মানব কল্যাণের কথা যখন আসে প্রথমেই বলতে হয় এই পৃথিবী এই বিশ্ব ‘মানবের তরে–দানবের তরে নয়’। যুগ হতে যুগান্তরে দানবেরা বার বার মাথা তোলতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারে নি। সব সময় মানবতার জয় হয়েছে। হাজার হাজার বছর আগে যখন দেবতাদের রাজত্ব ছিল তখন দানব বংশ ‘অশুর’ দেবতাদের বিনাশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। দেবগণ সর্বশক্তিমান ‘মা’ দূর্গার আরাধনা করেন দেবকুলকে বাঁচানোর জন্য। তখন দশভূজা ‘মা’ দূর্গা স্বয়ং আভির্ভূত হয়ে সেই দানবরুপি অশুরকে পদদলিত করে ত্রিশুল বিদ্ধ করে হত্যা করে। দেবগণ রক্ষা পায়। ফিরে আসে শান্তি। শত শত বৎসর ধরে পৃথিবীতে মানুষরূপী দানবেরা একটার পর একটা বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণ কেরে নিয়েছে। কত দেশ ধ্বংস লিলায় পরিণত হয়েছে এখনও তা চলছে। তারপরও পৃথিবী টিকে আছে। পুনর্জাগরণ হয়েছে আবার। বর্তমান আমাদের সামাজে মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মানবিকতা এবং মানবিকতার জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে– চরম স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, ভোগ, লালসা। তাই আইনের যথাযথ প্রয়োগ, ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা, সামাজিক ও পারিবারিক দায়বদ্ধতা অপরিহার্য। ভূপেন হাজারিকার গানের ভাষা ছিল– মানবতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, সাম্য, সৌহার্দ্য। তার গানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর, মানবতা প্রতিষ্ঠার দৃপ্তবাণী। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ–বাংলাকে ভালোবেসে বলে গেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানঁিসড়িটির তীরে এই বাংলায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। সেই বাংলায় আজ মানুষে মানুষে হানাহানি, অপহরণ, সন্ত্রাস, খুন, লুণ্ঠন, ধর্মের ভেদাভেদ, ধর্ষণ প্রভৃতি সামাজিক অস্থিরতা বিরাজমান। মানুষ বিভিন্ন ভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। অবুঝ শিশুদের ধর্ষণের পর গলাটিপে হত্যা করা হচ্ছে। কী নির্মম ও পৈশাচিক। এই সমস্ত অপকর্ম রোধ করতে গেলে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে এবং সেটা পরিবার ও শৈশব থেকে শুরু করতে হবে। আইনের কঠোরতা বাস্তবায়ন করতে হবে। পৃথিবীর বিশাল জনগোষ্ঠির মাঝে মনুষ্যত্ব, মমত্ববোধের বড় অভাব। বেশিরভাগ জনগোষ্ঠি নিজস্বতায় আবিষ্ট ও ক্ষণ জন্মা এই জীবনে মানুষ বিলাসব্যসনে মগ্ন থাকতে চায়। তাই বর্তমান সামাজিক দুরবস্থার মাঝে অনুভূতি প্রবণ, সাধারণ জীবন যাপন ও কল্যাণকর মানুষ থাকা খুবই জরুরি। ইতিহাস ঘাটলে আমরা পাই হাজী মুহম্মদ মুহসীন রাত্রে ছদ্ধবেশে নগর ভ্রমণে বের হতেন তাঁর প্রজারা কে কেমন আছে স্বচক্ষে দেখার জন্য। তিনি খুব দয়ালু ছিলেন। হজরত ওমর (রা) ছিলেন মানবিকতারই উজ্জ্বল। জেরুজালেমের পথে ভৃত্যকে উটের পিঠে চড়িয়ে পালাক্রমে রশি টেনে পথ চলছিলেন। কাজটা সমান ভাগ করে নিয়েছিলেন। ছদ্মবেশে তিনি না খাওয়া মানুষের ঘরে নিজে আটা পৌঁছে দিতেন। ঈশ্বরচন্দ্র্র বিদ্যসাগার রাস্তায় পড়ে থাকা এক কষ্ঠ রোগীকে পাঁজা কোলা করে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। মমত্ববোধের কী মানসিকতা না ছিল তার? তিনি শুধু বিদ্যাসাগর ছিলেন না দয়ার সাগরও ছিলেন। ঠিক তেমনই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘মানবতার মা’ তিনি যেভাবে অসহায় আশ্রয়হীনদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সেটা তাঁর বাঁধ ভাঙা মমতার বহি:প্রকাশ। রাস্তায় পড়ে থাকা লক্ষ লক্ষ মানুষদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন। এই আবাসনে যারা ঠাঁই পেয়েছে তাদের চোখে নীরব আনন্দাশ্রু। প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্যে মেট্রোরেল চালু হওয়ার প্রথম দিকের একটা ঘটনা– অন্ত:সত্ত্বা এক নারী– নাম তার সোনীয়া রানী রায়। স্বামীর সাথে মেট্রোরেলে চড়ে উত্তরা থেকে ধানমণ্ডির একটি হাসপাতালের যাচ্ছিলেন ডাক্তার দেখাতে। পথেই শুরু হলো প্রসব বেদনা। অগত্যা আগারগাঁও মেট্রোস্টেশনে নেমে গেল। প্রসব বেদনা আরও বেড়ে যাওয়ায় লোকজন সহানুভূতির সহিত তাকে স্টেশনের প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়া হলে সেখানে ধাত্রী বিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোভার স্কাউট সদস্য সোনিয়া রায়ের ডেলিভারি করান। সোনিয়া সুস্থ পুত্র সন্তানের মা হন। তারপর অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের ধানমণ্ডির রেনেসাঁ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কথা থাকে মেট্রোস্টেশনে এমন ভাবে একটি প্রসূতি মায়ের শিশুর জন্মদান মানবতার দাবীদার। এটাই মানবিকতা এটাই মানুষের প্রতি মানুষের কল্যাণ সাধন ও কর্তব্য। এখানে ধর্ম বর্ণ ভেদাভেদের কোনো স্থান নেই। সেদিনের সে ঘটনা মানবতার জয়গান হয়েছে। ভেদাভেদ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। যুগের পরিবর্তন হয়েছে মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে, ক্রমাগত আধুনিক জীবন যাপন করছে। ডিজিটেল যুগে প্রবেশের পর বাংলাদেশও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। নুতন প্রজন্ম দ্রুত জীবনে তাড়িত হচ্ছে। কিন্তু সমাজ নির্মল হয়নি বরং বিষবাষ্প বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ অতিমাত্রায় অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। অতৃপ্তি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, লোভ সমাজকে কলঙ্কিত করছে। অঢেল সম্পদ, অতুলনীয় সুনাম তুবও শান্তি পাচ্ছে না। প্রয়াত আবদুল গফফার চৌ: যিনি চিরদিন মানবতার জয়গান করেছেন জীবন সায়াহ্নে বলেছেন সমাজ কলুষমুক্ত হতে পারেনি। দেশ মাতৃকার চোখ থেকে বেদনার জল ঝরছে। এও বলেছেন ‘ভালোবাসা বড় দুলর্ভ সৌরভ/সুগন্ধির দোকানেও কখনো পাবেনা’। বলতে হয় এত অবক্ষয়ের মাঝেও বর্তমান তরুণ সমাজের ভূমিকা প্রশংসার দাবীদার ও উৎসাহ ব্যঞ্জক। সামাজিক উন্নয়নে লক্ষ্যে তরুণরা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে দেশের ও সমাজের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বর্তমান আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার সিংহ ভাগই তরুণ প্রজন্ম। দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে তরুণরাই আশার প্রদীপ। তাদের সৃজনশীলতায় তাদেরকে গড়ে তোলছে দক্ষ ও সুনাগরিক হিসাবে। বাল্য বিবাহ, যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, কিশোর অপরাধ, বিচারহীনতা, বৈষম্য সমাজে প্রচলিত আছে। একমাত্র তরুণরা পারে এগুলোর প্রতিবাদও প্রতিরোধ করতে। অন্যায়ের প্রতিবাদ স্বরূপ মানবন্ধন, সভা সেমিনার করা, প্রয়োজনে অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা প্রভৃতি কাজে তরুণদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। তাই কবি বলেছেন গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে নহে কিছু বড় নহে কিছু মহীয়ান। সবার জীবন হয়ে উঠুক সত্য সুন্দর ও সুপথের । মানবিকতার উজ্জ্বল দীপশিখা প্রজ্বলিত থাকুক।
লেখক : প্রাক্তন চীফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।