আমাদের এই বিশ্বজগত অফুরন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার, বিশাল পুস্তক। যে পুস্তকে ইতিহাস, বিজ্ঞান,দর্শন,কাব্য, সাহিত্য সবকিছু মিলিয়ে অনন্ত জ্ঞান। যে পুস্তকের আদি, মধ্য, অন্ত কিছুই নিরূপণ করা যায় না। সর্ববিষয়ের গবেষকগণ নিজ নিজ গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বজগতকে মনোজগতে অনুভব করেন।
কবি জগতটাকে কবিতার মতো করে দেখেন। যেখানে কবি সেখানেই কবিতা। কবি দুচোখে জগৎ জুড়ে যা কিছু দেখেন অন্তরে তারই প্রতিফলনে কবিতার সম্ভার জমা হয়। কবি কেবল পদে পদ মিলিয়ে কবিতা লিখেন না। তিনি প্রকৃতির মধ্যে দৃশ্যমান সবকিছুই গভীর মনোনিবেশ করে পর্যবেক্ষণ করেন। বাহ্যদৃষ্টিতে যা কবি দেখেন, অন্তর্দৃষ্টিতে তা আরও গভীর তত্ত্বপূর্ণ রূপে দেখা দেয়। বহুকবির বহুরকম ভাবনা থাকে। সব কবির ভাবনা এক রকম কখনোই হয়না।যে কবি যেমন করে ভাবেন, সে কবির প্রকাশও তেমনভাবে রূপায়ণ হয়ে থাকে। কবি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে জাগতিক প্রত্যেকটি বিষয়ের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করেন এবং কাব্যিক রূপ দান করেন।সুক্ষাতিসুক্ষ বিষয়টিও কবি যত্নে উপলব্ধি করার পর সুনিপুণ লেখার দ্বারা সেই বিষয়টির সৌন্দর্য এবং গুরুত্ব প্রকাশ করেন। কবির অন্তর থেকে বেরিয়ে আসে অন্তর উপলব্ধির কথা, অভিজ্ঞতার কথা। সাধারণ মানুষের কাছে জগৎ, সমাজ, প্রাণীর অনেক কিছুই নীরস, একঘেয়েমি মনে হতেই পারে, কিন্তু কবি এবং সাহিত্যিকের কাছে জগতের সবকিছু অর্থ সমৃদ্ধ, তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়।
প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীব্যাপী অনন্ত ভাবনা,অনন্ত কথা,অনন্ত সুর, অনন্ত ছন্দ ছড়িয়ে আছে, যার সাথে পৃথবীর সকল প্রাণীর জীবন যাপিত হয়। উপলব্ধিতে কারো আসে আবার কারো আসে না। জীবন থেকে মরণ অবধি জগৎ ও জীবন নিয়ে মানুষের বিচিত্র অনুভব এবং অভিজ্ঞতার শেষ নেই। শৈশবে প্রকৃতিকে আমরা সহজ,সরল, নিবিড়ভাবে অনুভব করি।যাপিত জীবনে ক্রমে ক্রমে তার সৌন্দর্যবোধ হৃদয়ে আরও বিচিত্রভাবে জাগে।
চলমান জীবনের প্রতিকূলতা থেকে দুঃখবোধের সৃষ্টি হয়। সেই দুঃখবোধের কারণে আমাদের সৌন্দর্য অনুভূতির আনন্দ বহুসময় ম্লান হয়ে আসে। কবির ভাবনায় সুখবোধ,দুঃখবোধ, মিলন,বিরহ থেকে আনন্দ বেদনার এক অনন্য অনুভূতির কাব্যিক প্রবাহ সৃষ্টি হয়, যেখান থেকে অপূর্ব সব লেখা কলমে বেরিয়ে আসে। সেই অনন্য অনুভূতির কোন সীমারেখা খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রত্যেকটি অনুভূতি তিল তিল করে কবির অন্তরে নতুন, নতুন ভাবনার প্রতিফলন ঘটায়। বিশ্বসংসারে সুখ দুঃখ, আনন্দ, বেদনা চিরকাল তরঙ্গিত। সুখদুঃখ, আনন্দ, বেদনা সবই জাগতিক। ক্ষণতরে আসাযাওয়ার মাধ্যমে নিমেষেই পৃথিবীতে আলোক বিচ্চুরিত করে।
কবির চোখে তাই পৃথিবী অপরূপ মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে উদ্ভাসিত। বিজ্ঞান, ইতিহাস, সকল বিষয়ের বাস্তবতা কল্পনার দ্বারা গ্রহণ করতে পারলে মনোজগতে এক অপরূপ বিশ্বভুবন নির্মিত হয়। সেই মনোজগত থেকে কাব্য, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন,বিজ্ঞান সবই উপলব্ধিতে পৌঁছে। সেই অনুভূতিগুলি কবির চিত্রায়ণে, বৈচিত্র্যে,মাধুর্যে যে উৎকর্ষ সাধন করে, তা বিশ্বজনীন সাহিত্যসৃষ্টি হয়ে মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। পৃথিবীর অসংখ্য চিত্রকল্পের বিবর্তন সত্ত্বেও সবকিছু নব নব আবিষ্কারে, ছন্দের চারুতায়, প্রকাশ ভঙ্গিতে পুনরায় বাস্তবানুগ হয়ে বহুধা বিস্তৃতির যোগান দেয়। পৃথিবীর প্রাচুর্য বিশুদ্ধ রূপের জগতে স্বল্পকাল স্থায়ী হলেও সভ্যতা শিল্পীর সত্তাকে বিস্মৃত করেনা।প্রতি মুহূর্তে নিত্য নতুন ঘটনা প্রবাহ সজীব,বর্ণাঢ্যময়, সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ রূপ পরিগ্রহ করে। সেইটাই মনোজগতের সাথে বিশ্বজগতের ঐক্য।