মানবপাচার চক্রের ৫ জন গ্রেপ্তার

মালয়েশিয়া নেয়ার কথা বলে নামিয়ে দেয়া হয় সেন্টমার্টিন উপকূলে।। ৩১ পাসপোর্ট, এনআইডি ও ভুয়া নথিপত্র জব্দ

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১২ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ

গ্রামাঞ্চলের গরিব ও নিরীহ মানুষদের অল্প টাকায় মালয়েশিয়া নেয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। এরপর করা হয় স্ট্যাম্পে চুক্তি। প্রতিজন থেকে নেওয়া হতো এক থেকে দুই লাখ টাকা। তারপর রাতের আঁধারে সবাইকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একত্রিত করে উঠানো হয় ট্রলারে। সেই ট্রলারে করে সাগরে দুই-তিনদিন ঘুরানো হয়। এরপর আবার রাতের আঁধারে মালয়েশিয়া চলে এসেছে বলে নামিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনের উপকূলে। এমন প্রতারক ও শীর্ষ মানবপাচারকারী চক্রের প্রধান শফিউল আলম, তার ভাই ইসমাইল হোসেনসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।
গত রোববার দুপুরে বাঁশখালীর ছনুয়া ও পেকুয়ার রাজাখালী ইউনিয়নে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-৭ এর একটি টিম তাদের গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৩১টি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। গতকাল সোমবার নগরীর চান্দগাঁও ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে এই চক্রের অপকর্মের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ।
গ্রেপ্তারকৃত মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা হলেন বাঁশখালীর ছনুয়া ইউনিয়নের ছেলবন গ্রামের কবির সিকদারপাড়ার মোজাফফর আহমদের ছেলে শফিউল আলম (৩৭) ও তার ছোট ভাই মো. ইসমাইল (৩২), শফিউল আলমের শ্বশুর পশ্চিম ছেলবন গ্রামের মৃত সৈয়দ আহামদের ছেলে মো. ইউনুছ মাঝি (৫৬), ছেলবন গ্রামের ছালেহ আহমদ সিকদার পাড়ার মৃত চাঁন মিয়ার ছেলে সাবেক ইউপি সদস্য মো. হোসেন (৬০) এবং পেকুয়ার রাজাখালী সবুজ বাজার এলাকার সেকান্দার আলীর ছেলে রিয়াজ খান রাজু (৪১)। রিয়াজ খান রাজু রাজাখালী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। শফিউল ও ইসমাইলের বিরুদ্ধে ৭টি করে মানবপাচার আইনে মামলা আছে।
র‌্যাব জানায়, তারা কঙবাজার জেলার পেকুয়া ও চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানা এলাকার নিরীহ মানুষের দারিদ্রতার সুযোগে স্বল্প খরচে বিদেশ পাঠানোর জন্য কন্ট্রাক করে। এরপর তাদের নিকট থেকে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রেখে কিছু টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী প্রার্থীদের পাসপোর্ট বানানোর জন্য তাদের অন্যতম সহযোগী আসামি রিয়াজ খাঁন রাজুকে দেয়। রিয়াজ খাঁন রাজু মালোশিয়া যেতে আগ্রহী প্রার্থীদের পাসপোর্ট তৈরি করে স্ব-স্ব ব্যক্তিদের কাছে পাসপোর্ট প্রদান করে। এতে করে সে আগ্রহীদের মনে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের মাধ্যমে স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া যাওয়া সহজ বলে প্রলোভন দেখাতে থাকে। এতে নিরীহ লোকজন এই চক্রকে বিশ্বাস করে রাজুর নিকট মোট খরচের অর্ধেক টাকা জমা দিয়ে দিতো। অতঃপর রাজুর সহযোগী উল্লেখিত অন্যান্য সদস্যদের সহায়তায় মালয়েশিয়া গমনে ইচ্ছুক লোকদের গভীর রাতে ট্রলারে তুলে দিতো। ট্রলারে তুলে দেওয়ার পূর্বে তাদের সকলের পাসপোর্টের কপি রাজুর নিকট রেখে দিতো। সে লোকজনদের বলতো বিদেশ পৌঁছানোর পর বাকি টাকা পরিশোধ করলে তাদের নিকট পাসপোর্ট পাঠিয়ে দিবে। গ্রেপ্তারকৃত ৫ নং আসামি ইউনুছ অপর আসামি ইসমাইল ও শফিউল আলমদের মানবপাচারে লোক সংগ্রহের কাজে সহায়তা করতো।
ভুক্তভোগী ভিকটিম জয়নাল আবেদীন ধৃত ৩ নং আসামি রিয়াজ খান রাজুকে বিশ্বাস করে তার নিকট একটি পাসপোর্ট তৈরী করার জন্য যায়। রাজু তাকে পাসপোর্ট বানানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ভিকটিম বলে সুযোগ হলে কখনো বিদেশ যাবো। তখন রাজু ভিকটিমকে বলে, তাকে কম টাকার মধ্যে মালয়েশিয়া পাঠাতে পারবে। তার মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে লোক আছে। এই কথার প্রেক্ষিতে ভিকটিম রাজুকে পাসপোর্ট তৈরী করার জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার টাকা দেয়। কিছুদিনের মধ্যে রাজু ভিকটিমকে পাসপোর্ট তৈরী করে দেয়। তখন ভিকটিম রাজুকে বিশ্বাস করে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য পুনরায় ১ লাখ টাকা দেয় এবং বাকি টাকা মালয়েশিয়া যাওয়ার পর পরিশোধ করলে হবে মর্মে রাজু জানায়। টাকা দেওয়ার ১৫ দিন পর রাজু ভিকটিমকে গভীর রাতে পেকুয়া থানাধীন একটি ঘাট হতে ট্রলারে উঠিয়ে দেয়। ঐ ট্রলারে রাজুর মানবপাচার চক্রের কয়েকজন সদস্যসহ আরো ১৫-২০ জন ভুক্তভোগী ছিলো। পরবর্তীতে তাদেরকে নিয়ে ২/৩ দিন গভীর সাগরে ঘুরাফেরা করে হঠাৎ গভীর রাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে মালয়েশিয়া চলে এসেছে বলে ট্রলার থেকে সবাইকে নামিয়ে দেয়। সকাল হলে ভুক্তভোগীরা সবাই বুঝতে পারে যে, রাজু প্রতারণা করে তাদেরকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নামিয়ে দিয়েছে। অতঃপর তারা কয়েকদিন সেন্টমার্টিন দ্বীপে মানবেতর জীবনযাপন করে যে যার মতো করে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি এসে রাজুর কাছ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য দেওয়া টাকা ফেরত চাইলে তাদেরকে মারধর করে এবং অপহরণ পূর্বক মেরে ফেলার হুমকি প্রদান করে। রাজু স্থানীয়ভাবে পেকুয়া উপজেলা এলাকায় একজন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার ভয়ে এলাকার কোনো লোক কথা বলার সাহস পায় না। তার সাথে লাগতে গেলে বাড়িঘর দখল করে বাড়ি ছাড়া করে দেয় এবং তার ভয়ে কেউ থানায় অভিযোগ পর্যন্ত করার সাহস পায় না।
উল্লেখ্য যে, আসামি রিয়াজ খান রাজু শুধু এসব ব্যক্তিদের সাথেই এরকম প্রতারণা করেননি। সে তার আশে-পাশের এলাকার আরও অনেক নিরীহ সাধারণ মানুষদের সাথে একই পন্থায় একইভাবে প্রতারণা করে আসছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের সওগাত
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতিবেশীর সৎকারে গিয়ে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু