মানুষের অধিকার, গণসচেতনতা এবং …

মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান | রবিবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২১ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

কথায় আছে – হাতি তার নিজের শরীর দেখে না। বিরাট আকারের এই হাতি তার কানের জন্য শরীর দেখতে পায় না। শরীরটা স্বচক্ষে দেখার পর হয়তো তার মনে অহংকার জাগত। আর এই অহংকারের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে সে জনপদের ক্ষতি করত অনেক বেশী। আজকাল কিন্তু ইচ্ছা করলেই হাতি তার শরীর দেখতে পারে। অর্থাৎ তার মালিক বা মাহুত যদি ইচ্ছা করে- তাহলে হাতিটির একটি ছবি নিয়ে তার সামনে ধরতে পারে। কিন্তু কাজটা ঠিক হবে না। বিজ্ঞানের ‘আবিষ্কার’ কল্যাণের জন্যই ব্যবহৃত হওয়া দরকার। যে কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অনেক সুফল থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু বা সামান্য পরিমাণ কুফল থাকতে পারে। বিবেচনশীল মানুষের উচিত সেই কুফল থেকে নিজেকে বাঁচানো এবং অপরকেও। তাই, যদি মনে করা হয় যে, হাতি নিজের শরীর দর্শনের পর অহংকারবোধে অত্যাচারী হওয়ার আশংকা আছে, তাহলে আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে, সে যেন তার ছবিটা দেখতে না পায়। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের অপকারিতা সম্পর্কে আমাদের আরও অনেক ক্ষেত্রে সজাগ থাকার বিষয় আছে।
আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে পানির অভাবে মানুষসহ প্রাণিকূল ও পথঘাট খাঁখাঁ করে। আর বর্ষায় পানি নিষ্কাশনের অব্যবস্থার দরুণ বন্যা হয়। বড় শহরগুলোর অবস্থা এসময় খুব করুণ আকার ধারণ করে। জনগণের দুর্ভোগ কোন কোন সময় খুবই চরম রূপ নেয়। তারই একটা চিত্র ২২.০৬.২০০৩ তারিখে একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়। চিত্রটি ছিল একজন মহিলার। তিনি সকালবেলা হাঁটু পানিতে হেঁটে তাঁর কাজে যাচ্ছিলেন। রাস্তার এক গর্তে বা ম্যনহোলে পড়ে তার পুরো শরীরটাই সিক্ত হয়ে গিয়েছে। ঠিক ঐ সময় ফটোগ্রাফার তাঁর দায়িত্ব পালন করলেন। অর্থাৎ ফটো তুলে নিলেন। ঐ অবস্থাতেও মহিলাটির মাথায় কাপড় ছিল এবং সারা শরীরেই ভেজা কাপড় জড়ানো। ছবিটা নিয়ে ফটোগ্রাফার বন্যার দ্বারা পথচারীদের অসুবিধার কথা খুব ভালভাবেই পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছেন।
তবে ছবিটা দেখে আমার মনুষ্যহৃদয় আহত হয়েছে। এ অবস্থায় মহিলাটির ফটো উঠানো কি উচিত হয়েছে? একেতো বন্যার মার, তার উপর ফটোগ্রাফের এই অশোভন আক্রমণ যে কোন ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলাকে মানসিকভাবে ক্ষুব্ধ করার কথা। এ যেন সংকটে পড়া অবস্থায় অসহায়ত্বের সুযোগ গ্রহণ। ছবিটা দেখে আধুনিক অশ্লীল ছবির একটি দৃশ্যের মত মনে হল। ফটোগ্রাফারের পক্ষে অনেকে অনেক যুক্তি দিতে পারেন। কিন্তু বিপর্যস্ত অবস্থায় ফটোগ্রাফারের যুক্তি খণ্ডানোর মত মানসিক স্থিরতা ঐ মহিলার থাকার কথা নয়। ফটোগ্রাফারের চিন্তা করা উচিত, দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার পরও মহিলার মাথায় কাপড় ছিল। আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে, মহিলাটি ফটোগ্রাফারকে ফটো পোজ দেয়ার জন্য দাঁড়াননি। ফটোতে দেখা যায়, তখনো তিনি দুই পা সোজা করে দাঁড়াতে পারেননি, হাত দুটো সামনের দিকে। তার চেহারায় অসহায়ত্বের ও লজ্জাবোধের ভাব স্পষ্ট।
হায়রে বাংলাদেশের মানুষ! নিজ নিজ জীববৈশিষ্ট্য নিয়ে আপাত স্বাচ্ছন্দ্যে ছোট-বড় সবাই দিনানিপাত করছে। এগিয়ে যাচ্ছে জীবন সমাপ্তির পথে। কিন্তু মানুষ্যত্বের মানদণ্ডে বিচার করতে গেলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, এদেশে সাধারণ জনগণের বেলায় মনুষ্যত্বটা যেন শৃগাল-কুকুরের খাদ্য। অথরিটি বা পরিচালনযন্ত্রের ঠিকানা যেখানে অস্পষ্ট, সেখানে ভাল-খারাপের দায়ভার কে নেবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অপরিকল্পিত নিম্নমানের লঞ্চ তৈরী হয়; যাত্রী তোলা হয় অতিরিক্ত, ঘটে দুর্ঘটনা, শয়ে শয়ে লোক মারা যায়। জনগণের ট্যাঙ-এর টাকা দিয়ে নিয়োজিত দায়িত্বশীলদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য চাকরি যাওয়ার বা শাস্তি হওয়ার খবর ঘটনার তুলনায় নগণ্য। মহিলাটির নাগরিক অধিকার খর্ব করে ফটোগ্রাফারের বিকৃত খামচির কথা হয়ত সরকারের কারো নজরে পড়লো না। কিন্তু লঞ্চ দুর্ঘটনার ব্যাপার নিয়ে তো পত্রিকায় কত সত্য/মিথ্যা প্রেসনোট পর্যন্ত চলে আসে। এভাবে মানুষ মারার প্রতিকারের কথা যেখানে বাংলার মানুষ চিন্তা করতে পারে না, সেখানে অসহায় লজ্জিত মহিলার প্রতি ফটোগ্রাফারের এই কাজ অশালীন তো বটেই, এক প্রকার বিবেক চর্চারও অভাব। ব্যাপারটি সভ্যতা ও সভ্যদের কাছে একটি প্রশ্ন হিসাবে ধরা দেয়াই স্বাভাবিক।
ব্যবসায়িক কারণে বৃটেনে গেলে আমি দু’টো জায়গায় নিদেনপক্ষে একবার করে ঢুঁ মারতে যাই। একটি মিউজিয়াম, অন্যটি বৃটিশ ওয়েস্ট মিনিস্টার হলে পার্লামেন্ট কক্ষের দর্শক গ্যালারী। ১৯৮৪ সালে একদিন বৃটিশ মিউজিয়ামে ন্যাশনাল (হিস্টরিক্যাল) মিউজিয়াম দেখার পর মিউজিয়াম প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরীণ সুড়ঙ্গ দিয়ে সাইন্স মিউজিয়ামের দিকে যাচ্ছিলাম। সুড়ঙ্গের ভিতর এক জায়গায় একলোক চোখ বন্ধ করে বাজনা বাজাচ্ছিল। তার পাশে একটি কালো কাপড় বিছানো, ওখানে কেউ কেউ দু’একটি কয়েন দিয়ে যাচ্ছিল। আমি আগে থেকেই জানতাম যে, ওখানে ভিক্ষা চাওয়ার এটা একটা কৌশল বা পদ্ধতি। অর্থাৎ লোকটি আপনার নিকট থেকে মাগনা/মফতো পয়সা চাচ্ছে না, গান বা বাজনা জাতীয় কিছু একটা শুনানোর বিনিময়ে সে আপনার কাছ থেকে সাহায্য চাচ্ছে। যখন তার চাহিদা অনুয়ায়ী অর্থ পাবে তখন সে কাপড় গুটিয়ে ফেলবে এবং চলে যাবে। এমনও দেখেছি – গান বন্ধ করার পর কেউ পয়সা দিতে চাইলে, সে আর নেবে না। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, ‘‘আমার গান গাওয়া বন্ধ হয়েছে, বিনিময় ছাড়া তোমার পয়সা নেব কেন।”
এই বৃটিশ ভিক্ষুককে দেখে আমার মনে তার ফটো নেয়ার খেয়াল চাপল। হল্যান্ড থেকে সদ্য কেনা জাপানিজ পেট্রি ক্যামেরা দিয়ে সুন্দর একটা ছবি তুলে তা বাড়ীতে এসে সবাইকে দেখাতে পারব – আমাদের স্বপ্নের বৃটিশ দেশেও ভিক্ষাবৃত্তি আছে। যেই চিন্তা সেই কাজ। কিন্তু আমার ক্যামেরার ফ্লাশ লাইট পড়ার সাথে সাথেই লোকটি চোখ খুলে বাঘের মত আমার দিকে তেড়ে আসল। তার কথা হল, তুমি আমার ফটো নিয়েছ কেন? আমি তোমার বিরুদ্ধে মামলা করব। দাও তোমার ক্যামেরা। তার দ্রুত বাক্যবানে আমি প্রথমে হতভম্ব হয়ে পড়ি। তারপর কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করলাম। বুঝতে বাকী রইল না যে, আমি ধরা খেয়েছি। তার কথা না বুঝার ভান করেও কিছুক্ষণ সময় নিলাম। সে কি বলতে চাচ্ছে তা আবারো জিজ্ঞাসা করলাম। সে আমাকে ধীর উচ্চারণে, রূঢ় মূর্তি নিয়ে বুঝিয়ে দিল যে, আমি অনুমতি ছাড়া তার এ অবস্থার ফটো ধারণ করে তার অধিকার ক্ষুণ্ন করেছি। ইতিমধ্যে আমার মাথায় বুদ্ধি এসে গিয়েছে। হোক না সে শিয়াল মার্কা বুদ্ধি বা কুবুদ্ধি। কিন্তু আগে হিংস্র আক্রমণ থেকে জান বাঁচানো দরকার। আমি তাকে বললাম, “আমি তোমার ফটো ধারণ করি নাই। তোমার পিছনে দেয়ালে অংকিত ম্যুরাল আমাকে আকৃষ্ট করেছে। ম্যুরালটি ছিল এক বয়স্ক বৃটিশ মহিলা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে তার কুকুর দু’টিকে বিষ্ঠা ত্যাগ করানোর দৃশ্য। দৃশ্যটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমাদের বাংলাদেশে কুকুর একটি মালিকানাবিহীন জন্তু। তাই এই ফটো নিয়ে আমি সবার ভিতর কৌতূহল সৃষ্টি করতে পারব।” আমার কথায় সে সন্তুষ্ট হল। আমাকে অনুরোধ করল – যেন তার ছবিটা নিয়ে আমি তার কোন ক্ষতি না করি। লোকে বলে, বিদেশ বিভূঁই, কতই বিপদ আপদ হতে পারে। সে রকম একটা বিপদ থেকে শেয়ালবুদ্ধির বদৌলতে রেহাই পেয়েছি। এখানে শেয়ালের বুদ্ধির মত আমি মনুষ্যের বুদ্ধিটা খুব কাজে লেগেছে। সেই থেকে আমি শিয়ালকে – শিয়াল বন্ধু বলি। দেশ-বিদেশ ঘুরলে মানুষের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়। এটা আমার কাছে তদ্রুপ একটা ব্যাপার।
বর্ণনা করতে চেয়েছিলাম – উন্নত বিশ্বের মানুষের অধিকার ও সচেতনতার কথা। আর তুলনামূলকভাবে আমাদের বাংলাদেশে কিভাবে বিভিন্ন শিকারীদের হাতে সাধারণ মানুষ অপদস্থ হয়, তার ১টি নমুনাও। দুঃখের সাথে বলতে হয়, প্রতিবাদী ভাষা, সর্বোপরি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কল্যাণকামী অভিভাবকের অভাবে প্রতিকারের কোন সুযোগ আমাদের দেশে নাই। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ব্যাপকহারে শিক্ষা বিস্তার করার একান্ত প্রয়োজন। তখনই সৃষ্টি হতে পারে গণসচেতনতা এবং তখনই জনতার ভেতর থেকেই সৃষ্টি হবে কল্যাণমুখী নেতৃত্ব। সৃষ্টি হবে সামনে এগিয়ে চলার পথ। সাধিত হবে মানবীয় উন্নয়ন এবং তা বিস্তৃতি লাভ করবে সবদিক থেকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষানুরাগী, সমাজব্রতী

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুহম্মদ মনসুরউদ্দীন : লোকগীতির সংগ্রাহক ও সম্পাদক
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে