পাঁচ দশকের সংগীত জীবনের দর্শক-ম্রোতাদের ভালোবাসাকেই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখছেন সংগীত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন; তিনি বলছেন, তার জীবনের কোনো অপ্রাপ্তি নেই। গতকাল শনিবার ৬৭ বছরে পা দিলেন এ শিল্পী; জন্মদিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি। খবর বিডিনিউজের।
পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে দশ হাজারেও বেশি গান কণ্ঠে তুলেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। গীতিকার নয়ীম গহরের লেখা ও সুরকার আজাদ রহমানের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া দেশাত্মবোধক গান ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ একাত্তরের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। নজরুল ইসলাম বাবুর কথায় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে সাবিনার কণ্ঠে অমর হয়েছে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’; হাসান মতিউর রহমানের কথা ও মলয় কুমার গাঙ্গুলীর সুরে তার কণ্ঠে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’র মতো গান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গানের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়ে সব ম্রেণির শ্রোতাদের মাঝে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন; বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসাকেই জীবনের বড় প্রাপ্তি বলে মনে করছেন তিনি। গতকাল বিকালে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘ভালোবাসাই আসল কথা। মানুষের ভালোবাসা, দোয়া, শ্রদ্ধা সবকিছু পেয়েছি। আমার জীবনে অপ্রাপ্তি বলে কিছু নেই। আমি অনেক কিছু পেয়েছি জীবনে। এর জন্য আমি খুব খুশি। সবাই আমাকে এত ভালোবাসেন, সবার প্রতি আমি ভীষণভাবে ঋণী।’
করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে ঘরোয়া আয়োজনেই মেয়ে ফাইরুজ ইয়াসমিন ও কয়েকজন বন্ধুদের সঙ্গে বিশেষ দিনটি কাটিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘জন্মদিন ভালো লাগে। ছোটবেলায় মনে হত কবে বড় হব, কবে স্কুলে যাব, শাড়ি পরব। আর এখন মনে হয় যে বয়স একটু কমলে আরো ভালো হত!’
সাবিনা ইয়াসমিনের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর; ঢাকায়। তার পৈতৃক নিবাস সাতক্ষীরায়। বাবার চাকরি সূত্রে নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহীসহ বেশ কয়েকটি শহরে তার শৈশব কেটেছে। সংস্কৃতিমনা পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। এ শিল্পীর বাবা লুতফর রহমান ও মা মৌলুদা খাতুন গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাঁচ বোনের মধ্যে চারজন গান করেন; তারা হলেন ফরিদা ইয়াসমিন, ফওজিয়া খান, নীলুফার ইয়াসমিন এবং সাবিনা ইয়াসমিন।
কয়েক বছর আগে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘ছোট থেকেই গান গাইছি। বাড়িতে একটা সংগীতের পরিবেশ দেখেছি। মা গান গাইছেন, বাবাও খুব ভালো গাইতেন। বোনেরা তো গাইছেন। আম্মার গানের গলা অসম্ভব সুন্দর ছিলো এবং তিনি গাইতেনও খুব সুন্দর। এতো সুন্দর হারমোনিয়াম বাজাতেন, আমি অবাক হয়ে দেখতাম এবং শুনতাম। আমার বড় বোন ফরিদা ইয়াসমীন, ফৌজিয়া খান উচ্চাঙ্গ শিখতেন ওস্তাদ দুর্গাপ্রসাদ রায়ের কাছে। আমরা তখন বাবার চাকরীর সুবাদে নারায়ণগঞ্জ থাকতাম। আমি আর নীলুফার মাঝেমাঝে বসতাম তাদের পাশে। দেখতাম কী শিখছেন।’
তার শিল্পী হয়ে উঠার পেছনে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি জানিয়ে এ শিল্পী বলেন, ‘গানের ব্যাপারটা আমার ভেতরে ছিলই। আমার মা ও নানা একসঙ্গে গান শিখতেন মুর্শিদাবাদে, ওস্তাদ কাদের বঙের কাছে। তিনি সে সময়ের নামকরা একজন সংগীতজ্ঞ ও ওস্তাদ ছিলেন। পরে অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সংসারে ঢুকে গান-বাজনা কিছুই হলো না আম্মার। আমার মায়ের মনে জিদ ছিল এজন্য, আমাদের অর্থাৎ তার সন্তানদের গান শেখানোর বিষয়ে। আরেকটা ব্যাপার, আম্মা পড়াশোনাতেও অসম্ভব ভালো ছিলেন, সেটাও চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। এজন্য আমাদের এ দুটি দিকেই সমান মনোযোগী করতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি।’
মাত্র সাত বছর বয়সে প্রথমবার স্টেজে গান করেছেন সাবিনা; ১৯৬২ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ সিনেমাতে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম গান করেন তিনি। ১৯৬৭ সালে প্রথম প্লেব্যাক করেন আমজাদ হোসেন ও নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত ‘আগুন নিয়ে খেলা’ সিনেমায়। এরপর আর ডি বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সত্য সাহা, সুবল দাস, আলম খান, বাপ্পি লাহিড়ী, আলী হোসেন, খন্দকার নুরুল আলম, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো সুরকারদের সুরে অসংখ্য চলচ্চিত্রের গান কণ্ঠে তুলেছেন তিনি। সহশিল্পী হিসেবে কুমার শানু, আশা ভোঁসলে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীকে পেয়েছেন তিনি।
শিক্ষাজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। সংগীতে অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে একুশে পদক, ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার ও ১৪ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন।