী থেকেই আজ এদেশের রাজনীতিতে হ্যাঁ/না গণভোট, ভোটারবিহীন নির্বাচন, জবরদস্তি, ধর্মান্ধতা, অর্থনীতিতে লুটের ধনিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব। ১৯৮৮ তে এরশাদের নির্বাচন, ১৯৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন বলতে গেলে একই সূত্রে গাঁথা। ভিন্ন ভিন্ন দল হলেও সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর সাম্প্রদায়িক লুটেরা সংস্কৃতির ধারক তথা যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব ব্যাংকের সুপারিশে সৃষ্ট রাজনৈতিক অর্থনীতির উপজাত গণবিরোধী আমলাতন্ত্র ও লুটেরা পুঁজি নির্ভর শাসক গোষ্ঠীই এসব নির্বাচনের হোতা। এরাই গণতন্ত্র ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ কায়েমের লক্ষ্যাভিসারী মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আজ গণতন্ত্র হীনতার, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বিভেদের অন্ধকার পথে নিয়ে গেছে। এই দীর্ঘ অপশাসনের মূল সহযোগী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ হঠাৎ প্রকাশ্যে গণতন্ত্রের সবক দিচ্ছে এমন একটি দেশকে যে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধী ছিল সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার হাতে এদেশের ৩০ লক্ষ শহীদ, বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার রক্তের প্রচ্ছন্ন দাগ রয়েছে। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসকদের সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বব্যাংক চাপিয়ে দেয়া লুটেরা আর্থিক নীতি কৌশল দেশের অর্থনীতিকে, রপ্তানি বাজারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উপর নির্ভরশীল করে রেখেছে। এদের সুপারিশে তুলে দেয়া হয়েছে রেশনিং ব্যবস্থা, অচল করে দেয়া হয়েছে টিসিবিকে। ফুলে ফেঁপে উঠেছে কিছু অতি ধনিক গোষ্ঠী। সামরিক, বেসামরিক আমলা ও এসব ধনিক গোষ্ঠীর মিলিত দল নিরপেক্ষ এক ভয়ংকর সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে এ দেশের শাসন ব্যবস্থা আর এদের প্রকৃত ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর যেখানে রয়েছে তাদের পাচার করা অঢেল সম্পদ ও স্বজন। এরা শাসক দলের নেপথ্যের চালিকাশক্তি। আর নূতন এই মার্কিন ভিসা নীতি এদের জন্যই আঘাত। এদেশের ৯৮ ভাগ মানুষের তো আমেরিকা যাবার সামর্থ্যই নেই। এদের দীর্ঘ অপশাসনের ফলে আজ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে আর দুই বৃহৎ দল, প্রিন্টমিডিয়া, এ হস্তক্ষেপকে অন্যায় মনে করছেন না বরং দেশে “গণতন্ত্র কায়েমের” অন্যতম এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসাবে দেখছেন। বস্তুত বাংলাদেশের জন্য ঘোষিত মার্কিন ভিসা নীতি হল যুক্তরাস্ট্রের রাজনৈতিক, সামরিক, বৈশ্বিক বিশেষ করে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক অপকৌশলের অনুগত অংশীদার হওয়ার চাপ দেয়ার অংশ মাত্র কোন অবস্থাতেই গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য নয়। যে দেশের ছাত্র সমাজ একদিন ভিয়েতনামে মার্কিন গণহত্যার বিরোধিতায় “ডাউন উইথ ইস্পিরিয়ালিজম” বলে ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত দিয়েছে সে ছাত্র সমাজ আজ অপরাজনীতি আর ধর্মান্ধতায় বুঁদ হয়ে বসে আছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী বাম প্রগতিশীল শক্তি আজ এতই কমজোরি হয়ে পড়েছে যে, আজকের মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অবাধ নির্বাচনের দাবীতে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলে মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারছেনা। ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলো তো আমেরিকারই বিশ্বস্ত গোপন বন্ধু সেই ’৭১ সাল থেকে। এদের “অনুভূতির” নামে অব্যাহত ধর্মান্ধ সহিংসতা আমেরিকার চোখে পড়ে না। ক্ষমতাসীন দল ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্য সব দল সংগঠন ও ব্যক্তির নেতৃত্বে আজ যদি হাজার হাজার মানুষ মার্কিন হুমকির বিরুদ্ধে, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও সিন্ডিকেটবাজির বিরুদ্ধে, মানুষের ভোটাধিকার এই তিনটি জরুরী ও পরস্পর সম্পর্কিত দাবীতে মাঠে নামত তাহলে রাষ্ট্র বিরোধী দেশী বিদেশী সব চক্রান্ত ভেসে যেত। জনগণকে ডাক দেয়ার বিকল্প শক্তি ও নেতৃত্বের অভাবের কারণেই ৫০ বছর ধরে দেশ শাসনকারী মূল দুটি দল রাজপথ দখল করে রয়েছে ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাবার জন্য। কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতা হল ক্ষমতার সমীকরণে আওয়ামী লীগ যতই পেছনের দিকে হাঁটুক, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শকে বর্জন করুক, একথা তাদের মনে রাখা উচিত ভাবাদর্শগত কারণে জামাত–বিএনপি হল এদেশের রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পছন্দের শক্তি, আওয়ামী লীগ নয়। কেননা ’৭১ এর পাকিস্তানের পরাজয় ছিল নিক্সন–কিসিঞ্জার তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়। আমরা ভুলে গেলেও আমেরিকা সে আঘাত কখনো ভুলেনি। অথচ ’৭১ এর গণতন্ত্র হত্যাকারী আজ আমাদের গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা। আমরা কোন্ ভাঙনের পথে চলেছি জানি না। লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।