মাতারবাড়ি চ্যানেল ঝুঁকিমুক্ত করতে বিপিসির নতুন ব্যয় ৩৬০ কোটি টাকা

জাহাজ চলাচলে সমুদ্রতটের ৩০ ফুট গভীরে বসানো হচ্ছে পাইপলাইন

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

মাতারবাড়ি চ্যানেলকে ঝুঁকিমুক্ত করতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) নেয়া সাগরের তলদেশে জ্বালানি তেলের পাইপলাইন (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং- এসপিএম) প্রকল্পে নতুন করে ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর ও কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জাহাজ যাতায়াতের সুবিধার্থে প্রকল্পের প্রায় দেড় কিলোমিটার পাইপলাইন সমুদ্রতটের ৩০ ফুট গভীরে স্থাপন কাজে এ ব্যয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এতে পুরো প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এদিকে ২৯ ডিসেম্বর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে মাতারবাড়ি বন্দরে প্রথমবারের মতো ভিড়েছে বাণিজ্যিক জাহাজ ‘ভেনাস ট্রায়াম্প’। বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে ইআরএল’র মাধ্যমে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিপিসি। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে সময়ক্ষেপণে ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপ লাইন’ প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কয়েকবার সংশোধিত হয়ে ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ২৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকার প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। প্রশাসনিক অনুমোদনের পর ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিপিপিইসিএল) সাথে চুক্তি করে বিপিসি। প্রায় দেড় বছর পর ২০১৮ সালের ১৪ মে থেকে চুক্তিটি কার্যকর হয়। সর্বশেষ গত ৬ জুলাই আরো এক দফায় সংশোধিত হয়ে ১ হাজার ১৪২ কোটি টাকা বেড়ে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ৬ হাজার ৫৬৮ কোটি ২৬ লাখ টাকায়। ২০২২ সালের ৩০ জুন প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বিপিসির বছরে অন্তত আটশ কোটি টাকার খরচ সাশ্রয় হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের এসপিএম নির্মাণের পাশাপাশি প্রকল্পটির আওতায় মহেশখালীর মাতারবাড়ি উপকূলে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ক্রুড অয়েল স্টোরেজ ট্যাংক এবং ৩০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ডিজেল স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণ করা হচ্ছে। মহেশখালীতে তৈরি করা হচ্ছে পাম্প স্টেশন, স্কাডা সিস্টেম এবং ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম। ইতোমধ্যে প্রকল্পের মূলকাজের অংশ হিসেবে অফশোরে সমুদ্রের তলদেশে ১৪৬ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন শেষ হয়েছে। অনশোরে ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন কাজও নানা জটিলতার কারণে এখনো শেষ হয়নি।
এদিকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর ও মহেশখালী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য স্টিলের বিম, কলাম, গার্ডার, টাওয়ারসহ বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে মাতারবাড়িতে ভিড়েছে পানামার পতাকাবাহী জাহাজ ভেনাস ট্রায়াম্প। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার এবং ড্রাফট (গভীরতা) পাঁচ দশমিক তিন মিটার। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর আমদানিকৃত কয়লা নিয়ে বিদেশী জাহাজ নিয়মিত আসা যাওয়া করবে মাতারবাড়িতে। অন্যদিকে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হলে আরো অধিক গভীরতার জাহাজ যাতায়াত করবে। যেকারণে চলমান এসপিএম প্রকল্পে সমুদ্রের তলদেশে স্থাপিত পাইপলাইনকে সমুদ্রতটের ৯ মিটার গভীরে স্থাপনের কাজ শুরু করেছে বিপিসি। এজন্য ব্যয় বাড়েেছ ৪৩ মিলিয়ন ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় ৩৬০ কোটি টাকার বেশি। ইতোমধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বর্ধিত ব্যয়ের বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে। প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদারের সাথেও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে বিপিসি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসপিএম প্রকল্পটি অনুমোদন হয় ২০১৫ সালে। কিন্তু মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। যে কারণে এসপিএম প্রকল্প নেওয়ার সময় জাহাজ যাতায়াতের বিষয়টি প্রস্তাবনায় ছিল না।
জানা যায়, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) বর্তমানে ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল) পরিশোধন ক্ষমতা বার্ষিক ১৫ লাখ মেট্রিক টন। ইআরএল ইউনিট-টু প্রকল্প চালু হলে ইআরএলের ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা প্রতি বছর ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে। অন্যদিকে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য বছরে ৫০ লাখ মেট্রিকটন এইচএসডি (ডিজেল) আমদানি করে বিপিসি। বঙ্গোপসাগরের কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্যতা ৮ মিটার থেকে ১৪ মিটারের নীচে হওয়াতে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে ক্রুড অয়েলবাহী বড় ভ্যাসেল হ্যান্ডেল করতে পারে না চট্টগ্রাম বন্দর। যে কারণে ক্রুড অয়েলবাহী মাদার (বড়) ভ্যাসেলগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করা হয়। মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ করে ক্রুড আনলোডিং করা হয়। লাইটারেজ অপারেশনের মাধ্যমে ক্রুড আনলোড করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। আমদানিকৃত জ্বালানি খালাসে ব্যয় ও সময় বাঁচানোর পাশাপাশি নিরাপত্তা বাড়াতে এসপিএমসহ পাইপ লাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত বুধবার সন্ধ্যায় আলাপকালে দৈনিক আজাদীকে বলেন, এসপিএম প্রকল্পটি যখন নেওয়া হয় তখন গভীর সমুদ্র বন্দর ও কোল পাওয়ার প্লান্টের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। যে কারণে বড় বড় জাহাজ যাতায়াতের বিষয়টি মাথায় ছিল না। এসপিএম এর দুইপাশে কুতুবদিয়া চ্যানেল ও মাতারবাড়ি চ্যানেল। মাতারবাড়ি চ্যালেনের নিচ দিয়ে এসপিএম প্রকল্পের পাইপলাইন গিয়েছে। বর্তমানে সমুদ্রতটের ৬-৭ ফুট গভীরে রয়েছে পাইপলাইনটি। এখন বড় বড় জাহাজ নিয়মিত যাতায়াত করলে ভবিষ্যতে চ্যানেল খনন করারও প্রয়োজন হতে পারে। এতে পাইপলাইনে আঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে। মাতারবাড়ি চ্যানেলটি ঝুঁকিমুক্ত ও পাইপলাইনটিতে নিরাপদ করতে প্রায় দেড় কিলোমিটার পাইপলাইন সমুদ্রতটের ৯মিটার (প্রায় ৩০ ফুট) গভীরে বসানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, সাগরের তলে পাইপলাইন বসানোর কাজ করেছে বিশেষায়িত কার্গো বার্জ ‘হাইলং ১০৬’। অন্যদিকে এসব পাইপলাইনকে সমুদ্রের তলদেশের ৬-৭ ফুট গভীরে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজটি করেছে আরেক কার্গো বার্জ ‘রেজিলিয়্যান্ট’। এখন পাইপলাইনটিতে ৩০ ফুট গভীরে নেওয়ার কাজটিও করবে রেজিলিয়্যান্ট। যেহেতু কোল পাওয়ার প্লান্টের জন্য প্রথমবারের মতো জাহাজ এসেছে। এতে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পিডিবির সাথে সমন্বয় করে কাজটি করতে হচ্ছে। বৃহস্পতিবারও এ নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক রয়েছে বলে তিনি জানান।
এ ব্যাপারে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান সোমবার বিকেলে বিপিসি কার্যালয়ে দৈনিক আজাদীকে বলেন, এসপিএম প্রকল্পটিতে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এখন মাতারবাড়ি চ্যানেলে বসানো পাইপলাইন ৯ মিটার গভীরে বসানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ৪৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। যেকোন সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি হতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে করোনা কেড়ে নিয়েছে ১৩ চিকিৎসক ও ১০ পুলিশের প্রাণ
পরবর্তী নিবন্ধনতুন বছরে সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ১৮ জানুয়ারি