মাতৃভাষা মহান আল্লাহর অপার দান। মায়ের ভাষার কথা বলা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এ ভাষা দিয়ে মানুষ নিজের মনের ভাষা প্রকাশ করে। তাই ইসলাম মায়ের প্রতি যেমন অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিয়েছে তেমনি মাতৃভাষার প্রতিও অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। মায়ের সঙ্গে যেমন সন্তানের সম্পর্ক গভীর, মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও তেমনি গভীর। সন্তান জন্মের পর যখন কথা বলতে শেখে তখন সে তার মায়ের ভাষাতেই কথা বলে এটা তার স্বভাবগত ও জন্মগত চাহিদা। ইসলাম মানুষের এ চাহিদার যথেষ্ট মূল্যায়ন করেছে। প্রত্যেক জাতির কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছানোর জন্য এই জগতেধারাবাহিক ভাবে নবি ও রসুল এসেছেন। ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। এ মাস আমাদেরকে মাতৃভাষা ও ভাষার জন্য জীবনদানকারী বীর শহীদদের স্মরণ করিয়ে দেয়। যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি নিজেদের ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা তাদের প্রতি রয়েছে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তারা কিয়ামাত পর্যন্ত আমাদের নিকট অমর হয়ে থাকবে। প্রতিদান দিবসে তাঁরা আল্লাহর নিকট পাবেন উত্তম প্রতিদান। জগতের সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি ও অকৃপণ দান। ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘আশরাফুল মখলুকাত’ হলো মানুষ। মানুষ ভাষা দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে এবং একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। মানুষের পরিচয় বা সংজ্ঞায় আরবিতে বলা হয় ‘হায়ওয়ানুন নাতিক’ অর্থাৎ ‘বাক্শক্তিসম্পন্ন প্রাণী’।
ভাষা আল্লাহতাআলার দান এবং সেরা নেয়ামত ; ভাষা মনুষ্য পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায় ; কারণ সব ভাষাই আল্লাহর দান ও তাঁর কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতাআলা বলেছেন তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে ও পৃথিবীতে সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে। মাতৃভাষার মর্যাদা ইসলামে স্বীকৃত। নিজের মায়ের মুখ থেকে শেখা ভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা স্বভাবজাত। ইসলামে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার অনুপ্রেরণার কথা এসেছে। মহানবী (সা.) এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। বায়হাকি শরিফের এক হাদিসে তাঁর আরবি প্রীতির বিরল নজির পাওয়া যায়। তিনি বলেন তোমরা তিন কারণে আরবদের ভালোবাসবে। প্রথমত, আমি আরবীয়, দ্বিতীয়ত, পবিত্র কোরআনের ভাষা আরবি এবং তৃতীয়ত, জান্নাতবাসীদেরও ভাষা হবে আরবি। রাসুল (সা.) এর উল্লিখিত বাণীর পরিপ্রেক্ষিতে মাতৃভাষার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃ প্রকাশ ঘটেছে।
মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি এই তিনটি শব্দ সব মানুষের কাছে পরম আবেগের। মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। দুনিয়ার সব দেশের নিজ নিজ ভাষা রয়েছে। এ ভাষা তাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা এবং জীবনযাপনের ভাষা। মায়ের কাছ থেকে এ ভাষা শেখে বিধায় এর নাম হয়েছে মাতৃভাষা। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার দীপ্ত শপথ নিয়ে বাংলার কিছু অকুতোভয় বীর সন্তান নিজেদের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করে এক সূর্যস্নাত রক্তিম ইতিহাস। যা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে আরো গভীরে নিয়ে গেছে। অথচ এখানে একটি প্রশ্ন প্রায়ই অনেকের মনে দোলা দেয় ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে ইসলামের ভূমিকা কী ? এ নিয়ে আলোচনার অবতারণা। মানুষ জন্মের পর থেকে যে ভাষায় কথা বলে বড় হয়ে ওঠে সেটাই তার মাতৃভাষা। এই ভাষায় কথা বলার অধিকার তার জন্মগত অধিকার এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এর সঙ্গে সে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হয়ে যায়। তাই ইসলাম মানুষের ভাষাকে বিভিন্নভাবে মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা মানুষের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তার প্রেরিত প্রত্যেক নবী–রাসুলকে স্বজাতির ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন এবং এ ভাষাতেই কিতাবাদি নাজিল করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন আমি প্রত্যেক রাসুলকে তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।
ইসলাম মাতৃভাষা নিয়ে গর্ব করাকে অন্যায়, অন্যায্য ও অবৈধ কিছু মনে করে না। বরং হাদিসে বর্ণিত আছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়ের ভাষা আরবিতে কথা বলতে গর্ববোধ করতেন। তার মাতৃভাষা ছিল আরবি। এ কারণেই শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওপর শেষ কিতাব কোরআনে কারিম নাজিল হয়েছে আরবি ভাষায়। তিনি বলতেন আরবদের মধ্যে আমার ভাষা সর্বাধিক সুফলিত। তোমাদের চাইতেও আমার ভাষা অধিকতর মার্জিত ও সুফলিত। কারণ সব ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহর সৃষ্টিকে তাচ্ছিল্য করার অধিকার কারো নেই। জগতের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ, মাতৃভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। বস্তুত ভাষার ব্যবহার মুখে বলা বা কলমে লেখা দুভাবে হয়ে থাকে। মাতৃভাষা সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এক অসাধারণ নিয়ামত। মানবজাতি দুভাবেই ভাষা প্রয়োগের ক্ষমতা পেয়েছে। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। আর এ ক্ষমতাই মানুষকে অন্যসব প্রাণী থেকে পৃথক ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। আল্লাহতায়ালার সব নিয়ামতের সঙ্গে মাতৃভাষার কদর করার কথা বলেছেন। পৃথিবীর বৈচিত্র আল্লাহতায়ালার অসীম কুদরতের নিদর্শন। পৃথিবীর মানুষ প্রকৃতি ও অন্য সব সৃষ্টির বৈচিত্রের মতো মানুষের ভাষার বৈচিত্র অন্যতম নিদর্শন। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে প্রায় ছয় হাজারের অধিক ভাষা রয়েছে।
পৃথিবীর প্রত্যেক জনপদে সব জাতির নিজস্ব ভাষা রয়েছে যা তাদের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা এবং প্রাত্যহিক মনের অব্যক্ত বিষয়গুলো প্রকাশের ভাষা। মমতাময়ী মায়ের কাছ থেকে প্রথম সে ভাষা শেখে বলে তার নামকরণ করা হয়েছে মাতৃভাষা। বর্তমানে বিশ্বে প্রচলিত ছয় সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে এক এক জনপদের লোকেরা তাদের সেই প্রিয় মাতৃভাষায় কথা বলে থাকেন। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশ ও অঞ্চলকে। তুরস্ক, বুলগেরিয়া, মধ্য এশিয়ার অঞ্চলগুলো এবং ভারতের উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানব জাতির মধ্যে ভাষাগত যে বিভিন্নরূপ তা মহান রবের অশেষ রহমতের অপরূপ সৌন্দর্য মন্ডিত এক বাগানসদৃশ। আর আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা সেই রহমতেরই একটি ফুল। তবে আমাদের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় শুধু আন্দোলন সংগ্রামই নয় জীবনও দিতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে রচিত হয়েছে অমর এক শোকগাথা ; যেখানে শাহাদতের সুধা পান করতে হয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেককেই। বাংলার দামাল ছেলেরা সেদিন বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মায়ের ভাষাকে মুক্ত করেছিলেন বলেই আজ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের উচিত ভাষা শহিদদের জন্য দোয়া করা এবং বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চা করা বাংলাকে সব বিকৃতি থেকে রক্ষা করা। আমাদের মাতৃভাষা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ও সম্মানিত একটি ভাষা যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর ঘোষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ থেকে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
মাতৃভাষার বিশুদ্ধ চর্চা ও প্রয়োগে সচেষ্ট হই এবং বিশাল এ নিয়ামতের জন্য মহান আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করি। সেই সঙ্গে যারা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে শাহাদাৎবরণ করেছেন তাদের রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করি। মহানআল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের মাতৃভাষা বাংলাভাষাকে কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী রাখুন এবং কিয়ামত পর্যন্ত উত্তরোত্তর এর শ্রীবৃদ্ধি সাধন করুন। আমাদেরকে সকল ভাষা শহীদের মর্যাদা রক্ষা ও কল্যাণ কামনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট