মান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের ‘মান’ নিয়ে প্রশ্ন

জনবলসহ নানা সংকটে বিএসটিআই চট্টগ্রাম

জাহেদুল কবির | শনিবার , ২০ মে, ২০২৩ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীকে বলা হলেও এখানে স্থাপিত মান নিয়ন্ত্রণে দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউটের (বিএসটিআই) নেই কোনো পূর্ণাঙ্গ রাসায়নিক পরীক্ষাগার। এছাড়া জনবল সংকটের কারণে প্রায় কাজে দীর্ঘসূত্রতার জেরে প্রতিষ্ঠানটির ‘মান’ নিয়ে সাধারণের মনে প্রশ্ন উঠেছে। বর্তমানে বিএসটিআই চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে চট্টগ্রাম নগরী ও উপজেলা ছাড়াও রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম তদারকি করা হয়। অথচ এই জেলায় মান নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মোট চাহিদার অর্ধেক জনবলও নেই। ফলে বিএসটিআইয়ের কাজ চলছে কার্যত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি নীতিতে তালিকাভুক্ত ৭৯টি পণ্য বন্দর থেকে খালাসে বিএসটিআই থেকে আমদানিকারকদের সনদ নিতে হয়। বিএসটিআইয়ের ল্যাবে উন্নত যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ঢাকার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে চট্টগ্রাম বিএসটিআইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ‘মান’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে ঢাকায় পণ্যের নমুনা পাঠানো থেকে শুরু করে রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত অতিরিক্ত এক সপ্তাহ সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। তাই ব্যবসায়ীরা আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ছেন বলে জানা গেছে।

বিএসটিআই চট্টগ্রাম কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিএসটিআইয়ের মূল তদারকির কাজ চারটি বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এরমধ্যে রয়েছে টেস্টিং কেমিক্যাল, টেস্টিং ফিজিক্যাল, মেট্রোলজি ও সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম)। বিএসটিআই দেশে উৎপাদিত শিল্পপণ্য, বৈদ্যুতিক ও প্রকৌশল পণ্য, খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যসহ মোট ২৩৯টি পণ্য নজরদারি করে। এসব পণ্যের মধ্যে চট্টগ্রামে ল্যাবে রাসায়নিক পরীক্ষা সম্পন্ন করা যাচ্ছে ৯৫টি পণ্যের। এছাড়া ফিজিক্যাল পরীক্ষা সম্পন্ন করা যাচ্ছে ২২টি পণ্যের। তবে পানি, গুঁড়ো দুধের মেলামিন, ফায়ার এক্সটিংগুইসারের মান, ত্বকের বিভিন্ন প্রসাধনী, ইলেকট্রিক মিটারের মান, লেখা এবং ছাপাখানার কাগজ পরীক্ষা এবং শিশু খাদ্যের পরীক্ষাও ঢাকার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে বর্তমানে নির্মাণ সামগ্রী টাইলস, সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেল, কলম, সস, জুস, টুথপেস্ট, শ্যাম্পু, পেনসিল এবং চকলেট জাতীয় পণ্যের পরীক্ষা চট্টগ্রাম ল্যাবে সম্পন্ন হচ্ছে।

টেস্টিং কেমিক্যাল বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, পরীক্ষাগারের যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে অধিকাংশ পরীক্ষা চট্টগ্রামে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই এখানে যেসব পরীক্ষা করা যায় না সেইসব আমরা ঢাকায় পাঠিয়ে দিই। তবে চট্টগ্রামে এসব পরীক্ষা করা সম্ভব হলে আমদানিকারকদের এক সপ্তাহ সময় বেঁচে যেতো। একই অবস্থা বিরাজ করছে বিভিন্ন পণ্যের ফিজিক্যাল টেস্টের ক্ষেত্রেও।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জনবল সংকটের কারণে মাঠ পর্যায়ে বিএসটিআইয়ের মনিটরিং জোরদার করাও সম্ভব হচ্ছে না। বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) বিভাগে একজন উপপরিচালক, তিনজন সহকারী পরিচালক ও ৮ জন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা দিয়ে পুরো চট্টগ্রাম বিভাগে কাজ চালাতে হচ্ছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে মেট্রোলজিতে বিভাগে। সেখানে একজন উপপরিচালক, দুইজন সহকারী পরিচালক এবং ৩জন পরিদর্শক দিয়েই মূলত কাজ চালাতে হচ্ছে। অপরদিকে টেস্টিং ফিজিক্যালে একজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালক এবং সিনিয়র পরীক্ষক রয়েছে। একজন উপপরিচালক ও দুইজন সহকারী পরিচালক দিয়েই চলছে এই বিভাগ। এছাড়া টেস্টিং কেমিক্যাল বিভাগে পরীক্ষক আছেন মাত্র ৫ জন। উপপরিচালক ১ জন ও ২ জন সহকারী পরিচালকের এবং ২ জন জন পরীক্ষক রয়েছে।

এদিকে অভিযোগ রয়েছে, অনেক প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের নাকের ডগায় বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন লোগো ব্যবহার করে খাদ্য পণ্য বাজারজাত করছে। এসব ক্ষেত্রে আবার ওইসব পণ্যের মোড়কে উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ থাকে না। মূলত বিএসটিআইয়ের দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী লাভবান হচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব পণ্যের ভোক্তারা। এছাড়া ওজন স্কেলে (বাটখারা) বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সেটি মানছে না। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, যে সকল প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে, সেগুলোর তালিকা ধরে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে না। বিএসটিআই আইন২০০৩ (সংশোধনী)-এর ৮ ধারা অনুযায়ী, অনুমোদন ছাড়া বিএসটিআইর লোগো ব্যবহার করা আইনত দণ্ডনীয়। শাস্তি হিসেবে ৭ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, দুই বছরের জেল অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

বিএসটিআই চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিচালক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম বলেন, বিএসটিআইয়ের বর্তমানে কাজের পরিধি বেড়েছে। তবে এটি ঠিক আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। এরচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভবনের সমস্যা। গত ২০১৫ সালে বিএসটিআইয়ের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে ১০তলা ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সেই ভবন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে ঝামেলার কারণে কাজ আটকে যায়। তবে বর্তমানে নতুন ঠিকাদার দিয়ে কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। এই ভবনে অত্যাধুনিক ল্যাব করারও কথা রয়েছে। বর্তমানে ল্যাবের জায়গা ছোট হওয়ায় আমরা অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে পারছি না। ভবন নির্মাণ শেষ হলে কাজের গতিও বৃদ্ধি পাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধঅভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো বিদেশি শক্তির নাক গলানোর সুযোগ নেই