মাটি : খাদ্যের সূচনা যেখানে

ড. মো. আবুল কাসেম | রবিবার , ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

মৃত্তিকা একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। মৃত্তিকা ছাড়া মানুষের জীবন কল্পনা করা যায় না। যেখানে মাটি আছে, সেখানে জীবন আছে, সভ্যতা আছে, জীবনের কোলাহল, আনন্দ-উল্লাস আছে। যেখানে মাটি নেই সেখানে কিছুই নেই। মৃত্তিকা স্রষ্টার এক অমূল্য সৃষ্টি। পৃথিবীর অনেক দেশে ভূমি আছে কিন্তু কোন মাটি নেই, তাই সেখানে কোনও প্রাণীর অস্তিত্বও নেই।

মাটি মৃত এবং জীবিত উভয় অবস্থায়ই থাকতে পারে। মরুভূমির মাটিতে তুলনামূলকভাবে পানি ও জৈব পদার্থ কম থাকায় মৃত ধরা হয়। তাছাড়া, অনেকদিন বৃষ্টি না হলে অতিরিক্ত রোদে বা ইটের জন্য পোড়ালে, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও পেস্টিসাইড ব্যবহারে, লবণাক্ততায়, অতিমাত্রায় ভারী ধাতুর উপস্থিতিতে মাটি তার সক্রিয় গুণাগুণ হারিয়ে মরুভূমির মাটির মতো হয়ে যেতে পারে। মাটিতে বসবাসকারী অনুজীবগুলো নিষ্ক্রিয় বা মরে যেতে পারে যাদের ভূমিকা অপরিসীম।

গণনা করে দেখা যায় যে, এক টেবিল চামচ জীবিত বা আদর্শ মাটিতে পৃথিবীর লোক সংখ্যার চেয়েও বেশি অনুজীব বসবাস করে, যারা মাটিতে উদ্ভিদের খাবারকে সহজলভ্য করে তোলে। অনুজীবগুলো পানি ও জৈব পদার্থের উপস্থিতি ছাড়া বাঁচতে পারে না। যাদের উপস্থিতি মাটিতে না থাকলে শুধু গাছ নয়, কয়েক দিনের মধ্যে সারা পৃথিবী অচল হয়ে যেতে পারে।

তারা পচনশীল শাকসবজিকে ৫ থেকে ৩০ দিন; মৃত পশু বা প্রাণীর দেহকে কে ১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে অপচনশীল দ্রব্য যেমন দৈনন্দিন ব্যবহারের প্লাস্টিক ব্যাগ ১০ থেকে ২০ বছর, প্লাস্টিক বোতল ৪০০ বছর এবং গ্লাস ৪০০০ বছর পর্যন্ত মাটিতে অবস্থান করে মাটির গুনাগুন নষ্ট করে দেয়।

উল্লেখ্য যে, এই ক্ষুদ্র অনুজীবগুলো পৃথিবীতে অবস্থানরত সব পচনশীল বস্তুকে মাটির সাথে মিশিয়ে একদিকে পরিবেশকে রক্ষা করে অন্যদিকে মাটিকেও পবিত্র করে তুলে যা দিয়ে তায়াম্মুম করে (সূরা আল মায়েদা ৬) নামাজ পড়ারও বিধান রয়েছে তাছাড়া এই অনুজীবগুলো আল্লাহ তাআলার অনুগত এবং আল্লাহতালাকে সেজদা করে (সূরা সাজদা ১৫)।

বিভিন্ন কারণে মাটি মৃত অবস্থায় থাকে বলেই আল্লাহ তায়ালা (সুরা বাকারা ১৬৪; ইয়াসিন ৩৩; আরাফ ৫৭) ও উল্লেখ করেছেন, আমি পরিমাণ মতো বৃষ্টির পানি দিয়ে মৃত ভূমিকে জীবিত করি এবং তা থেকে ফসল বাহির করে আনি। বৃষ্টি হওয়ার পরে আমাদের কৃষকরাও বলে মাটিতে জো এসেছে, বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হয়েছে।

মৃত্তিকাকে গুরুত্ব দিতে সারা পৃথিবীতে ৫ই ডিসেম্বর এ দিবস টি পালিত হয়। বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের স্লোগান এর সাথে আমার আব্বার কৃষি কাজের মিল খুঁজে পাই।
আমি একজন কৃষকের ছেলে, ছোটবেলায় আমার আব্বার সাথে জমিতে কাজ করতাম। আমার আব্বাকে দেখেছি।

১। প্রতিবছর জমিতে গোবর ও ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে দিতেন এবং রাসায়নিক সার কম ব্যবহার করতেন।
২। প্রয়োজনে রাসায়নিক সার বিকেল বেলায় প্রয়োগ করতেন এবং সাথে সাথে পানি ছিটিয়ে দিতেন।
মৃত্তিকা বিজ্ঞানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করার পর বুঝলাম আমার আব্বা ঠিক কাজটিই করে গেছেন।

বর্তমানে, বাংলাদেশে লোক সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সেই একই হারে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। সেজন্যই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জমিকে চাষের আওতায় আনার নির্দেশনা দিয়েছেন।

আসলে, প্রতিনিয়তই আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য মৃত্তিকার সঠিক যত্ন নেওয়া ও পরিচর্যা করা উচিত। যেমন:

১। মাটির চারটি উপাদানের (প্রায় খনিজ -৪৫, পানি-২৫, বায়ু-২৫ ও জৈব পদার্থ-৫%) মধ্যে বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১% নিচে। মাটিকে সুস্থ রাখতে জৈব পদার্থের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। বহুতল ভবন, কাঁচা বাজার ও বিভিন্ন জায়গা থেকেও সংগ্রহ করে অব্যবহারিত শাকসবজি জমিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

২। জৈব স্যারের বা জৈব পদার্থের ব্যবহার বাড়িয়ে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও পেস্টিসাইড এর ব্যবহার কমাতে হবে।
৩। দ্রুত সেটেলমেন্ট এক্ট বাস্তবায়ন করে যেখানে সেখানে বাড়ি ঘর তৈরি বন্ধ করতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে আমাদের কৃষি জমি বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

৪। সুষম সার প্রয়োগে বা গবেষণার প্রয়োজনে মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে মৃত্তিকার সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
৫। পাহাড় কাটা রোধ ও উপরের স্তরের (০ – ৯ ইঞ্চি) মাটি সংরক্ষণের জন্যে এই স্তরের মাটি বিক্রয় বা সরানোর ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করতে হবে। কৃষি ক্ষেত্রে মাটি বলতে উপরের স্তরের মাটিকেই বুঝায়। সমতল ভূমিতে এক ইঞ্চি মাটি তৈরি হতে কমপক্ষে ৫০০ থেকে ১০০০ বছর সময় লাগে। কাজেই উপরের স্তরের মাটির দূরত্ব অপরিসীম।

৬। গাছ রোপনে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে একটি বয়স্ক বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে এবং দশটি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। গ্রীষ্মের দুপুরে একটি বড় গাছ কমপক্ষে ১০০ গেলন পানি বাতাসে নির্গত করে পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখে। বৃক্ষ শব্দ দূষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং সাথে সাথে তারাও আল্লাহ তাআলাকে সেজদা করে (সূরা আর রহমান ৬)।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও পরিবেশের বিপর্যয় থেকে দেশকে বাঁচানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য একটি ফলদ, একটি বনজ ও একটি ভেষজ গাছ রোপনের জন্য আহ্‌বান জানিয়েছেন।

আসুন আমরা সবাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মাটিকে সুস্থ রাখার অঙ্গীকার করি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাকে গড়ে তুলি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, প্রফেসর, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রতিষ্ঠা-আন্দোলনের’ একটি অজানা অধ্যায়
পরবর্তী নিবন্ধব্যাগে করে আনছিল তিন কোটি টাকার ইয়াবা