মানবতাবাদী, শান্তি ও স্বাধীনতার বাতিঘর : মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী

অধ্যাপক ডা: প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া | সোমবার , ২৪ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ


ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টলার দুই কৃতি সন্তান শেখ ই চাটগাম মোহাম্মদ কাজেম আলী ও কমরেড মুজাফফর আহমেদ উভয়ের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধার সাথে উৎসর্গ করে ইতিহাসবেত্তা ডঃ সুনীতিভূষণ কানুনগো রচনা করেন একটি ঐতিহাসিক দলিল ‘‘মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ঃ জীবন ও কর্ম’’। বর্ণাঢ্য প্রতিভার স্বাক্ষর মওলানা ইসলামাবাদী একাধারে ইসলামি সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি, ধর্ম প্রচারক, শিক্ষার জাগরণে দূরদর্শী সংগঠক, সংবাদ মাধ্যমের পুরোধা, মুক্তমনা এবং উদারচিন্তার রাজনৈতিক ইসলামি চিন্তাবিদ। বীর প্রসবিনী চট্টলার প্রাণকেন্দ্রে জ্বলজ্বল করছে একটি কালজয়ী শিক্ষানিকেতন। কৈশোরে পিতৃ-মাতৃহীন হয়ে জীবন সংগ্রামে সমাজ দরদী ও নিবেদিত মহাপ্রাণ ছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা যা ‘চট্টগ্রাম শিশুসদন’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। যে বিষয়ে বঙ্গীয় আইন পরিষদে ১৯৩৩ সনে মুখ্য মন্ত্রীর নিকট জনৈক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।

তাঁর জন্মতীর্থ বিশাল বিপ্লবীদের কর্মকেন্দ্র ঐতিহ্যমন্ডিত পটিয়া থানায়। তাঁর আলোকিত পিতা মুন্সী মোহাম্মদ মতিউল্লাহ আরবী-ফার্সী ভাষায় দক্ষ, বিধায় জনপদে শিশুদের ইসলামি শাস্ত্রে শিক্ষাদানে নিভৃত ছিলেন। তাঁর জন্মস্থান বাইনজুরী খরস্রোতা শংখ নদী বিলুপ্ত করে ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। দেশপ্রিয় কলিকাতার সিটি কর্পোরেশনের পাঁচ পাঁচ বারের মেয়র যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত (১৮৭৫- ১৯৩২), জাতীয় অধ্যাপক, স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত ও মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ নুরুল ইসলাম, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, সাহিত্যিক আহমদ ছফা, কূটনীতিক কে.এম শিহাব উদ্দীনদের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখা ব্যক্তিত্বদের জন্ম-জনপদ চন্দনাইশ। প্রতিবেশী অগ্রজদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের ক্ষীণসুযোগে তিনি ১৪ বছর বয়সে হুগলী কলেজ ও মাদ্রাসা ইমামবাড়া, চন্দন নগর ও কলিকাতা মাদ্রাসায় পড়ার দুর্লভ সুযোগ অর্জন করেন। সম্ভবতঃ ১৮৮৫ খ্রিঃ জমাতে উলা বা টাইটেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

কর্মসাধনে শিক্ষকতা দায়িত্ব সানন্দে নিলেন। প্রথম রংপুর, সীতাকুন্ড মাদ্রাসার মোদারেস নিযুক্ত হন। জনগণের নৈকট্য স্থাপনে, ১৯০৩ সালে ‘‘ছোলতান’’ পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনা-ব্যবস্থাপনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আধুনিকতা, যুক্তিযুক্ত ও বিজ্ঞান সম্মত ইসলাম ধর্মের মূল আদর্শ প্রচার পত্রে আনজুমানে ওলেমায়ে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহ, অযথা বহু মামলা মোকদ্দমা পরিহার, ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রভৃতি। সংগঠনটির মুখপাত্র ‘‘আল-এছলাম’’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। জনদরদী ইসলামাবাদী জন্মলগ্ন থেকে কৃষক প্রজা সমিতিতে যোগ দেন। ১৯৩৭ সালের পর সভাপতির গুরুদায়িত্ব পালন করেন।

একই সময়ে রাঙ্গুনিয়ার জনসম্মুখে বলেন, কৃষকগণই দেশের মেরুদন্ড স্বরুপ। তাহারা বাঁচিয়া থাকিলে সকলেই বাঁচিবে, তাহারা সুখী হইলে সকলেই সুখী হইবে। ১৯৩৭ সনে মৌলানা সাহেব প্রাদেশিক পরিষদের কৃষক প্রজা সমিতির প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন। কংগ্রেস সমর্থকেরাও ইসলামাবাদীকে ভোট দেন। সৃজনশীল ও উদার চরিত্রের স্বদেশী মওলানা ইসলামাবাদী মহোদয় আল-এসলাম সহ সাপ্তাহিক সোলতান, দৈনিক সোলতান, দৈনিক আমীর পত্রিকার পরিচালনা ও সম্পাদনা কৃতিত্বের সাথে সুসম্পাদন করেছেন। নির্মম সত্য হলো, আত্মপ্রচার নয়, নিমগ্ন ছিলেন এক. ব্রিটিশ শাসনে পশ্চাদপদ মুসলমানদের জাতীয় চেতনা সঞ্চার ও নবজাগরণ ; দুই. সমাজ ও দেশ সেবার মাধ্যমে স্বাধীনতার বাণী প্রচার ও সংগ্রামে পরাধীনতার নাগপাশ মুক্তি প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। দরিদ্র ও অবহেলিতদের সদা অভিভাবক বা মুখপাত্র ছিলেন ইসলামাবাদী। রাজনীতির অংগনে তিনি অতিরিক্ত দলীয়করণ ও বিদ্বেষমূলক রাজনীতি বিরোধী, অথচ মানবতাবাদী, ঐক্য, সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি ও আর্থ সামাজিক উন্নয়ন সহ স্বাধীনতা সংগ্রামে অতন্দ্র প্রহরী ও বিপ্লবী ছিলেন। তিনি একারণেই মানবতাবাদী, ‘‘আল-এসলাম’’ পত্রিকায় ১৩২৫-২৬ সংখ্যায় সুস্পষ্ট বর্ণনা করেছেন, ‘‘মাতৃভাষার সাহায্যে দেশের বিভিন্ন সমপ্রদায়ের মধ্যে একতা, সমপ্রীতি ও ভ্রাতৃভাব বর্ধনের চেষ্টা করাই দেশবাসী ও সাহিত্য সেবক গণের প্রধান কর্তব্য’’।

উল্লেখ্য, ১৯২০ সালে খেলাফত কনফারেন্সে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ বিশিষ্ট জনদের সভায় উর্দুর পরিবর্তে বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদান করেন। অবিভক্ত ভারতে প্রাদেশিক আইন সভায় তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা ও বিতর্ক করেন। দূরদর্শী দেশপ্রেমিক মানবহিতৈষী বসিরহাটে সাহিত্য সম্মেলনে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক জেলায় বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির শাখা গঠন, তাতে পুস্তকালয় ও পাঠাগার স্থাপন আবশ্যক। জেলার ইতিহাস, প্রাচীন কীর্তির তত্ত্ব, ওলি ও সাহিত্যিক বর্গের জীবনী সংগ্রহ ফলপ্রদ হইবে। তাঁর দর্শন, মাতৃভাষা চর্চায় অনাগ্রহ মুসলিম সমাজের অনগ্রসরতার মূল কারণ। প্রায় শতবর্ষ পূর্বে তিনি আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক মাদ্রাসা শিক্ষার জাগরণে দূরদর্শি স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন। তাঁর লেখনী ‘‘মাদ্রাসার কোন উচ্চ লক্ষ্য নাই… … সকল মাদ্রাসার ছাত্র দিগকে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ভূগোল, ইতিহাস, আধুনিক দর্শন, বিজ্ঞান.. শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক। মাতৃভাষা বাংলার চর্চা করা আবশ্যক। অন্ততঃ একদল ছাত্রকে রাজভাষা ইংরেজি শিক্ষা দিবার বিশেষ প্রয়োজন আছে।’’ প্রায় শতবর্ষ আগে একজন দূরদর্শী শিক্ষাবিদ হিসাবে যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানমনষ্ক শিক্ষানীতির দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

তিনি আপাদমস্তক বাঙ্গালি ও মানবতাবাদী এবং দেশপ্রেমিক সাচ্চা মুসলমান। তিনি অকপটে ১৯৩০ সালে এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম যুব সম্মেলনে বলেছেন, ‘‘মন ও শরীর নিয়ে এই দুই বস্তু লইয়াই মানুষ। … … শরীরকে সবল ও স্বাস্থ্যবান রাখার জন্য শরীর চর্চা ও ব্যায়াম কৌশলই প্রধান অবলম্বন।… যুবকগণের প্রধান কর্তব্য শারীরিক উন্নতির জন্য স্থানে স্থানে আখ্‌রা স্থাপন, তাহাতে কুস্তি কছ্‌রতের সুব্যবস্থা, লাঠি খেলা, তরবারি ভাজা, ছোরা চালনা, বিন্নটের কৌশল, সন্তরণ… ধন রক্ষা, ধর্ম রক্ষা, দেশ রক্ষা সমস্তই শারীরিক স্বাস্থ্য ও শক্তির প্রতি নির্ভর করে। … … … আত্মরক্ষা, এছলাম রক্ষা, মোছলেম জাতির স্বার্থ সংরক্ষণকল্পে ব্যায়াম চর্চার জন্য এছলাম ধর্মে কঠোর বিধান আছে। প্রবন্ধকারের পক্ষে, বহুমাত্রিক প্রতিভাধর মওলানা ইসলামাবাদীর নৈতিকতা, নির্মোহ জীবনাচার, দেশপ্রেম, পুস্তক প্রণয়ন, শান্তির বারতা ইসলামের মর্ম বাণী প্রচার আজো তাৎপর্য পূর্ণ। জ্ঞান তাপস ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিরেট সত্য লিখেছেন, যখন মওলানা ইসলামাবাদী ও অন্যান্য সাহিত্যিকদের সমবেত চেষ্টায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠিত (১৯২১ সালে ৪ ঠা সেপ্টেম্বর) হয়। আমি ছিলাম তার প্রথম সম্পাদক।

…মওলানা সাহেব ছিলেন আলেম কিন্ত অন্ধ বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী, জ্ঞান বিজ্ঞানের পক্ষপাতী। তিনি ছিলেন সমাজসেবক ও সমাজের কর্মী। নানা অর্থকষ্ঠের মধ্যে ও তিনি সাহিত্য সাধনা ও সমাজ সেবা করে গিয়েছেন।’’ তদানীন্তন সমাজে বিদ্যমান অপসংস্কৃতি, কুপ্রথা, দুর্নীতি ও সুদের মহাজনী প্রভৃতি সমাজ সংস্কারে তাঁর স্বচ্ছ বক্তব্য, ‘‘বর্তমান যুগে মোছলমান যুবক সমিতি, খাদেমুল ইসলাম ও সেবক সমিতির যদি কোন বড় কর্তব্য থাকে তাহা হইল সমাজ সংস্কারে হস্তক্ষেপ করা। ‘‘দৈনিক ইষ্টার্ন এক্সামিনার’’ লিখেছেন, ‘‘মওলানা ইসলামাবাদী একজন দীপ্তিমান সমাজ সংস্কারে অগ্রপথিক ছিলেন’’।

আন্তঃ ধর্ম জানা-দেখার জন্য এবং ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি উঃ ও পূর্ব ভারত এবং মায়ানমার সফর করেছেন। মানুষ, মানুষের জীবন থেকে নেয়া সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জ উত্তরণে তিনি নিকটে অবস্থান করে বাস্তব সমাধানে নিরন্তর নিয়োজিত থেকেছেন। প্রয়াণোত্তর আনন্দ বাজার পত্রিকার মৃত্যু স্মৃতি সংবাদটি উল্লেখ্য, (২৭শে অক্টোবর, ১৯৫০ সাল) ‘‘ বিশিষ্ট কংগ্রেস ও খিলাফত নেতা মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী… দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের অন্তরঙ্গ সহকর্মী রুপে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯২০ সালে তিনি গান্ধীজি প্রবর্তিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন এবং জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত তিনি গান্ধীজীর নীতি ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ১৯০৭-৮ সালে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস গঠিত হলে মওলানা ইসলামাবাদী আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস সদস্য অন্তর্ভুক্ত হন।’’ জনগণ ও দেশকে ভালোবাসতে গিয়ে তিনি বিপ্লবী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সমর্থক এবং নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুরও সান্নিধ্যে আসেন। মহাপ্রয়াণ তিথিতে তাঁর কর্ম ও বরণীয় জীবন চিত্রিত করতে লেখক অপারগ। গভীর শ্রদ্ধা জানাই মহান মানবিক চট্টলবীরের প্রতি। তাঁকে নিয়ে আরো অর্থপূর্ণ গবেষণা ও পর্যালোচনা প্রয়োজন মনে করি। এতে বর্তমান প্রজন্ম ও আমরা সমাজকর্মীরা বরাবরই উপকৃত হবো, এই বিশ্বাস করি।

লেখক : প্রাক্তন উপাচার্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি)।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআস্থার সংকটে জাতিসংঘ
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল