মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই শুরু হচ্ছে নগর ভবনের কাজ

ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের পর ১৩ বছর পার ।। হবে চসিকের নিজস্ব অর্থায়নে, ২৭ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান

মোরশেদ তালুকদার | মঙ্গলবার , ৬ জুন, ২০২৩ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

নগর ভবন নির্মাণে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১০ সালের ১১ মার্চ। এরপর ১৩ বছর ৩ মাস পেরিয়েছে। দীর্ঘ এ সময়ে তিনজন মেয়র নানা উদ্যোগ নেন। কিন্তু নগর ভবন নির্মাণ কাজের অগ্রগতি হয়নি। এর প্রধান কারণ ছিল অর্থসংস্থান না হওয়া। সর্বশেষ প্রায় এক বছর ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতির অপেক্ষায় আছে ২০২ কোটি টাকার নগর ভবন নির্মাণ প্রকল্প। মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পেলে তা প্রিএকনেক হয়ে একনেক সভায় অনুমোদন পেতে হবে। এতে রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। তাছাড়া ‘উচ্চবিলাসী’ প্রকল্প আপাতত অনুমোদন দিচ্ছে না মন্ত্রণালয়।

এ অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই নিজস্ব অর্থে নগর ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এ লক্ষ্যে ২৭ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এছাড়া আন্দরকিল্লায় বিদ্যমান ভবন ভাঙার জন্য নিলামে ৭০ লাখ টাকায় ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা চসিকের প্রস্তাবিত প্রকল্প অনুযায়ী নগর ভবন হবে ২০ তলা। তবে চসিক নিজস্ব অর্থায়নে শুরুতে ধাপে ধাপে ৬৭ তলা করবে। অবশ্য আইনি জটিলতা এড়াতে শুরুতে বেইসমেন্টসহ তিনটি ফ্লোর (অবকাঠামোগত) করার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আগামী ২ জুলাই এ দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন।

এ বিষয়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, কথায় আছে কাজে নেমে গেলে টাকা ভূতে যোগায়। তাই কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। যদি শুরু না করি তাহলে কোনো অগ্রগতিই হবে না। ওভাবেই পড়ে থাকবে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কাজ শুরু করলে প্রশাসনিক কোনো বাধা আসবে কিনা জানতে চাইলে মেয়র বলেন, না। আমাদের টাকায় আমরা করবো, সেখানে সমস্যা কেন হবে। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় যতটুকু পারে ততটুকু দিবে। প্রাথমিকভাবে আমরা ৬৭ তলা করে ফেললে আমাদের অফিসিয়াল কার্যক্রম সেখানে শুরু করা যাবে। পরবর্তীতে বাকি ফ্লোর করা যাবে। পেছনে যে জায়গা রয়েছে সেটাও আমরা নিয়ে ফেলেছি। এতে জায়গার পরিমাণ বেড়েছে।

তিনি বলেন, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের বিল্ডিংয় ডিভিশন এ ভেটিং করতে দিয়েছিল। সেটা সম্পন্ন হয়েছে। প্রিএকনেকে পাশ করালাম। এরপর একনেকে যাওয়ার সময় আবার জটিলতা হয়। এরপরও আমি চেষ্টা করছি। কাজ শুরু করে দিব।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, আন্দরকিল্লায় ১৮৬৩ ও ১৯৬৪ সালে নির্মিত পৃথক দুটি পৌরভবনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। এরমধ্যে ১৮৬৩ সালে নির্মিত ভবনটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠায় ২০০৯ সালে ভেঙে ফেলা হয়। সেখানে ২০০৯ সালে তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী নতুন ভবন নির্মাণে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পৌরভবনটি এখনো রয়েছে। এ ভবনটি ভাঙার জন্য নিলামে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়। ভাঙার পর দুটো ভবনের জায়গায় নতুন নগর ভবন নির্মাণ করা হবে।

এ বিষয়ে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, প্রায় এক বছর আগেই নিলাম করেছি। ঠিকাদারও নিয়োগ হয়েছে। এতদিন নতুন ভবন নির্মাণ বিষয়ে পুরোপুরি সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ঠিকাদারকে কাজ শুরু করতে অনুমতি দিইনি। এখন যেহেতু মেয়র মহোদয় চসিকের নিজস্ব অর্থে নগর ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তাই পুরনো ভবন ভাঙার জন্য আমরা ঠিকাদারকে অনুমতি দিয়ে দিব।

উল্লেখ্য, নিলামে দেয়া ভবনটি চসিকের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হতো। ২০১৯ সালের ২০ জুন তা টাইগারপাসের অস্থায়ী কার্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছিল। বর্তমানে ভবনটি আঞ্চলিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

যে কারণে ১৩ বছরের দীর্ঘসূত্রতা : ২০১৯ সালের র্মাচ মাসে ২০২ কোটি ২৪ লাখ টাকায় নগর ভবন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। একই বছরের ২৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত প্রকল্প পর্যালোচনা সভায় (আইপিইসি) প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। তবে প্রকল্পে কিছু সংশোধনের নির্দেশনা দেয়া হয়। সে আলোকে একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর প্রকল্পটি সংশোধন করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে চসিক। এতে প্রকল্প ব্যয় ২৭ কোটি ২০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা বেড়ে প্রকল্পের আকার হয় ২২৯ কোটি ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। যা ২০২০ সালের ১২ মার্চ প্রিএকনেক সভায় অনুমোদন পায়। তবে ওই সভায় ফিজিবিলিটি স্টাডি রির্পোট বা সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনসহ প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। একইসঙ্গে প্রকল্পে ব্যয়ের খাতগুলোর প্রাক্কলন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলনের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার নির্দেশনা দেয়া হয়।

পরবর্তীতে গত বছর (২০২২) প্রকল্পটি আবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অর্থসংস্থানের বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠায়। বর্তমানে প্রকল্পটি সেখানে আটকে আছে।

এদিকে চসিক গত মার্চে মূল প্রকল্প থেকে তিনটি ফ্লোর কমিয়ে ২০ তলা নগর ভবনের ব্যয় প্রস্তাব করে ২০২ কোটি। যদিও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী, দুইটি বেইসমেন্ট ফাউন্ডেশনসহ তিনটি পার্কিং থাকবে এবং এর দুইটি হবে আন্ডারগ্রাউন্ডে। প্রকল্পের প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী এটি হবে ‘আইকনিক’ ভবন। ভবনের ওপরে থাকবে সিটি ক্লক। ভবনের তিনপাশে সাজানো বাগান থাকবে। ভবনের কয়েকটি ফ্লোর বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেয়া হবে। থাকবে মাল্টিপারপাস হল, কনফারেন্স হল ও ব্যাংকুয়েট হল।

যে স্থানে ‘নগর ভবন’ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে মোট ভূমির পরিমাণ ৩৩ দশমিক ৮১ গণ্ডা (২৯ হাজার ২১১ দশমিক ৮৪ স্কয়ার ফুট)। মোট ভূমির ৬৭ শতাংশ ব্যবহার হবে ভবন নির্মাণে এবং সবুজকে প্রাধান্য দিয়ে বাকি ৩৩ শতাংশ খালি রাখা হবে। উন্মুক্ত এ অংশে সবুজায়ন করা হবে। সেখানে বৃক্ষ রোপণ করা হবে, থাকবে ফুলের বাগান। ভবনের তিনপাশেই বাগান করার পরিকল্পনা আছে। নির্মাণ করা হবে ফোয়ারা।

জানা গেছে, বর্তমানে আটকে থাকা প্রকল্পটির উদ্যোগ নেন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। এর আগেও দুইবার উদ্যোগ নেন তিনি। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৭৪ কোটি টাকায় ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। ২০১৭ সালে ডিপিপি সংশোধন করা হয় ১২০ কোটি টাকায়। তখন ভবন নির্মাণে জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণও চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এতে আপত্তি জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে সৃষ্টি হয় অর্থ সংস্থানের জটিলতা। একারণেই প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা থেকে প্রকল্পটি বাদ পড়ে।

অবশ্য নগর ভবন নির্মাণে প্রথম উদ্যোগটা নিয়েছিলেন প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী। ২০১০ সালের ১১ মার্চ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই শুরু হয়েছিল এ নির্মাণ কাজ। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এ জে কনস্ট্রাকশন নগর ভবনের প্রথম ছয়তলা নির্মাণের কাজ পেয়েছিল ওই সময়। তখন চসিকের নিজস্ব তহবিল থেকে নগর ভবনের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৮ কোটি ৮৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ২০১০ সালের ১৭ জুন অনুষ্ঠিত চসিক নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরী পরাজিত হলে নগর ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে মোহাম্মদ মনজুর আলম মেয়রের দায়িত্ব পালনকালে ২০১১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নগর ভবন নির্মাণে অনুমোদন দেয়। এরপর বিভিন্ন জটিলতায় প্রায় তিন বছর কাজ বন্ধ থাকে। ২০১৪ সালে পুনরায় কাজ শুরু হয়। কিছুদিন যেতেই অর্থাভাবে আবারও কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিদেশি দূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে উপযুক্ত ব্যবস্থা : শাহরিয়ার
পরবর্তী নিবন্ধবিদেশে সম্পদের খোঁজ পেলে জরিমানা