মানুষের জীবনে মূল্যবোধ ও কীর্তি

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | রবিবার , ২৬ জুন, ২০২২ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

মানবিক আচরণ সমৃদ্ধ করার সুষ্ঠু নীতি ও মানদণ্ডই হচ্ছে মূল্যবোধ। এ মূল্যবোধ শব্দটা মানুষকে সমাজ জীবনে মর্যাদাবান হতে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করে থাকে। যে চিন্তা চেতনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানুষের মানবিক আচরণ, ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত করে তাই মানবিক মূল্যবোধ। অবক্ষয় ও অস্থিতিশীলতা প্রায়শই মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির পথে শত বাধা হয়ে বিরাজ করে। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে সমাজে নিষ্ঠুর অমানবিক কাজগুলো ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।

ফলশ্রুতিতে সমাজ ও জাতিকে এক মহাসংকটাপন্ন পরিস্থিতি পাড়ি দিতে হচ্ছে। অপরপক্ষে মানুষের জীবনে যদি নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত থাকে তাহলে মানুষের জীবন হবে সহজ, সরল, সুন্দর ও আলোকিত। আর আলোকিত সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষ অনেক অনেক কাজ করে থাকে, নিজের প্রয়োজনে, সমাজের এবং দেশের প্রয়োজনে -এমনকি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বৈশ্বিক প্রয়োজনেও। বহু জনের হিতের জন্য, মংগলে জন্য, কল্যাণের জন্য কাজ করতে হলে স্বার্থপরতা বিসর্জন দিয়ে মানুষকে ত্যাগের মন্ত্রে উদ্দীপিত হয়ে স্বচ্ছ মন মানসিকতা ও উদারতা নিয়ে অপরের কল্যাণে এগিয়ে যেতে হবে। আর এজন্য মানুষের মাঝে সৌজন্যবোধ, মনুষ্যত্ব বোধ ও বিবেক বোধের খুবই প্রয়োজন। এসব মানবিক গুণাবলীর অভাবেই মানুষ স্বার্থপর হয়ে উঠে এবং অন্যের প্রতি অমানবিক আচরণ করে থাকে। মূল্যবোধ সৃষ্টির পথে এটি একটি বড় অন্তরায় সরূপ। আর এ কারণেই ভালো কিছু, মহৎ কিছু করার উদ্যোগ নেওয়ার পরও আমাদের মধ্যে পিছু হটার প্রবণতাটা থেকে যায়। কাজেই কীর্তিময় কিছু করার লক্ষ্যে আমাদেরকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার আলোকে এগিয়ে যেতে হবে এবং তার পরই আমরা সফলতার মুখ দেখতে পাব। কবির কণ্ঠে বলতে হয়- ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’।

কাজেই অন্যের মংগলের কথা ভাবলে আমাদেরকে অবশ্যই নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যেতে হবে। আনুষ্ঠানিকতার উপর গুরুত্ব না দিয়ে ত্যাগ ও সেবার আদর্শকে সমুন্নত রেখে বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করে যেতে হবে। অহংবোধ মানুষের চরিত্রকে বিকলাঙ্গ ও কলুষিত করে দেয়। কাজের পরিপূর্ণতায় সন্তুষ্টি নিহিত। কাজেই সন্তুষ্টি খুঁজে পেতে হলে অহংবোধ সর্বোতভাবেই পরিত্যাজ্য। নিজের আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে যে কোনো সৎ ও মহৎকর্ম সম্পাদনে মানুষকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নিজেকে সবসময়ই বড় এবং অপরিহার্য ভাবা মোটেই সমীচীন নয়। ‘আপনাকে বড় বলে বড় সে নয় লোকে যারে বড় বলে বড় সে হয়’। শাস্ত্রবচন সম এ মহান উপদেশ মাথায় নিয়ে মানুষকে পরের কল্যাণে, সমাজের কল্যাণে ও দেশের কল্যাণে যথার্থভাবে নিয়োজিত থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তির আদর্শের ব্যর্থ অনুকরণ করতে গিয়ে আমরা গর্ব অনুভব করি। ত্যাগ নয় ভোগের মোহে আচ্ছন্ন থেকে অনেকে সম্মান ও কীর্তি প্রতিষ্ঠার দুরূহ চেষ্টা চালিয়ে যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, ‘বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তি বিহ্‌বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য’। বাগাড়ম্বরে পারদর্শী বিধায় অনেকে অসাধুতার আশ্রয় নিয়েও শত চেষ্টার মধ্য দিয়ে আরাধ্য কাজ সম্পন্ন করতে পারে না কিংবা ঈপ্সিত কাজ সম্পন্ন করার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারে না। ন্যায় -নীতি, সাধুতার উপর মনে প্রাণে বিশ্বাস স্থাপন করে লোভ, দ্বেষ, মোহকে বিসর্জন দিয়ে মহৎ কাজ সম্পাদনের লক্ষ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিবেদিত থাকতে হবে নতুবা কবিগুরুর মুখনিঃসৃত বাণী আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরো বেশি ভাবিয়ে তুলবে।

‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করিনা, আমরা আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না,যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না’। আবার আমাদের সমাজে অনেককে দেখা যায় আত্মপ্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা নিজেকে বড় বলে প্রচার করে এবং নিজের কর্মকীর্তি নিজেই প্রচার করতে অভ্যস্ত। আপনার কাজ আপনি করে যান নীরবে নিবৃত্তে। সাফল্য, সুনাম, যশ, খ্যাতি অমূল্য ভূষণ হয়ে আপনার চারিত্রিক মাধুর্যকে স্বমহিমায় ফুটিয়ে তুলবে। আত্মতুষ্টি থাকা ভালো, তবে আত্মপ্রশংসা এক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। আপনার মহৎ কাজের স্বীকৃতি প্রশংসার বাণী নিয়ে আপনার মাথায় মুকুট হয়ে শোভা বর্ধন করবে।

তাই কীর্তি অর্জনের লক্ষ্যে মানুষকে ভবিষ্যতের স্বপ্নপূরণে ধীর পদে এগিয়ে যেতে হবে। কবিগুরু তাই বলেছিলেন : ‘হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে কাজ করে যাও গোপনে গোপনে মুখর দিনের চপলতা মাঝে স্থির হয়ে তুমি রও’। কাজেই জীবনকে পরিচ্ছন্ন ও অনিন্দ্য সুন্দর মহিমায় বিকশিত করতে অতীতের প্রভাব অনস্বীকার্য। কারণ অতীতের উপর ভিত্তি করে বর্তমান সুপ্রতিষ্ঠিত এবং আজকের বর্তমানই হবে অনাগত ভবিষ্যতের ভিত। বর্তমান অতীতের কথা বলছে, ভবিষ্যৎ আজকের বর্তমানের কথা বলবে, এমনি করে সুদূর ভবিষ্যৎ যুগ পরম্পরায় অনাগত ভবিষ্যতের কথা বলে যাবে। এক কথায় গৌরবময় অতীত জন্ম দেয় সুখী সমৃদ্ধ বর্তমান ও ভবিষ্যতের। অতীতে যারা গৌরবদীপ্ত কাজের মাধ্যমে কীর্তি, যশ ও সুনাম অর্জন করেছেন, বর্তমান প্রজন্ম অকৃপণ ও উদার মানসিকতায় তাদেও সঠিক মূল্যায়ন করে যাচ্ছে, তাদের স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে। কবিগুরুর কথায় আবার আসি-

‘এ কথা জানিতে তুমি ভারত ঈশ্বর শা-জাহান কাল স্রোতে ভেসে যাবে জীবন যৌবন ধনমান’। কবির অন্তরের অনুভূতিও যেন চিরন্তন বাণী কারণ আমাদের জীবন যৌবন ধনমান সবই কাল স্রোতে ভেসে যাবে, তবে সম্রাটের অন্তর বেদনার বহিঃপ্রকাশ হয়ে একমাত্র টিকে থাকবে -‘এক বিন্দু নয়নের জল/ কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল/এ তাজমহল ’। কাজেই বর্তমানকে কীর্তিময়, গৌরব দীপ্ত ও সৃজনশীল প্রতিভায় আলোকোজ্জ্বল করে তুলতে পারলে অতীত এসে বর্তমানের কাছে তার কীর্তিগাথা তুলে ধরবে। মৃত্যুর মাঝ দিয়ে সে কীর্তিকে বারবার পশ্চাতে ফেলে গেলেও কীর্তিমানদের গৌরবময় কীর্তিই অমর অক্ষয় হয়ে ভবিষ্যতকে সমুজ্জল করবে, ঋদ্ধ করবে। তাইতো কবি বলেছেন – ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ/ তাই তব জীবনের রথ / পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার / বারম্বার’।

গৌরবময় সোনালী অতীত জাতিকে এক নব চেতনায় উজ্জীবিত করে। জাতীয় দুর্যোগে জাতি যখন দিকভ্রান্ত থাকে তখন অতীতের কৃষ্টি, সংস্কৃতি আমাদের প্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করে। আবহমান বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতিই আমাদের প্রেরণার উৎস। মহান মুক্তিযুদ্ধে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদৃঢ় নেতৃত্ব বাঙালিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যুগিয়েছিল। যশ, খ্যাতি, প্রশংসার দাবি করে জাতির পিতা বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করেননি, তাঁর অমর কীর্তিই তাঁকে যশ, খ্যাতি, প্রশংসা ও সম্মানের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। বাঙালির ভাগ্যাকাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন। ‘যতদিন রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার / শেখ মুজিবুর রহমান ’।
কাজেই কীর্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সৎকর্ম, দৃঢ় সংকল্প ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজস্ব মেধা-মননশীলতা নিয়ে আত্মনিবেদিত থাকতে হবে। কিন্তু ইদানীং কীর্তিমানদের কীর্তি পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে যথার্থভাবে মূল্যায়িত হয় না মিথ্যা মোহে আচ্ছন্ন অশিক্ষিত, অজ্ঞানী, তথাকথিত শিক্ষিত জ্ঞানপাপী কিছু ব্যক্তিদের কারণে।

ইসলাম ধর্ম মতে যে শিক্ষা আত্মপরিচয় দান করে, মানুষকে সৎ ও সুনাগরিক হিসাবে গঠন করে এবং পরোপকারী, কল্যাণ কামী ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুরাগী হতে সাহায্য করে সে শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। আর এ শিক্ষা মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে, অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচিত করে, দূরদর্শিতা সৃষ্টি করে। বৌদ্ধ মংগল সূত্রে বর্ণিত আছে গৌরবনীয় ব্যক্তির গৌরব করা উচিৎ, উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকা এবং উপকারীর উপকার স্বীকার করা উত্তম মংগল। চাণক্য পণ্ডিতের মতে একটি বৃক্ষে লাগা আগুনের দ্বারা যেমন সম্পূর্ণ বন ধ্বংস হতে পারে তেমনি একজন কুপুত্রের দ্বারা সম্পূর্ণ পরিবার ধ্বংস হতে পারে। চাণক্য পণ্ডিতের নীতি কথায় আরও বর্ণিত আছে, দুর্জন বিদ্বান হলেও যেকোনো মূল্যে তাকে এড়িয়ে চলা উচিৎ। তাঁর মতে, ব্রাহ্মণ ভোজনের দ্বারা তুষ্ট হয়, ময়ূর মেঘ গর্জনে আনন্দ নৃত্য করে, সজ্জন ব্যক্তি পরের সুখে সুখী হয়। কিন্তু দুষ্ট বা অসৎব্যক্তি পরের দুঃখে ও বিপদে আনন্দ লাভ করে।

তিনি আরও বলেছেন, বিদ্যা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে কোনো তুলনা চলে না। রাজা শুধু তাঁর নিজ দেশে সম্মানিত হন কিন্তু বিদ্বান ব্যক্তি সর্বত্র সম্মানিত হন। প্রবাদ আছে, অল্প বিদ্যা ভয়ংকর। প্রচলিত এ-ই প্রবাদটি অনেকের কাছে বোধগম্য নয় তাদের অজ্ঞানতা প্রসূত সীমিত জ্ঞানের কারণে। তাদের কূপমণ্ডুকতা, অর্থবিত্তের অহমিকার কারণে সমাজ রাষ্ট্রে বিদ্বান ও মহৎ তথা কৃতী ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। পরোপকারী মনোবৃত্তি, সৌজন্যবোধ, মূল্যবোধ সৃষ্টির মানসিকতা নিয়ে সমাজ, রাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত সকল মহলের ব্যক্তিবর্গ সচেতন হলে সমাজে গুণী ব্যক্তি, আলোকিত সন্তান এবং কীর্তিমান ব্যক্তিরা আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে সর্বকালে, সর্বযুগে কীর্তি, যশ, সুনাম ও সম্মান নিয়ে চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন। আর তখনই আমরা সগর্বে বলতে পারবো ‘কীর্তি যস্য স জীবতি’।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধরাজস্থলীতে দুই পক্ষের গোলাগুলি, নিহত ১