এক গাঁয়ের দুই বন্ধু ঠিক করেন তীর্থে যাবেন। তাঁদের একজন অবস্থাপন্ন কৃষক, অন্যজন সামান্য মৌ-চাষী। দুজনের মাঝে মৌ-চাষীরই আগ্রহ বেশী তীর্থে যাবার। বেলাতো কম হলনা। কাজকে ছুটি দিয়ে পুণ্য সঞ্চয়ে এখনই বেরিেেয় না পড়লে সময় আর নাও হতে পারে। কিন্তু অন্য বন্ধুটির কাজই শেষ হয় না। ঘরটাকে আরও শক্তপোক্ত করে বাঁধা দরকার, এরই মাঝে এসে পড়ে নাতির বিয়ে। ছেলের ওপর আস্থা রাখতে পারে না বুড়ো বাপ। ‘আমাদের ছাড়াও তো ওদের বাঁচতে হবে, বন্ধু। তোমার ছেলেকে শিখতে দেওয়া দরকার’- দরিদ্র বন্ধুটি তাড়া দেয় ধনবান বন্ধুকে। কিন্তু তার সব কাজ নিজ হাতে করা চাই, ফলাফল নিজের চোখে দেখা চাই। সব কাজ গুছিয়ে আনতে আনতে মনে পড়ে যায়- হাতখালি, আরও কিছু যোগাড়যন্ত্র করার জন্য সময় চাই। অথচ কপর্দকশুন্য মৌ-চাষীর এত ভাবনা নেই। খুব দ্রুত পরিবারের সবাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে, কয়েকটা মৌচাক প্রতিবেশীর কাছে বিক্রি করে দিয়ে তীর্থে যাবার জন্য তৈরি সে। বিত্তবান বন্ধু কমদামে মৌচাক বেচে দিয়ে ন্যায্যমূল্য পাবে না বলে আশংকা ব্যক্ত করলেও আর্থিক লাভ-লোকসান নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয় মৌ-চাষী- “আফসোস? না ভাই না। আমি কখনও কোনকিছুর জন্য আফসোস করিনে। হ্যাঁ, একমাত্র আমার পাপের জন্য ছাড়া। আত্মার চেয়ে মূল্যবান তো আর কিছুই নেই”- মৌ-চাষীর সোজাসাপ্টা জবাব। অবশেষে দুই বৃদ্ধ প্রাচীন জেরুজালেমের পুণ্যস্থান দর্শনে গ্রামের বাইরে পা বাড়ায়।
লিয়েফ তলস্তোয়ের ‘দুই বুড়ো’ গল্পের দুই বন্ধু ইলিসা ও এফিম পরিবার এবং গ্রামের সকলের শুভকামনা নিয়ে, বেশ কিছুদিনের খাবার, শীতের পোশাক আর যে-যার সাধ্যমত টাকাকড়ি নিয়ে পথে নামে। এ-পথ ফুরোবার নয়। টানা পাঁচসপ্তাহ হেঁটে-হেঁটে খাবার ফুরিয়ে যায়। শীতের মোজা শতচ্ছিন্ন। চলতি পথে এক শহরে যাত্রাবিরতি দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আবার হাঁটতে শুরু করে তারা। মৌ-চাষী নির্ভার মনে খোদার নাম জপে গেলেও বিত্তবান বন্ধুটি বাড়ির কথা, ছেলের কথা, ফসলের কথা মাথা থেকে তাড়াতে পারে না। এরই মাঝে গরম শুরু হয়ে যায়। মৌ-চাষীটির খুব পিপাসা পায় । বিত্তবান বন্ধুটি তখনও তৃষ্ণার্ত নয়। তাই তাকে এগিয়ে যেতে বলে পাশের গ্রামের এক বাড়িতে পানি খেতে যায় মৌ-চাষী।
অজন্মা, দুর্ভিক্ষ, ঋণ, মড়ক আর রোগ-শোকের পাঁকে পড়ে মরোমরো অবস্থা পথের ধারের কুটিরের বাসিন্দাদের। ছেলে-বুড়ো কারোরই নড়ার শক্তি নেই। কে পানি দেবে মৌ-চাষীকে? ঘরে পানি থাকলে তো! তৎক্ষণাৎ ওদের সেবায় নিয়োজিত হয়ে পড়ে মৌ-চাষী। নিজের ঝোলা থেকে রুটি বের করে দেয়, কুয়ো থেকে পানি বয়ে নিয়ে আসে, বাজারে গিয়ে সবজী মাখন লবণ বার্লি কিনে এনে নিজ হাতে রেঁধে খাওয়ায়। অনেকদিন পর ভরপেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে এ-ঘরের মানুষগুলো। মৌ-চাষী তবু ছেড়ে যায় না ওদের। পরদিন ভোর হতে না হতেই লেগে পড়ে কাজে। ওদের জন্য খাবার তৈরি, পোশাক কেনা, পরের দিনগুলো কিভাবে যাবে তার একটা বন্দোবস্ত করা- কাজের শেষ নেই তার। ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে বাড়ির মানুষগুলো। ওদের ঋণ পরিশোধ করে, পরিবারের কর্মক্ষমদের কাজের ব্যবস্থা করে, ও-বাড়ি ছাড়তে-ছাড়তে তার এক দুই তিন করে অনেক দিন পেরিয়ে যায়। হাড্ডিচর্মসার মানুষগুলোকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে একদিন বিদায় নেয় মানুষটা। গ্রামের বাইরে গিয়ে ঝোলা খুলে দেখে সম্বল যা আছে তা দিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে জেরুজালেম পৌঁছানো যাবে না। অতএব ফিরতি পথে বাড়ির পথ ধরে মৌ-চাষী। তার একটুও মন খারাপ লাগেনি। কোন ক্লান্তিও বোধ করেনি। পয়সা খরচ করে এতদূর গিয়ে তীর্থস্থান না দেখে ফিরে আসাতে গাঁয়ের কেউ কেউ কিঞ্চিৎ তিরস্কার করলেও মৌ-চাষী তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। বাড়ি ফিরেই নতুন উদ্যোমে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজে।
ওদিকে অবস্থাপন্ন কৃষকটি বন্ধুর পথ চেয়ে চেয়ে অনেকদুর চলে যায়। ওদেসায় পৌঁছে তিন দিন অপেক্ষার পর শত শত তীর্থযাত্রীর সঙ্গে জাহাজে চড়ে বসে আর ভিড়ের মাঝে এদিক ওদিক বন্ধুকে খুঁজে। আয়া সোফিয়া, স্মার্না, আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর পার হয়ে জাফকায় নোঙর করে জাহাজ। এরপরও পঞ্চাশ মাইলের মতো হাঁটা পথ। দিন তিনেক হাঁটার পর অবশেষে জেরুজালেমে পৌঁছায় তীর্থযাত্রীর দল। সকলের সঙ্গে নিয়ম মেনে প্রার্থনায় সামিল হয় ‘এফিম’ নামের বিত্তবান কৃষকটি। কিন্তু এক সহযাত্রীর টাকা হারানোর কথা শোনার পর থেকে একদিকে তাকে নিয়ে অবিশ্বাস, আর অন্যদিকে নিজের টাকার থলের নিরাপত্তা নিয়ে অস্থির হয়ে পড়ে এফিম। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দেয়। খ্রিষ্টের সমাধির কাছে গিয়েও এই দুর্ভাবনা ঝেড়ে ফেলতে পারে না মন থেকে। তীর্থযাত্রার শেষ আচার পালনের সময় পুণ্য সমাধিসৌধের ওপর জ্বলতে থাকা প্রদীপের নিচেই যেন বন্ধু ইলিসা’কে দেখতে পায় এফিম। এ-ই দেখা দেয়, এ-ই আবার মিলিয়ে যায়। এ-কী করে সম্ভব! সকল আচার-অনুষ্ঠান পালন শেষে আরও দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করে, নিজের শেষযাত্রায় পরিধান করবে বলে পবিত্র পোশাকও কিনে নেয়। জর্ডানের পুণ্যসলিল সংগ্রহ করে নিজের জন্য আর বন্ধু ইলিসা’র জন্যও। তারপর বাড়ির পথ ধরে।
পথিমধ্যে সেই গ্রাম পাড়ি দেওয়ার সময় ইলিসা’র সহযোগিতায় নতুন জীবন ফিরে পাওয়া পরিবারটির সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় এফিমের কোন কিছু বুঝতে বাকী থাকে না- ‘ তাহলে এইভাবে সে সবার আগে পুণ্যতীর্থে গিয়েছে! আমার পরিশ্রম সার্থক হবে কিনা জানি নে, কিন্তু তারটা ভগবান গ্রহণ করেছেন’। বাড়ি ফিরে এসে মন ভেঙে যায় এফিমের। বখে যাওয়া ছেলে সব ছারখার করে দিয়েছে। অপরদিকে ইলিসা’র চোখেমুখে খেলা করছে স্বর্গের দ্যুতি। এফিমের বোধোদয় হয় এই প্রথম- ঈশ্বরকে পেতে হলে সবার আগে মানুষকে ভালবাসতে হবে, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। তলস্তোয় নিজেও বিশ্বাস করতেন- বিশ্বাসে মিলায় বস্তু (ড়হষু ভধরঃয পধহ মরাব ঃৎঁঃয); কলা, বিজ্ঞান, দর্শনের ভারী-ভারী বাণী নয়, কেবলমাত্র প্রশ্নাতীত বিশ্বাসই জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে সহায়ক হতে পারে।
বিশ্ব সাহিত্যের সর্বকালের সেরাদের একজন লিয়েফ তলস্তোয় (১৮২৮-১৯১০) ‘দুই বুড়ো’ নামের গল্পটি রচনা করেছিলেন ১৮৮৫ সালে। এতকাল পরে এসে গল্পটিকে এতটুকু পুরনো মনে হয় কী? হেঁটে হেঁটে মাইলের পর মাইল পাড়ি দেওয়ার কথা না থাকলে হয়তো বোঝাই যেতনা এফিম ও ইলিসার গল্পটি দেড়শ বছর আগের ঘটনা। দেড়শ বছর পর আজকের আধুনিক মানুষরাও তো তীর্থে যায়। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্মাবলম্বীরাই যায়। হেঁটে-হেঁটে নয়, উড়ে-উড়ে যায়। বছর ঘুরতে হয়না; সব মিলিয়ে এক, বড়জোর দেড় মাসের মধ্যে সব কার্জ সমাধা হয়ে যায়। অধিক বিত্তবান হলে চাইলে সপ্তাহান্তেও বাড়ি ফিরে আসতে পারি। মহাসমারোহে জগতকে জানিয়ে যাত্রা করি আমরা। বেশ একটা পুণ্য অর্জিত হয়েছে, এমন ভাব নিয়ে ফিরেও আসি, নামের আগে বিশেষ পদবী জুড়ে দেই। দরিদ্র মৌ-চাষী ইলিসা’র মতো আমাদের আত্মা আদৌ কী পৌঁছে পবিত্রভূমিতে? আর অবিশ্বাস ও সহিংসতার থাবা বিস্তার করে থাকা সমাজ ও পৃথিবী জুড়ে মানুষকে ভালোবেসে খোদাকে পাওয়ার চেষ্টাইবা আমরা কতটুকু করি? তলস্তোয়ের ‘দুই বুড়ো’ আজও আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, রাশি রাশি বাড়ি-গাড়ি, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা-কড়ি, সোনা-দানা, হীরে-জহরত, মুক্তো-মাণিক্য পারে কেবল সুখ শান্তি কেড়ে নিতে, দিতে নয়। আল্লাহ, খোদা, ঈশ্বর, ভগবান, গড যে নামেই ডাকিনা কেন, কেবল মানুষকে ভালবাসলেই তাঁকে পাওয়া যায়, আর মিলে যায় স্বর্গেও সিঁড়ি।