সুফি পরিমণ্ডলে, মরমী জীবন চেতনায়, মাইজভাণ্ডারী আধ্যাত্ম জগতালোকে একটি শব্দ ও একটি বাক্য পরম দয়ালু ‘আল্লাহ্্’ ও তাঁর অস্তিত্ব – একত্ব ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বাক্য প্রতিটি ক্বলবে প্রতি মুহূর্তে নিত্য জাগরণে জাগরিত থাকে সুর বাণীতে যা অত্যন্ত সার্থকভাবে প্রস্ফূটিত– মাইজভাণ্ডারী দর্শনের সফল আদি রচয়িতার অন্যতম সৈয়দ আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরীর জনপ্রিয় কালাম তথা গানে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ.)-এর পবিত্র আওলাদে পাক হযরত ইমাম জয়নুল আবেদিনের বংশীয় হযরত সৈয়দ বোরহান উদ্দিন (রহ.) ইসলাম প্রচার ও হেদায়তি কাজে সুদূর আরব দেশ থেকে বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ শেষে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ফটিকছড়ির ধুরুং অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। তাঁরই সুযোগ্য পৌত্র হযরত সৈয়দ আবদুল ওহাব স্থানীয় জমিদার বোচা উকিল প্রতিষ্ঠিত কাঞ্চনপুর জামে মসজিদে ইমামতির কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সেখানেই বসতি স্থাপন করেন এবং তাঁর ঔরশে জন্মগ্রহণকারী চার পুত্রের দ্বিতীয় জন হযরত সৈয়দ আবদুল গনি কাঞ্চনপুরী। আনুমানিক ১৮৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করা তাঁর দ্বিতীয় পুত্র কলিকাতার মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে মুফ্িত, মোফাস্্সরি ও মোহাদ্দিস সনদ লাভ করে নিজ গ্রামে যে মসজিদে পিতা দীর্ঘদিন ইমামতি করাকালীন ইন্তেকাল করেন, সে মসজিদে ইমাম হিসাবে যোগদান করেন।
প্রথম জীবনে মাইজভাণ্ডার বিরোধী এ আলেম তাঁর ছোটভাই হযরত সৈয়দ আবদুল হাদী (রহ.) কাঞ্চনপুরীর দরবারী প্রাখর্য, ত্বরিকার মাহাত্ম্যে ইসলামের স্বরূপ ও অনুশীলিত আত্মিক রূপমাধুর্যে নিজের ভুল শুধরে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর সোহবত ও তাছার্রোপাতে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত মানুষ হয়ে ইনসানে কামেলে রূপান্তরিত হন এবং মাইজভাণ্ডারী আধ্যাত্মিক শক্তি তাঁকে পূর্ণতা দান করে। আর সে শক্তিবলে মাইজভাণ্ডারী সাহিত্যাঙ্গণের প্রাথমিক লগ্নে পয়ার ছন্দে লিখিত আন্তপাঠ, আন্ত পরিচয় ও মুর্শিদ চরণে নিবেদিত গোলসানে ওস্সাক, প্রেমদর্পণ ও সর্বোপরি তাঁর লিখিত ‘আয়নায়ে বারী’ মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকার সাহিত্যপত্রের অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ।
প্রায় ৭২০ পৃষ্ঠার এ মৌলিক গ্রন্থটি স্বীয় মুর্শিদ হুজুর গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (ক.)র শান ও আজমত প্রচারের লক্ষ্যে আপন মুর্শিদের অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে তিনি রচনা করেন। তিনি এ গ্রন্থে কোরআন হাদিস ইজমা কিয়াসের ভিত্তিতে ত্বরিকতের তত্ত্বসমূহের আলোকে স্বীয় মুর্শিদের দর্শন ও অবস্থানকে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। কাব্যিক ধায়ায় আরবি, ফারসি, উর্দু–হিন্দি ভাষার সংমিশ্রণে লিখা এ গ্রন্থে তাসাওউফ ধারার ওয়াহদাতুল ওজুদ বিষয়কে স্পষ্ট করা হয়েছে। উপমা ও কাব্য রসে পরিপূর্ণ এ পুস্তকের মূল উপজীব্য মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকার প্রতিষ্ঠাতা– গাউসুল আযম হযরত শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারী (ক.)। ‘আয়নায়ে বারী‘ কিতাবে তিনি গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (ক.)’র তাসাওউফ এবং বেলায়তের স্বরূপ উপস্থাপনের মাধ্যমে দর্শনকে বিধৃত করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর এ ব্যাতিক্রমী সৃষ্টিশীলতা মুর্শিদ চরণের নিবেদিত চিত্ততা, আত্মিক অবস্থান– গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (ক.)’র খলিফা হওয়ার যোগ্যতা এনে দেয়।
আবদুল গণি কাঞ্চনপুরীর লিখা প্রথম গ্রন্থ ‘প্রেম দর্পণ’–এ ৩৪টি কালাম বা গজল স্থান পেয়েছে যা উর্দু, হিন্দি, ফারসি ও আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত। যার প্রথম সংস্করণ ১৩২২ বাংলা ও দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৩৩ বাংলায় প্রকাশিত। তাই এ গানগুলো দরবারী ভক্তদের বেশি প্রভাবিত করতে না পারলেও ১৩২৮ বাংলায় প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘প্রেম দর্পণ’ প্রথম খণ্ডে ৭৪টি দ্বিতীয় খণ্ডে ৪৬টি মোট ১২০টি গান বা কালাম সন্নিবেশিত যার দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণ ১৩৩৩ ও ১৪০২ বাংলায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু দেখা যায় তাঁর প্রথম খণ্ডের গান বা কালামগুলোতে যে মেজাজ পরিলক্ষিত সে মেজাজ বা আবেগ গানগুলোকে হৃদয়গ্রাহী করে মুর্শিদের চরণে নিবেদিত চিত্ততার প্রতিভাস বা স্রষ্টা প্রেমের উদ্ভাস ও প্রথম খণ্ডে অধিক বাঙময়তা পেয়েছে। যেমন আল্লাহর ভাবে নিজেকে নিবেদনের শর্তে মনপ্রাণ দিল একাত্ম্য করে আল্লাহতে নিজেকে সঁপে দেবার প্রধান শর্তের একটি জিকির, তারই প্রতিভাস এ সমস্ত কালামে বাঙময়তা পায়,
“প্রতি বাদ্যে বাজেরে মন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ মন কর্ণ ধৈরে শোন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্।”
বা, “মন আমার আল্লাহ্ বলরে দম কলেতে দম ফুঁকি আল্লাহ্ বলরে”
বা, “আসমান জমিন শানে, গোপ্তে ব্যক্তে প্রতি কাজে অহরহ ঢংকা বাজে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্।”
নাসার বিজ্ঞানীরা মহাকাশে প্রদক্ষিণকালে একটি নির্দিষ্ট সুরধ্বনি শুনেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন যা সৃষ্টির সমস্ত কিছুতে যেন বিদ্যমান। তাই মনে হয় সৃষ্টির সমস্ত কিছুতে সেই ধ্বনি প্রলম্বিত –নদীর বাতাসে, সাগরের সোঁ সোঁ রবে, পাথরের গম্ভীর ধ্বনিতে, পাখির কলতানে, কোথায় নয় আল্লাহর সৃষ্টির সর্বত্র যেন চলছে সুর লয়।
আল্লাহ্ নিজে প্রকাশিত হতে চেয়েছিলেন বলে তাঁর হাবীবকে সৃষ্টি করে তাঁর ঐশী নূরের মধ্য থেকে সমস্ত সৃষ্টি আসমান, জমিন, লৌহ, কলম, জ্বিন, ইনসান, আকাশ–বাতাস, চন্দ্র–সূর্য–গ্রহ–তারা সমস্ত সৃষ্টি তাই আবদুল গনি কাঞ্চনপুরী বলেন–
“আহমদ মোহাম্মদ নামে মন প্রাণ মধুময় / গাউসে আযম মাইজভাণ্ডারী সেই মধুর ভাণ্ড হয়।”
কুরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা দেখি আল্লাহর হাবীবের সুপারিশ আল্লাহ্ গ্রহণ করে তাঁর পাপী বান্দাদেরও তিনি নাজাত দেবেন, যদি তাঁর হাবীবের সুপারিশ বান্দা পেয়ে যায়। আর আবদুল গনি কাঞ্চনপুরী গানের প্রতিপাদ্যে আমরা দেখি সেই সুপারিশের মূলদ্বার– তাঁর মুর্শিদ গাউসে মাইজভাণ্ডারীর নির্দেশিত পথের দিশা যে পথে সুপারিশ আসবে, আল্লাহ্ মুক্তি দেবেন তার বান্দাকে।
তাই গাউসে ধনের প্রেম সাগরে ঈমান রূপী রত্নের তালাশে আসার আবেদনে তিনি লিখেন– “গাউসে ধনের প্রেম সাগরে ঈমান রত্ন ভেসে যায় / ধনি হইতে সাধ থাকে যার হঠাৎ করে নিতে আয়।”
মুর্শিদকে পাবার আর্তি মুর্শিদ চেনার মাধ্যমে প্রকাশিত-“গাউসে ধনের মর্মভবে সত্য মতে কেবা জানে শরিয়তে বন্দা দেখি, হাকিকতে খোদা জানে”।
দরবারী পরিমন্ডলে আবদুল গণি কাঞ্চনপুরীর কালাম সমূহ সেমা মাহফিলে বিশেষভাবে গীত হয়–
“ছল করনা আর গুরুজি ছল করনা আর তোমারে না পাইলে আমার জীবন অসার”।।
বা, “বন্ধু তোমায় পাই যদি আর কি চাহি দো জাহানে তুমি বিনে আর কামনা, কিছু নাই আমার মনে”।।
বা, “কেমনে ভুলি তাহারে শয়নে স্বপ্নেতে দেখি যাহারে”।।
বা, “বন্ধু তোমায় প্রেম করিতে কে বৈলাছে প্রেম করিয়া ভুলিয়া যাওয়া কে শিখাইছে”।
গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর অধ্যাত্ম শক্তিরূপে এল্মে লুদুনীর প্রভাবপুষ্ট আবদুল গণি কাঞ্চনপুরী মাইজভাণ্ডারী সাহিত্য প্রতিষ্ঠাকালীন কাছাকাছি সময়ের সাহিত্যাকাশের একজন অন্যতম পথিকৃৎ পুরুষ যাঁর সাহিত্য, গীতিকবিতা অধ্যাত্মগান পরবর্তী সময়ের লেখকদের উদ্বুদ্ধ, সম্পৃক্ত করেছেন উপমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
জনশ্রুতি আছে, সে সময় মাইজভাণ্ডার বিরোধী মানুষের সাথে মসজিদে বিরোধ সৃষ্টির কারণে উক্ত মসজিদের ইমামতি ছেড়ে এক জোড়া খরম পায়ে পুকুরের পানির উপর দিয়ে হেঁটে তিনি ওপারে চলে যান এবং পরবর্তীকালে ‘অলির মা‘র মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হয়ে ২৪/২৫ বছর পর ১৯২৭ সালে ইন্তিকাল করেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কবি ও গবেষক