মশক নিধনে ‘কার্যকর’ ওষুধের সংকট

না কিনে পরীক্ষায়-নিরীক্ষায় সময়ক্ষেপণ চসিকের ।। ব্যবহার বন্ধ হয়নি আগের মেয়রের আমলে কেনা 'অকার্যকর' কীটনাশক

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৫ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

মশক নিধনে ‘কার্যকর’ কীটনাশক সংগ্রহে গত নয় মাসে তিন দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। তবে এ সময়ে কোনো কীটনাশক সংগ্রহ করে নি সংস্থাটি। ফলে বর্তমানে কীটনাশকের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য মাঝখানে পরীক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য দুই ধরনের ১১শ লিটার এডাল্টিসাইট (পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসকারী) কীটনাশক সংগ্রহ করেছিল। নিয়মিত ব্যবহার করলে তা এতদিনে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। এ অবস্থায় নগরে মশার উপদ্রব বাড়লেও কীটনাশক সংকট থাকায় জোরালো হচ্ছে না মশক নিধন কার্যক্রম।
চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে লিকুইড এডাল্টিসাইট (ল্যামডাসাইহ্যালোথিন ও ডেল্টামেথ্রিন) পিএইচপি ৬৯৯ এবং ‘এম ফস ২০ ইসি (ক্লোরপাইরিফস) নামে লার্ভিসাইড মজুদ আছে। যা কেনা হয়েছিল সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদকালে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় ওষুধ দুটি ‘অকার্যকর’ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও কীটনাশক দুটির ব্যবহার বন্ধ করেনি চসিক। এদিকে মশক নিধনে গত আগস্ট মাসে প্রণীত ‘জাতীয় গাইড লাইনে’ চসিকের জন্য ৩৪টি করণীয় নির্ধারণ করলেও তা অনুসরণ করছে না সংস্থাটি। এছাড়া চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির নির্দেশনাও অনুসরণ করছে না চসিক। ফলে দিন দিন নগরে বাড়ছে মশার উপদ্রব। বিশেষ করে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী ‘এডিস’ ও ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী ‘এনোফিলিস’ মশা বেড়েছে। গত ৭ জুলাই লালখান বাজারে মশা জরিপ করে সিভিল সার্জন অফিস। এতে ২০ শতাংশ বাসা-বাড়িতে মিলেছে এডিস। এছাড়া চবি গবেষক দল নগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৯ টি স্থান পরিদর্শন করে ৫৭টি স্থান থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৩৩ স্থানে এডিস, ৩৯ স্থানে এনোফিলিস ও ২২ স্থানে এডিস ও এনোফিলিস দুটোই পাওয়া গেছে। তবে ১৮ স্থানে এডিস ও ১২ স্থানে এনোফিলিস পাওয়া যায়নি। এছাড়া ১৫ স্থানে শতভাগ এডিস ও দুই স্থানে শতভাগ এনোফিলিস পাওয়া গেছে।
‘কার্যকর’ ওষুধের সংকট আছে : পরীক্ষামূলকভাবে ছিটানোর জন্য ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে গত ২৯ আগস্ট এক হাজার লিটার ‘ম্যালাথিয়ন ৫ পার্সেন্ট ফরমুলেশন’ (রেডি ফর ইউজ) মশক নিধনের কীটনাশক (এডাল্টিসাইট) সংগ্রহ করে চসিক। এর আগে একই মাসের শুরুতে ১০০ লিটার ‘মাসকুবার’ নামে এডাল্টিসাইট সংগ্রহ করে। নিয়মিত ব্যবহার করলে গত তিন মাসে এসব কীটনাশক শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। পৃথক দুটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, কীটনাশক দুটি মশক নিধনে ‘কার্যকর’। ওই হিসেবে বর্তমানে চসিকে কার্যকর ওষুধের সংকট আছে।
তবে চসিকের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী গতকাল দৈনিক আজাদীর কাছে দাবি করেছেন, পরিমাণে কম থাকলেও ছিটানোর মত কীটনাশক মজুদ আছে। তিনি বলেন, ১০-১৫ লিটার মাসকুবার এবং ২০০ লিটার ম্যালাথিয়ন মজুদ আছে। ৫৯ লিটার ডিজেলে এক লিটার মাসকুবার মিশিয়ে ছিটাই। তাছাড়া সাবেক মেয়রের মেয়াদকালে কেনা লার্ভিসাইড মজুদ আছে ৬০০ থেকে ৭০০ লিটার। এটা আমরা পরিমাণে বাড়িয়ে ব্যবহার করছি। আগে ৮/৯ লিটার পানিতে ২০ এমএল মেশাতাম, বর্তমানে ৪০ এমএল মিশিয়ে ছিটাচ্ছি। সাবেক মেয়রের মেয়াদকালে কেনা লিকুইড এডাল্টিসাইট এক হাজার থেকে ১২০০ লিটার মজুদ আছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একদল গবেষকের গবেষণা (গত ৩ আগস্ট প্রকাশিত) প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাসকুবার স্প্রে করার দুই ঘন্টা পর শতভাগ মশা মরেছে। তবে এডালটিসাইড’টি নির্দিষ্ট মাত্রায় কেরোসিন মিশিয়ে ফগার মেশিন দিয়ে ব্যবহারের পর মশা মরেছে মাত্র ১৪ শতাংশ। কার্যকর ওষুধ সংগ্রহে চসিকের গঠিত তিন সদস্যের কমিটি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ম্যালাথিয়ন ৫ পার্সেন্ট ফরমুলেশন’ ব্যবহারে আইইডিসিআর মেডিকেল এন্টেমলজি বিভাগের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষায় ২৪ ঘণ্টায় শতভাগ মশা মারা গেছে। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পরীক্ষায়ও এটির সাফল্য ছিল শতভাগ। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, সিলেট এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনও কীটনাশকটি ব্যবহার করে। ‘ম্যালাথিয়ন ৫ পার্সেন্ট ফরমুলেশন’ ফগার মেশিন দিয়ে ব্যবহার করা হয়।
পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সময়ক্ষেপণ : নতুন করে কীটনাশক সংগ্রহের লক্ষ্যে মেয়রের নির্দেশে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন পরিদর্শন করেন চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের একটি টিম। তারা ঢাকায় মশক নিধন কার্যক্রমের সঙ্গে চসিকের তুলনামূলক পার্থক্য চিহ্নিত করে প্রতিবেদন জমা দেন মেয়রকে।
এরপর ১৪ মার্চ চবি উপাচার্য ড. শিরীণ আখতারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে ওষুধের গুণগত মান পরীক্ষার অনুরোধ করেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এর প্রেক্ষিতে ৬ সদস্যের একটি গবেষক দল ৫ জুলাই থেকে গবেষণা শুরু করে। ৩ আগস্ট তারা রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনার উপর জোর দিয়ে চার দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেন মেয়রকে।
পরবর্তীতে ১৬ আগস্ট ভবিষ্যতে কার্যকর ওষুধ সংগ্রহে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেন মেয়র। ওই কমিটিও প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে চসিকের ব্যবহৃত পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসের কীটনাশক লিকুইড এডাল্টিসাইট (ল্যামডাসাইহ্যালোথিন ও ডেল্টামেথ্রিন) পিএইচপি ৬৯৯ ব্যবহার বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়। এর পরিবর্তে ‘ম্যালাথিয়ন ৫ পার্সেন্ট ফরমুলেশন’ (রেডি ফর ইউজ) ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়। এছাড়া মশার লার্ভা ধ্বংসে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসা ‘এম ফস ২০ ইসি (ক্লোরপাইরিফস) এর পরিবর্তে ‘টেমিফস ফিফটি পার্সেন্ট ইসি’ ব্যবহারের সুপারিশ করে। এভাবে গত ৯ মাসে তিন দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও কীটনাশক কেনার কার্যকর কোনো প্রদক্ষেপ নেয়নি।
এ বিষয়ে চসিকের বর্জ্য স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি মো. মোবারক আলী দৈনিক আজাদীকে বলেন, মশক নিধনে ওষুধ সংগ্রহের জন্য মেয়র মহোদয় নির্দেশনা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী এবং বিমান বাহিনীতে মশক নিধনে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তার তথ্য সংগ্রহ করতে বলেছেন। পরবর্তীতে সবগুলো যাচাই-বাছাই করে অধিক কার্যকর কীটনাশক সংগ্রহ করবো।
এদিকে এ বিষয়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বক্তব্যও পাওয়া যায় নি। গত দুইদিন ধরে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন। সর্বশেষ গতকাল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত একাধিকবার কল দিলেও রিসিভি করেননি। তবে এর আগে গত ৪ আগস্ট চবি গবেষক দলের গবেষণা প্রতিদবেদন পাওয়ার পর গণমাধ্যমে তিনি বলেছিলেন, মশা মারার কোন ওষুধই তিনি কিনেন নি, সবই আগের মেয়রের কেনা। ওষুধ ছিটানোর পরও মশা না মরায় এবং ফগার মেশিন থেকে ধোঁয়া বের হলেও মশার উপর কোন প্রভাব না পড়ায় তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে ওষুধ পরীক্ষা করানোর উদ্যোগ নেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা আর ওই ওষুধ ব্যবহার করবো না। শতভাগ মান সম্পন্ন নতুন ধরনের ওষুধের জন্য অর্ডার দেয়া হয়েছে।
ব্যবহার হচ্ছে অকার্যকর ওষুধ : বর্তমানে চসিকে প্রায় এক হাজার থেকে ১২০০ লিটার লিকুইড এডাল্টিসাইট (ল্যামডাসাইহ্যালোথিন ও ডেল্টামেথ্রিন) পিএইচপি ৬৯৯ এবং ৬০০-৭০০ লিটার ‘এম ফস ২০ ইসি (ক্লোরপাইরিফস) মজুদ আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কল্যাণ ট্রাস্ট’ থেকে ২০২০ সালের ১৪ মে লার্ভিসাইড এবং ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ‘ডকইয়াডর্ এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং’ থেকে ২৫ হাজার লিটার এডাল্টিসাইড সংগ্রহ করেছিল।
চবি গবেষক দলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘লিকুইড এডাল্টিসাইট’ প্রয়োগের দুই ঘণ্টা পর মাত্র ১৯ শতাংশ মশা মরেছে। একইভাবে লার্ভিসাইড ছিটানোর দুই ঘণ্টা পর লার্ভার মৃত্যুহার মাত্র ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ মশক নিধনে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত চসিকের কীটনাশক দুটো অনেকটা অকার্যকর। গত আগস্ট মাসে প্রতিবেদন পেলেও কীটনাশক দুটি ব্যবহার বন্ধ করনি চসিক। অবশ্য এক্ষত্রে নির্ধারিত প্রয়োগমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চসিকের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত প্রয়োগ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। খাল-নালার পানির সঙ্গে মিশে কীটনাশকটি কর্ণফুলী নদীতে পড়লে মাছসহ অন্যান্য প্রাণীর জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলেও আশংকা রয়েছে।
মানা হচ্ছে না জাতীয় গাইড লাইন : ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ‘জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর, মশকনিধন বছরভর’ স্লোগানে দেশে প্রথমবার জাতীয় নির্দেশিকা প্রণয়ন করে। গত ২৫ আগস্ট প্রকাশিত ওই নির্দেশিকায় চট্টগ্রামসহ দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর জন্য ৩৪টি করণীয় নির্ধারণ করা হয়। যার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন করছে না চসিক।
নির্দেশিকা অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হতে ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে রোগীদের বাড়িতে ও চারপাশের কমপক্ষে ৫০টি বাড়িতে এডিস মশা নিধনে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসে অপরাহ্ন হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত এডাল্টিসাইট ও লার্ভা ধ্বংসে সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত লার্ভিসাইড ছিটাতে হবে। পাশাপাশি মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করে ধ্বংসসহ সুনির্দিষ্ট ১০টি বিষয়ে এক বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে চসিককে। এছাড়া বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ, পর্যালোচনা ও তদারকির জন্য মেয়রের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের পৃথক দুটি কমিটি গঠন করতে হবে। তবে তিন মাস পূর্ণ হলেও নির্দেশিকা অনুসরণ করেনি চসিক।
উপেক্ষিত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা : গত ২১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা। সভার সিদ্ধান্তনুযায়ী, মশার ‘হটস্পট’ চিহ্নিত করে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে চসিককে। একইসঙ্গে ওয়ার্ড পর্যায়েও ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রতি মাসে তার রিপোর্ট পাঠাতে হবে স্থানীয় সরকার বিভাগে। ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে নির্দেশনা বাস্তবায়নে চিঠিও দেয়া হয়। তবে ওই নির্দেশনাও বাস্তবায়ন করেনি চসিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাজনীতিতে চাই পরমতসহিষ্ণুতা শ্রদ্ধাবোধ : রাষ্ট্রপতি
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬