মনে পড়ে বাবাকে

আশরাফ হোসেন খান | শনিবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২০ at ৯:৩৭ পূর্বাহ্ণ

দেখতে দেখতে প্রায় ৭ বছর গত হলো বাবাকে ছাড়া, বাবাকে নিয়ে ইতোপূর্বে আমার দুটি লিখা আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে। লেখা দুটির একটি ছিলো ‘আমার বাবা ও বিরসরচনা’ এবং আরেকটি ‘আমার বাবা’ শিরোনামে। বাবাকে নিয়ে প্রত্যেক সন্তানেরই থাকে নানান স্মৃতি, সাফল্য গাঁথার মন্ত্র, অতীতের রেখে আসা অনেক কথা, যা বলা হয় না পরিস্থিতির কারণে। আজ সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ছে। অনেক কিছুই আজ জমা হচ্ছে স্মৃতিকোষে। কিন্তু সেগুলো প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই। বাবা থাকতে ভাবতাম বাবাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো? কিন্তু বাবা ছাড়া আজ কেটে যাচ্ছে একেকটি মাস, একেকটি বছর । এর মধ্যে অবশ্য মাকেও হারিয়েছি ৫ বছর হতে চললো।
আমার দাদা মরহুম ঈসমাইল খান ছিলেন ব্যবসায়ী। চট্টগ্রামের প্রাচীন মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান খান সুইটস-এর প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু আমার বাবা ব্যবসার দিকে না তাকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকার মালিবাগে অবস্থিত ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হযরত আবুজর গিফারী কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন উপাধ্যক্ষ হিসেবে প্রথম শিক্ষকতা পেশার সূচনা করেন। বাবা এই কলেজের উদ্যোগী প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তখন এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পায়ে হেঁটে ১১ দিনে নিজ গ্রাম আনোয়ারায় চলে আসেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি আনোয়ারার বিভিন্ন স্তরের জনগণের সঙ্গে নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাবা স্থায়ীভাবে আনোয়ারায় চলে আসেন। ওই সময় থেকেই তিনি আনোয়ারা উপজেলায় উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব সম্পর্কে অবহিত হন এবং স্বীয় উপজেলায় আনোয়ারা কলেজ প্রতিষ্ঠার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এলাকার রাজনৈতিক, সামাজিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এবং কলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সহযোগিতা কামনা করলে সবাই ঐক্যমত পোষণ করেন। বাবা তখন সমন্বয়কারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আনোয়ারাবাসীর সার্বিক সহযোগিতা ও বিশেষ করে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট শিল্পপতি প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু আংকেলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ১৯৭১-১৯৭২ শিক্ষাবর্ষ থেকে বাবা আনোয়ারা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আনোয়ারা কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন। বাবার মুখে শুনেছিলাম আনোয়ারা স্কুলের পূর্ব ও দক্ষিণ পাড়জুড়ে বাঁশের বেড়া আর টিনের ছাউনি দিয়ে গড়ে তোলা হয় অস্থায়ী ক্যাম্পাস। আজ সেই কলেজটি আনোয়ারার বুকে একমাত্র সরকারি কলেজ। বাবারও কিন্তু স্বপ্ন ছিলো এই কলেজটি একদিন না একদিন সরকারিকরণ হবে।
১৯৮০ সালের পর তিনি ফেনী জেলার কতিপয় শিক্ষানুরাগী বন্ধু-বান্ধবের অনুরোধে ফেনীর ছাগলনাইয়া থানায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেন। বাবা যখন ছাগলনাইয়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন কলেজটি ছিলো টিনশেডের। সেই টিনশেড থেকে কলেজটি ধীরে ধীরে ৩ তলা পাকা ভবন, ডিগ্রিতে রূপান্তর, সর্বোপরী সরকারিকরণ করা পর্যন্ত বাবা এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। বাবা চট্টগ্রামের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ফেনীর মানুষের আত্মার সাথে যেন মিশে গিয়েছিলেন। এরপর দায়িত্ব নেন চট্টগ্রামের বৃহত্তম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ওমর গণি এমইএস কলেজের। এখানে অধ্যক্ষ থাকাকালীন বাবা অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে অগোছালো একাডেমিক, প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং আর্থিক কাজকর্ম অত্যন্ত সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে দৈনিক আজাদীতে অধ্যাপক নোমান আহমদ সিদ্দিকির প্রকাশিত ‘প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ হোসেন খান : ওমর গণি এমইএস কলেজের নবজীবনদাতা’ লেখাটিই যথেষ্ট। বাবা সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে পাঁচটি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব ছাড়াও নোয়াখালী সরকারি কলেজ, নবাব ফয়েজুন্নেছা কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ ও হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজে শিক্ষকতা করেন। ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজ ছাড়াও ফেনীর আরেকটি স্বনামধন্য বেসরকারি কলেজ বিশিষ্ট শিল্পপতি ও এনসিসি ব্যাংকের সম্মানিত চেয়ারম্যান নুরুন নেওয়াজ সেলিম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মৌলভী সামশুল করিম কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে শাহাদাতবরণকারীর স্মরণে চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য তৎকালীন মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান উদ্যোগ গ্রহণ করলে কলেজ প্রতিষ্ঠার যাবতীয় কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব বর্তায় বাবার উপর। বাকলিয়া শহিদ এনএমএমজে কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাবার ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাবার সংগ্রহে থাকা অনেকগুলো দুর্লভ বই এই কলেজেই দেয়া হয়েছে এবং এই কলেজে ‘অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পেশাগত দায়িত্বের মধ্যেও বাবার একটি প্রিয়স্থান ছিলো দৈনিক আজাদীর অফিস। ১৯৬২ সালের আজাদীর মাস্টহেড বাবারই হাতের লেখা ছিলো। বাবা বলেছিলেন এটার জন্য আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক তাঁকে সম্মানীও দিয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি আজাদীর আপন লোক। বাবার বাল্যকালের বন্ধু আজাদীর বর্তমান সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মালেক আংকেলের পরামর্শে ১৯৯১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে স্বনামে না লিখে ছদ্মনামে সাধুভাষায় একটানা ২২ বছর আজাদীর শুক্রবারের কলামে ‘বিরস রচনা’ লিখেন, যা সত্যিই নজিরবিহীন। বিরস রচনা ছিলো পাঠক সমাদৃত ও পাঠকের কাছে জনপ্রিয় একটি কলাম। মৃত্যুদিনেও বাবা বিরস রচনার শেষ লেখাটি সকালবেলা আজাদী অফিসে দিয়ে এসেছিলেন। পরদিন শুক্রবারে প্রকাশিত হয়েছিলো বিরস রচনার শেষ লেখাটি কিন্তু প্রকাশিত লেখাটি বাবা পড়ে যেতে পারেননি। বিরস রচনার একটা নিজস্ব স্টাইল ছিলো, একটা নিজস্ব ভাষা ছিলো। যেখানে ফারসি, আরবি ও সংস্কৃত শব্দের চমৎকার মিশেল দেয়ার দক্ষতা তিনি পরিশ্রম করে অর্জন করেছিলেন। এই বিরস রচনা নিয়ে বাবার মন্তব্য ছিলো এমনই- শেষমেষ এই কলামটিই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আজ বাবার কথাই সত্যি হয়েছে। এখনও মানুষের মুখে বিরস রচনার সরস মন্তব্য শুনে যাচ্ছি। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর এসব লেখাগুলি শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। জ্ঞান অর্জন এবং মানবকল্যাণ ছাড়া অন্যকিছু যেন বাবার মন-মেজাজে বিরাজ করতো না। বাবার মুখে শুনেছি বাবার বয়স যখন ৮ বছর তখন ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহসুফি সৈয়দ আহমদ ছিরিকোটি ও তৎকালীন দৈনিক আজাদী সম্পাদকসহ চকবাজারস্থ খান মঞ্জিলে প্রবেশ করে বাবাকে কোলে নিয়েছিলেন। বাবা সবসময় বলতেন, মানুষ তার জীবনকে সুপরিসর পর্যায়ে নিতে পারে কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে। বাবার উপদেশগুলি আমি জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে পালন করার চেষ্টা করি। আমার কর্মস্থল বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক এবি ব্যাংক আমার মতো বাবারও খুব পছন্দের ব্যাংক ছিল। বাবা বলতেন- এবি ব্যাংক একটি ব্র্যান্ডেড ও দেশসেরা ব্যাংক। বাবা বলতেন- এবি ব্যাংকের সার্ভিস অনেক প্রশংসনীয় এবং প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এবি ব্যাংক দীর্ঘদিন ঐতিহ্য ও সুনাম ঠিকই ধরে রেখেছে প্রশংসনীয় গ্রাহক সেবার মাধ্যমে। নতুন ইংরেজি বছর আসলেই বাবা কৌতুহল করে বলতেন- তোমাদের এবি ব্যাংকের ক্যালেন্ডার কখন বের হচ্ছে?
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে শত ব্যস্ততার মাঝেও বাবার স্মৃতি আমাকে কিছুক্ষণের জন্য থমকে দেয়, এই কিছুক্ষণটা অন্যরকম! পুরোটা সময় আমি যেন কিছুই ভাবতে পারিনা বাবাকে ছাড়া। কারণ বাবা-মা হচ্ছেন অন্য এক ভুবন ও অন্য এক পৃথিবী।
লেখক : অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের জ্যেষ্ঠপুত্র ও ব্যাংক কর্মকর্তা

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে ইয়াবাসহ আটক ১
পরবর্তী নিবন্ধমুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রয়োজন