মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় কাউন্সিলিং এর ভূমিকা

জিয়া হাবীব আহ্‌সান | শনিবার , ৭ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

শারীরিক কষ্ট চিকিৎসার মাধ্যমে নিবারণ করা যায় কিন্তু মানসিক কষ্ট ডাক্তারী চিকিৎসার মাধ্যমে নিবারণ করা যায় না। এর জন্য কাউন্সিলিং একটি জরুরি প্রয়োজনীয় বিষয়। উন্নত বিশ্বে মানসিক ট্রমা দূর করতে কাউন্সিলিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শরীর খারাপ হলে মানুষ ডাক্তারের কাছে যায়। মন যখন খারাপ হয় তখন মানুষ কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। মনের অশান্তিতে অনেক সময় স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ পতন হয়। তখন ব্যক্তি নিত্যদিনের কাজকর্ম, পারস্পরিক সম্পর্ক ও দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এমনকি মনের এই অবস্থার জন্য শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোও ঠিকমত কাজ করে না। এই অবস্থাকে অবহেলা করলে পরবর্তীতে তা ব্যক্তির জন্য বড় সমস্যায় পরিণত হতে পারে।

মানসিক সমস্যা বা রোগের জন্য ব্যক্তি ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার ওষুধ দিয়ে তার সমাধান করেন। যদি ব্যক্তি মনোবৈজ্ঞানিক কাউন্সেলিং-এর সহায়তা নেয় তবে ওষুধ ছাড়াই সমস্যা লাঘব হতে পারে। কখনও কখনও আমাদের জীবনে এমন সব বাধা আসে যেগুলোর জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত থাকি না বা তার মোকাবিলা করতেও সক্ষম হই না। ফলে আমাদের মধ্যে দিশেহারা বোধ, ক্লান্তি, রাগ, অসহায়তা, ভয়, হতাশা, দুঃখ বা অক্ষমতা দেখা দেয়। সে সময়ে পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা চলতে পারি না। আমাদের জীবন একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় কাউন্সেলিং-এর সহায়তায় একজন মানুষ তার জীবনের গোপনীয়তা রক্ষা করে নিজের সমস্যার কথা বলতে পারে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। কাউন্সিলরের কাছে কখন যাবেন? জীবনের টানাপোড়েন ও চাহিদাগুলো সামলাতে অসুবিধা, সিদ্ধান্ত নিতে কিংবা জরুরি কাজ-কর্ম শেষ করতে ব্যর্থতা, লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতা, কারো সাথে কথা বললে ভালো লাগবে বলে মনে করা তবে কথা বলার মত মানুষ খুঁজে না পাওয়া, অন্য কোনও সাহায্য বা সহযোগিতা যথেষ্ট মনে না হওয়া, মানসিক যন্ত্রণার ফলে স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধাগ্রস্ত হওয়া, মর্মপীড়া ও মনকষ্ট দূর করা ইত্যাদি কারণে আমরা কাউন্সিলরের কাছে যেতে পারি।

কাউন্সিলিং আত্মহত্যার প্রবণতা থেকেও একজন ব্যক্তিকে রক্ষা করতে পারে। মানসিক শক্তি বৃদ্ধিতে এটা সহায়ক ভূমিকা রাখে। কাউন্সেলিং-এ কী করা হয়? ব্যক্তি যে সমস্যা বা বিষয় নিয়ে কাউন্সিলরের কাছে যায়, কাউন্সিলর প্রথমেই তা মন দিয়ে শোনেন। এভাবে শোনার মাধ্যমে দুজনেরই সমস্যা সম্পর্কে একই উপলব্ধি হয়, ফলে দু’জনই সমস্যাটিকে একইভাবে দেখতে শুরু করেন। ক্রমে সমাধানের সম্ভাব্য পথগুলো নিয়ে ব্যক্তি চিন্তা করতে শুরু করে। যে সমাধানটি ব্যক্তির কাছে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হবে তা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে কাউন্সিলর ব্যক্তিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। মূলত: মানসিক বিপর্যয়ে যখন ব্যক্তি অচল হয়ে পড়ে তখন কাউন্সিলর তাকে মনোবল ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেন। মনোবিজ্ঞানে কাউন্সেলিং মূলতঃ একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া যার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি-তার নিজের চিন্তা, চেতনা এবং সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হয়, নিজের ক্ষমতা ও দক্ষতা সম্পর্কে সচেতন হয়, নিজের অনুভূতিগুলোকে মূল্যায়ন করে, স্বেচ্ছায় এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনার জন্য সচেষ্ট হয়, আত্ম-নির্ভরশীল হয়ে নিজ দায়িত্বে, সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কাউন্সেলিং অনন্তকাল ধরে হয় না। এখানে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা হয়। যখনই ব্যক্তি সেই লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারে অথবা অনুভব করে যে সে নিজেই তার সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে সক্ষম তখনই কাউন্সেলিং-এর সমাপ্তি হয়।

কাউন্সেলিং সবার জন্যই জরুরি : বিশেষ করে আমরা যখন জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে দিশাহারা হয়ে যাই তখন কাউন্সেলিং খুবই সাহায্য করে আমাদের। এটা এমন একটা প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা যা আমাদের নিজেদের ভালো করে চিনতে শেখায় বা বুঝতে শেখায়। আর সে সঙ্গে আমরা যে বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবিলা করছি সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের মনে স্বচ্ছ ধারণার জন্ম দেয়। এর সাহায্যে আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা বা বোধ গড়ে ওঠে, নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল হয়ে উঠি এবং গঠনমূলক উপায়ে প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করতে সক্ষম হই। কাউন্সেলিং আমাদের আচার-আচরণে পরিবর্তন আনে, আমাদের আত্মনির্ভরতা ও মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়।

যখন আমরা কোনও সমস্যায় পড়ি তখন নিজেদের বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারি। কিন্তু তার পরিবর্তে কেন একজন কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলাটা জরুরি হয়ে ওঠে? একজন কাউন্সিলরের কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? নিজেদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রায়শই একটা বড় সংখ্যক মানুষের একজন কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলার ঝোঁক ক্রমশই বাড়ছে। যদিও কাউন্সেলিং সম্পর্কে এখনও কিছু মানুষের মনে নানারকম বিধিনিষেধের বেড়াজাল বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে, অর্থাৎ কাউন্সেলিং-এর প্রতি তাদের মনে এখনও বিশ্বাস জন্মায়নি। এখনও মনে করা হয় যে কাউন্সেলিং অল্পবয়সি এবং বিপর্যস্ত মানুষ, দুর্বল মনের মানুষ এবং মানসিকভাবে অসুস্থদের জন্যই প্রযোজ্য। অনেকে মনে করে কাউন্সেলিং-এর মধ্য দিয়ে মানুষকে পরামর্শ দেওয়া হয় এবং এর থেকে ভালো ব্যবস্থা হল পরিচিত কারোর সঙ্গে যেমন- কাছের বন্ধু বা পরিবারের লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা।

আবার কখনও একজনের সমস্যার গভীরতা অন্যজনের কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নাও মনে হতে পারে। তখন তারা নিজেদের মনের বদ্ধমূল ধারণা থেকে অন্যের সমস্যা সমাধানের কথা ভাবতে পারে। একজন বন্ধু বা পরিবারের সদস্যের কাছে তার কাছের মানুষের যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি শোনাটা কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে এবং সমস্যার সমাধানের উপায় ঠিক করার জন্য তাদের মানসিক অস্বস্তিতেও পড়তে হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে কাউন্সিলরের অবস্থান একেবারেই আলাদা, অনন্য। তারা কোনও অসুস্থ মানুষের বন্ধু বা পরিবারের সদস্য অথবা পরিচিত কেউ নয়। একজন কাউন্সিলর মানুষের সঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সম্পর্ক গড়ে, তাকে নিরাপদ রাখতে চায়, নিজের মতামত দেয় না এবং যখন কেউ তার সমস্যার কথা কাউন্সিলরকে বলে তখন কাউন্সিলর পুরো বিষয়টাই গোপন রাখেন।

একজন কাউন্সেলর রুগিকে সহানুভূতি, সহযোগিতা দান করেন, তার গোপনীয়তা রক্ষা এবং প্রতিবন্ধকতা কাটানোর জন্য সঠিক রাস্তাও দেখান। এটাও মনে রাখা জরুরি যে কাউন্সেলিং করা মানে কোনও নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানের জন্য পরামর্শ দেওয়া নয়। এর মাধ্যমে রুগিকে এমনভাবে উৎসাহ দেওয়া হয় যাতে সে নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করতে পারে। এভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করার জন্য রুগিকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলাও কাউন্সেলিং-এর সাহায্যে সম্ভব। প্রত্যেক কাউন্সেলরের কাজ করার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি থাকে। কাউন্সেলিং-এর শুরুতেই সেই পদ্ধতির কথা তাঁর পরিষ্কার করে দেয়া উচিত। কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় প্রথমে কিছু সময় রুগির সমস্যার ধরন বুঝতে সময় লাগে। তারপর কাউন্সিলর ঠিক করেন কীভাবে কাউন্সেলিং করবেন।

কাউন্সিলর রুগির পারিবারিক পটভূমি, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তার শরীর স্বাস্থ্য সবকিছুই দেখেন এবং তারপর থেরাপির জন্য পদক্ষেপ করেন। ক্রমান্বয়ে কাউন্সিলর রুগিকে সঙ্গে নিয়ে থেরাপির প্রক্রিয়ায় অংশ নেন এবং লক্ষ্যে পৌঁছতে চেষ্টা করে। একজন কাউন্সিলর কোনও চিকিৎসকের মতো দায়িত্ব পালন করে না। সে রুগির রোগ নির্ণয় বা তাকে ওষুধ খাওয়ার পরামর্শও দেয় না। কাউন্সিলর মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন পেশাদার যেমন- মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের সঙ্গে মিলে রুগির থেরাপির দায়িত্বও নেন। আমাদের দেশে কাউন্সিলিং এখনও জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হলাম যে, নারী পক্ষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ও ছাত্র মিলে একটি কাউন্সেলিং প্রকল্প শুরু করেছেন। আশা রাখি আলোচ্য বিষয়টি নিয়ে উন্নত বিশ্বের মতো আমরাও এগিয়ে যাবো, ইন শা আল্লাহ্‌।

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, সুশাসন ও মানবাধিকার কর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাব বিনিময়-ই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে