মরমীবাদের সহজতত্ত্ব ও রবীন্দ্রনাথের অরূপ সাধনা

ইকবাল হায়দার | শুক্রবার , ৭ মে, ২০২১ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

মরমীবাদীরা ভাবের মানুষ। যারা জীবন ও জগৎকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে এবং রচনা করে এক ভাবজগৎ তারাই মরমী। মানুষের প্রেমকে ঈশ্বরের প্রেমে রূপান্তরিত করাই মরমীবাদের লক্ষ্য। প্রেমের দেবালয়ে পৌঁছার একমাত্র পথ হলো সমর্পণ বা সারেন্ডার। সব কিছু ঈশ্বরের কাছে সপে দেওয়া, সবকিছুকে ঈশ্বরের দান বলে মেনে নেয়ার মধ্যে জীবনের আদর্শ তাঁরা খুঁজে পান। ধ্যানে, জ্ঞানে, অন্তরের অন্তরস্থল দিয়ে উপলব্ধি করে একই লক্ষ্যবস্তু। দু’দিনের পান্থশালায় মানব জীবনের দোষগুন, ভালমন্দ, পাপপুণ্য, সফলতা ব্যর্থতা, সব কিছু ঈশ্বরের কাছে সমর্পনের মাধ্যমে তাঁরা মহাসৃষ্টির বিরাট রহস্যের দ্বার উৎঘাটন করতে তৎপর। স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক নিয়ে মরমীবাদীদের জপনা। মরমী চিন্তা চেতনায় তাদের প্রাণ আপ্লুত। অন্তরের গহীনে রক্ষিত আলোর অনির্বাণ শিখা জ্বালিয়ে তারা খোঁজে ফিরেন স্বীয় স্রষ্টাকে। সাধক কঠোর সাধনার মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট। আধ্যাত্ন জীবন সম্পর্কিত গভীর অনুসন্ধানই মরমী সাধনের মূল সূর। আর সেই সুরই চির রহস্যময় দূর্জ্ঞেয় রহস্যের দিগন্ত উম্মোচন করে। এই আস্থা অর্জনের অন্যতম অবলম্বন হচ্ছে আত্মা। সুতরাং আত্মাই মরমীবাদের প্রধান উৎস।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপলব্ধিতে, জ্ঞানে, গভীর নিমগ্ন চিন্তায়, অনুরঞ্জনে, মনোরঞ্জনে, সহজ সাবলীল প্রকাশে, অবলীলাময়ী ভাষার ব্যবহারে অনুধাবনে, অনুরক্তিতে, অনুভবে, প্রাণের উচ্চলতায়, চেতনার অবগাহনে, যে মানসী, মানস সুন্দরী, লীলা সংগিনী, প্রভূ, জীবন দেবতাকে নানা উপমায় রূপে, রঙে, প্রেমে, ভাবে, ব্যঞ্জনায়, বিবিধ শব্দে, পদে, আকুতিতে, উচ্ছ্বাসে, বিনয়ে, বাক্যে, বিবিধ পদে এবং যে অপরূপের সন্ধান পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহুবিধ, সংজ্ঞায়, বচনে, উচ্চাসে, উচ্চারণে, কথায়, সম্বোধন করেছেন হে, ওহে, হে প্রিয়তম, ওহে অন্তরতম, ত্রিভুবনেশ্বর, পরাণ সখা, হে প্রিয়, হে আমার বন্ধু, হে আমার নাথ, বন্ধু হে আমার, হে মোর দেবতা, ওহে সুন্দর তুমি, ওগো অসীম, তুমি হে, হে অন্তরযামী, মানবজন্মতরীরমাঝি, ওহে অসীম, তুমি কে, বার বার তার কবিতায়, উপন্যাসে, নাটকে, বিশেষ উপমায়, সম্বোধনে উচ্চারণ করেছেন তা তার বিস্ময়কর মরমীভাবের প্রকাশ ।
রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি। তবু তার সমগ্র শিল্প চেতনা ও কাব্য রূপের মধ্যে উল্লেখিত বিশেষ্য সমূহের ব্যবহার এক নিগূঢ় সুফী ধারা সহ অন্যান্য মরমীবাদীদের মত মরমী সাধনার প্রবাহ বিপুলভাবে প্রকাশ পেয়েছে এবং তাঁর কাব্য গ্রন্থ খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, গীতালি এবং অন্যান্য রচনায় বহুক্ষেত্রে মরমীবাদ পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি তাই মরমী কবিও। সূফীবাদীর ধারার কবির ও রামপ্রসাদ সেনের আলিঙ্গণ তাকে ঋদ্ধ করেছে। তার কবিতা বাউল ফকির দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে, বাউলের মনের মানুষের মত তিনি জীবন দেবতা সৃষ্টি করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ‘মরমী সাধনা ও রূপের সাধনায় সাধকরা বস্তু পৃথিবীর বাইরে অতীন্দ্রিয় জগতের অনুসন্ধান করেন’। মরমী সাধনা আমাদের চেতনাকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করেন। এর মাধ্যমে তার আনন্দরূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। তাই রবীন্দ্রনাথ মরমী কবি।
রবীন্দ্রনাথের ভাষা স্মরণ করে বলতে হয় মরমীবাদ বলতে সে বাস্তবতাকে বোঝানো হয় যা আমাদের প্রতিদিনের স্থলতা থেকে অনেক দূরের। এটি হচ্ছে সে গহীন পথ যার দ্বারা একজন ব্যক্তির বেঁচে থাকা কিংবা তার অস্তিত্ব আবিষ্কারের প্রচেষ্টা স্পষ্ট হয়। ধ্যান, প্রর্থনা, প্রত্যাশা দিয়ে একজনের অন্তর জীবনের উন্নতি হতে পারে মানব সমাজ, প্রকৃতি, বিশ্বলোক ও ঈশ্বরের সিংহাসন পর্যন্ত। জীবনে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণাও হতে পারে পরমার্থ সাধনা দ্বারা। যে বিশ্বাস ধারন করে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে অন্তর্নিহিত ভাবনা কিংবা সীমানা ছাড়িয়ে অসীমের জন্য কাতরতা তারই নাম মরমীবাদ।
আসলে রবীন্দ্রনাথের যথার্থ মরমী ভাবনা শুরু হয় ‘গীতাঞ্জলি’ পর্বে। বাউলের সুরে লালনের ‘খাঁচার পাখি, মনের মানুষের, অশ্রুতপূর্ব ভাব ও শব্দের ধারনায়। তাঁর মরমী চিন্তার মূলে আছে বিশ্ব নিয়ন্তার প্রতি বিশ্বাস। বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া এবং এই অভিজ্ঞতা থেকে কাব্য সৃষ্টিকেও রবীন্দ্র নাথ মরমীবাদ বলেছেন। চৈতন্য এবং বিশ্বকে একীভূত করে দেখা এবং জগৎ ও মানুষ উভয়ে উভয়ের পরিপূরক এই ভাবনা রয়েছে মরমীবাদে।
রবীন্দ্রনাথে ভাষায় ‘বিশ্ব ভুবনের অস্তিত্ব ও আমার অস্তিত্ব একাত্মক। ভূভুব: স্ব: এই ভূ-লোক, অন্তরীক্ষ, আমি, তারই সঙ্গে অখন্ড। এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের আদি অন্তে যিনি আছেন তিনি আমাদের মনে চৈতন্য প্রেরণ করেছেন। চৈতন্য ও বিশ্ব, বাহির ও অন্তরে, সৃষ্টির এই দুইধারা একধারায় মিলেছে। এমনি করে ধ্যানের দ্বারা যাকে উপলব্ধি করছি তিনি বিশ্ব আত্মাতে আমার আত্মাতে চৈতন্যের যোগে যুক্ত’।
রবীন্দ্রনাথ আপন সত্তার মধ্যে প্রত্যাহিক উপলব্ধির বাইরেও আরো একটি অনুধ্যান খুঁজে পেয়েছিলেন “পরম পুরুষ” সে আপন সত্তার উপলব্দির অন্যদিক যা জীবন দেবতা শ্রেণির কাব্যের মূল উপজীব্য।
একদিকে বিশ্ব দেবতা যার আসন লোকে লোকে, গ্রহে, চন্দ্রে, তারায় অন্যদিকে জীবন দেবতার পীঠস্থান জীবনের আসনের সকল অনুভূতির কেন্দ্র, বাউল তাকে বলে ‘মনের মানুষ’। জীবনদেবতাকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করতে হবে। নিজেকে ত্যাগ না করে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করার মধ্যে পরমার্থ জ্ঞান প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের মতে আমাদের বিষয় বুদ্ধির ঘেরাটোপের জীবন হচ্ছে বৈষয়িকতার জীবন, এর বাইরে আরেকটি জীবন আছে যা সাধনার, ত্যাগের ও তপস্যার। এই জীবনে অন্বেষণ হলো এক সর্বজনিন সর্বকালীন মানুষের অন্বেষণ। সেই পরম পুরুষের আকর্ষণে মানুষের চিন্তায়, ভাবে, কর্মে সর্বজনীনতার আবির্ভাব। তাকে অনুভব করা তার প্রেমে সহজে জীবন উৎসর্গ করা এবং সেই উপলব্ধিটি আপন জীব সীমা অতিক্রম করে মানব সীমায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রকৃত মরমী সাধনা।
‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে নিজের সাধনা সম্পর্কে রবীন্দ্র নাথ বলেছেন “ আমার মন যে সাধনাকে স্বীকার করে তার কথাটা হচ্ছে এই যে, আপনাকে ত্যাগ না করে আপনার মধ্যে সে মহান পুরুষের উপলব্ধি করার ক্ষেত্র আছে। তিনি নিখিল মানবের আত্মা”।
নিখিল মানবের আত্নার স্বরূপ হচ্ছে সর্বজনীন মানব বা পরমপুরুষ। যিনি সব মানুষের হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট থেকে মহত্নের শ্রেয়বোধের প্রেরণা দিচ্ছেন। চিত্রা কাব্যে “এবার ফিরাও মোরে” কবিতায় তার পরিচয় রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন।
প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন ‘খেয়ার নেয়ে’ আলোছায়ার রহস্যলোকে অস্পষ্টভাবে ক্ষণে ক্ষণে দেখা দিয়েছেন আর গীতাঞ্জলীর দেবতা ভক্তের সম্মুখে আসীন। রবীন্দ্রনাথের মরমীবাদের রসানুভূতি গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতালীতে স্তরে স্তরে গভীর হতে গভীরে গিয়ে পূর্ণতা লাভ করেছে। (রবীন্দ্র জীবনী ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৫)। আত্নার দৃষ্টি রচনায় কবি বলেছেন “ আমাদের চেতনা আমাদের আত্মা যখন সর্বত্র প্রসারিত হয় তখন জগতের সমস্ত সত্তাকে আমাদের সত্তা ধারাই অনুভব করি। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নয়, বৈজ্ঞানিক যুক্তি দ্বারা নয়, সে পরিপূর্ণ অনুভূতি একটি আশ্চার্য্য ব্যাপার।
ঈশ্বর, ভগবান, জীবননাথ, একাকার রবীন্দ্র রচনায়। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য ও আনন্দ উপলব্ধির মধ্যে আছে সৃষ্টিকর্তার অমৃত রসের আস্বাদন। তার মরমী চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ঈশ্বর প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, বিশ্বলোক ও মানবপ্রেমের কথা। জীবন দেবতার ভাবনাতে ও রবীন্দ্রনাথ অতীন্দ্রিয় দর্শনের সঙ্গে যুক্ত করেন। জীবনদেবতা ও পরমার্থ চেতনা সঙ্গতিপূর্ণ।
জীবন দেবতাকে পেয়ে কবির মরমী চেতনাবোধ দেবসত্তার সঙ্গে মানব চেতনাকে, আদর্শের সঙ্গে বাস্তবকে, নিত্যের সঙ্গে অনিত্যকে এবং কবিসত্তার সঙ্গে কর্মীসত্তাকে মিলিতভাবে দেখতে পেয়েছেন।
মানবিক সত্য ও আস্তিক্যবাদ রবীন্দ্রনাথের মরমী সাধনার সার কথা। জগৎ ও জীবন তার কাছে রূপাতীত, লোকাতীত অনন্ত দেশকাল ব্যাপী এক মহান আনন্দ শক্তির প্রকাশ। সুন্দর মোহনীয় অপরূপ ও অনির্বচনীয় সবকিছু কবির আরাধ্য। কবি সবকিছুর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অনুভব করেছেন এটাই তার মরমীবাদিতা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিভিন্ন দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীদের সাথে মতবিনিময়ে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধকবিগুরুর স্বদেশভাবনা ও মানবতাবোধ