মানব পাচার রোধে দরকার সামাজিক সচেতনতা

| সোমবার , ১৮ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

‘মানব পাচার’ একটি সামাজিক ব্যাধি। সভ্যতাবিবর্জিত জঘন্য অপকর্ম। একশ্রেণীর সমাজবিরোধী দুর্বৃত্ত অর্থ উপার্জনের সহজ উপায় হিসেবে মানব পাচারকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাদের প্রলোভনে পড়ে অনেক অবৈধ অভিবাসী অথৈ সাগরে সলিল সমাধি হয়েছে অথবা মানব পাচারকারী চক্রের হাতে জিম্মি ও আটক হয়ে মানবেতরভাবে জীবনযাপন করছে এবং তাদের জীবন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এর প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১২ এপ্রিল দৈনিক আজাদীর প্রধান সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘মানবপাচার চক্রের ৫ জন গ্রেপ্তার, ‘মালয়েশিয়া নেয়ার কথা বলে নামিয়ে দেয়া হয় সেন্টমার্টিন উপকূলে, ৩১ পাসপোর্ট, এনআইডি ও ভুয়া নথিপত্র জব্দ’। এতে বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলের গরিব ও নিরীহ মানুষদের অল্প টাকায় মালয়েশিয়া নেয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। এরপর করা হয় স্ট্যাম্পে চুক্তি। প্রতিজন থেকে নেওয়া হতো এক থেকে দুই লাখ টাকা। তারপর রাতের আঁধারে সবাইকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একত্রিত করে উঠানো হয় ট্রলারে। সেই ট্রলারে করে সাগরে দুই-তিনদিন ঘুরানো হয়। এরপর আবার রাতের আঁধারে মালয়েশিয়া চলে এসেছে বলে নামিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনের উপকূলে। এমন প্রতারক ও শীর্ষ মানবপাচারকারী চক্রের প্রধান শফিউল আলম, তার ভাই ইসমাইল হোসেনসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গত রোববার দুপুরে বাঁশখালীর ছনুয়া ও পেকুয়ার রাজাখালী ইউনিয়নে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-৭ এর একটি টিম তাদের গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৩১টি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়।
জাতিসংঘের মতে মানব পাচার হল, “ভয় দেখিয়ে বা জোর করে অথবা কোনোভাবে জুলুম করে, হরণ করে, প্রতারণা করে, ছলনা করে, মিথ্যাচার করে, ভুল বুঝিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, অথবা যার উপরে কর্তৃত্ব আছে পয়সা বা সুযোগ-সুবিধার লেনদেনের মাধ্যমে তার সম্মতি আদায় করে শোষণ করার উদ্দেশ্যে কাউকে সংগ্রহ করা, স্থানান্তরিত করা, হাতবদল করা, আটকে রাখা বা নেওয়া।”
২০২০ সালে সরকারসমূহ যখন কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ে ব্যস্ত ছিল সেই সময়ে মানব পাচারকারীরা তাদের অপরাধ করার নতুন সব পথ খুঁজে বের করেছে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানব পাচার সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে। পাচারকারীরা দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে শোষণ করার জন্য লোভের ফাঁদে ফেলেছে। এবং ইন্টারনেট বা অনলাইনে বেশি সময় উপস্থিত থাকার কারণেও কেউ কেউ পাচারের ঝুঁকির শিকার হয়েছেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ২০২১ মানব পাচার প্রতিবেদন-এ এমন তথ্য জানা গেছে। এই প্রতিবেদন তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৮৮টি দেশে মানব পাচারের প্রবণতাকে বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী মানব পাচার বিরোধী কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে আনুমানিক আড়াই কোটি মানুষ যৌন পাচার ও বলপূর্বক শ্রমের শিকার হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানব পাচার বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা এবং একটি ঘৃণ্য অপরাধও বটে। পাচারের শিকার মানুষদের মানবাধিকার নানাভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রতিবছর পাচারের শিকার হয়ে সারা বিশ্বে অনেক মানুষের জীবনে সর্বনাশ ঘটছে। জাতিসংঘের মাদকদ্রব্য ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) মানব পাচারের তথ্যউপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পাচারের শিকার প্রতি তিনজনের একজন শিশু। তারা অনেকেই যৌন নিপীড়ন ও জোরপূর্বক কায়িক শ্রম দিতে বাধ্য হয়। তাই এটাকে কেউ কেউ ‘আধুনিক দাসত্ব’ বলছেন।
ইউএনওডিসির মতে, সারা বিশ্বের কোথাও না কোথাও মানুষ নানাভাবে পাচারের শিকার হচ্ছে, অর্থাৎ পৃথিবীর কোনোস্থানেই মানুষ পাচারকারীর খপ্পর থেকে নিরাপদ নয়। জাতিসংঘের এই সংস্থাটির মতে, পাচারের শিকারের অধিকাংশ নারী ও শিশু (প্রায় ৭০ ভাগ)।
বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপির সাবেক উপ-মহাপরিচালক ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ তাঁর এক লেখায় বলেছেন, মানব পাচার আধুনিক সভ্যতার একটি নিকৃষ্টতম জঘন্য অপরাধ। বিদ্যমান মানব পাচার আইন-২০১২ সঠিক প্রয়োগ, সরকারি ও এনজিওদের সক্রিয় অংশগ্রহণে দেশব্যাপী জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশে বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হলে দালালের মাধ্যমে অবৈধপথে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা নিঃসন্দেহে কমে আসবে। পাশাপাশি এ জাতীয় জঘন্য অপরাধ নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বদা তৎপর ও কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় মানব পাচার বন্ধ হবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানব পাচার রোধে প্রথমে যা দরকার তা হল, সামাজিক সচেতনতা তৈরি। সবাই যদি সচেতন হই তাহলে পাচাররোধ করা যাবে সহজেই। তাছড়া রাষ্ট্রের পক্ষে আইন বাস্তবায়নে যাঁরা নিয়োজিত রয়েছেন তাদের সদিচ্ছা যদি থাকে তাহলে সহজে পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব। এমন একটি বিশ্ব আমাদের গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কেউ পাচারের শিকার হবে না এবং প্রত্যেকে নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে