ভোমরা হতে তামাবিল

সাইকেলের সওয়ারি

বাবর আলী | সোমবার , ১৭ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

ছোয়াব আলী বাজার ছাড়িয়ে আখড়াঘাট হয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ সেতুতে আসতে বেশি সময় লাগল না। সেতুর নিচে ধীরলয়ে বয়ে চলেছে কুশিয়ারা। এখন পূর্ণ যৌবনা। এই বর্ষায় দুকূল ছাপিয়ে নদীখাত ছাড়িয়ে জনপদে উঠে স্থানীয় অধিবাসীদের অনেক ভুগিয়েছে কুশিয়ারা নদী। ইলাশপুর ছাড়িয়ে হাজীগঞ্জ বাজার। এদিকের প্রতিটা এলাকাতেই অঞ্চল তথা ইউনিয়ন ভিত্তিক প্রবাসীদের অর্থায়নে পল্লি উন্নয়ন সংস্থার সাইনবোর্ড চোখে পড়ছে। মোগলা বাজার হয়ে খালোমুখের পরে পীর হাবিবুর রহমান চত্বর থেকে ডানে ঢুকে গেলাম। সিলেট শহর বাইপাস করার পথ এটা। এই রাস্তার উপরে ছায়া দান করছে মেহগনির সবুজ ঘনপল্লব। ফাঁকে ফাঁকে অবশ্য নিম, জারুল আর বিশালদেহী সব কদমও আছে। বর্ষার নাম না জানা কিছু ফুলও ফুটে আছে ঝোঁপঝাড় উদ্ভাসিত করে। রাস্তার ডানের অংশটুকু সিলেট ক্যান্টনমেন্টের দখলে। স্কুল, ক্যাফেসহ নানান স্থাপনা। মুরাদপুর বাজার হয়ে সুরমা গেট ফয়েন্টো তথা পয়েন্ট থেকে ডানের রাস্তা এবারে। সিলেটে যেকোন রাস্তার মোড়কে বলা হয় ‘ফয়েন্টো’। অধুনা চাকরিসূত্রে সিলেটে বসত গাড়া মারুফ ভাইয়ের এই ‘ফয়েন্টো’ নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। এক দোকান থেকে দৈনন্দিন জিনিসপত্র কিনছিলেন মারুফ ভাই। সব জিনিস থাকলেও একটা পণ্য ওই দোকানে ছিল না। দোকানিই মারুফ ভাইকে জানাল ওই পণ্যটা ‘ফয়েন্টো’তে পাওয়া যাবে। সিলেটে নতুন আসা মারুফ ভাই পরের আধা ঘন্টা হন্য হয়ে ‘ফয়েন্টো’ নামক জায়গা খুঁজেছিলেন। আধা ঘন্টা পর বোধোদয় হয় এই ‘ফয়েন্টো’ নির্দিষ্ট কোন জায়গার নাম নয়। মোড়ই হলো ‘ফয়েন্টো’! অবশ্য সিলেটি ভাষায় এখন আমার দখল ভালো। চায়ের শহরে পা রাখার প্রাথমিক দিনগুলোতে দুর্বোধ্য ভাষায় বাক্যবিনিময় করতে দেখলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। প্রথমদিকে মারুফ ভাইয়ের মতো খানিকটা অসুবিধায় পড়লেও এখন রীতিমতো সড়োগড়ো সিলেটি ভাষায়। গত পনের মাসের সিলেটের চাকরিজীবনে ভাষাটা মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছি। কিছু ক্ষেত্রে উপযুক্ত শব্দের অভাবে খানিকটা হাতড়াতে হলেও আমার অ্যাক্সেন্ট নাকি প্রায় সিলেটি। আমার সিলেটি সহকর্মী থেকে মিলেছে এই স্বীকৃতি।

বটেশ্বর পেরিয়ে পা রাখলাম জৈন্তাপুর উপজেলায়। এই উপজেলায় প্রবেশের তোরণটা বেশ। চিকনাগুল থেকে হরিপুরের দিকে যেতে রাস্তার ধারেই চা বাগান পড়ে। এর মাঝেই সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আওতাধীন হরিপুরের গ্যাসের কূপের অঞ্চলে প্রবেশ করেছি। রাস্তার ডানেবামে দুই অংশেই ছড়িয়ে আছে কূপগুলো। জায়গাগুলোও চিহ্নিত ১নং কূপ, ২নং কূপ কিংবা ৫নং কূপ নামে। এসব ছাড়িয়ে হরিপুর বাজারে। জায়গাটা খুব জমজমাট। সবাই হাওড়ের নানান পাখি খেতে আসে। এর মধ্যে অতিথি পাখির সংখ্যাও কম নয়। বাইকারদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। নতুন ধরনের পাখি রান্না হলে এই বাজারের এক দোকানির কাছ থেকে আমার চেনা একজনের ফোনে কল যেতেও দেখেছি! এরা জীবে প্রেম নিজের জিভ দিয়েই করতে পছন্দ করে! অথচ বাজারের শেষ মাথাতেই লোকজনকে সচেতন করতে আর পাখি শিকার রোধে বেশ অনেকগুলো সাইনবোর্ড আছে। সাইনবোর্ডের লেখা বোর্ডেই থেকে যায়; পাশের বাজারের গাড়লদের কানে আর সেসব পৌঁছায় না।

হরিপুরের পরের অংশটা জনপদ আর দোকানপাটের দিক দিয়ে বিরান প্রান্তর। চায়ের তেষ্টা এখানে এসেই কিনা বেড়ে গেল। অথচ এই অংশে কোন দোকান নেই। বসতিগুলোও বেশ ভেতরে। এমনিতে চায়ের জন্য থামলে পথচলতি রাস্তার বাম দিকেই থামি। অনেকক্ষণ যাবত কিছুর দেখা না পেয়ে শেষে ডানদিকেও চোখ রাখতে শুরু করলাম। তাও কিচ্ছুটি নেই। থাকার মধ্যে আছে কিছুদূর অন্তর অন্তর যাত্রী ছাউনি। সেগুলোতে মাঝখানে মোবাইল রেখে বৃত্তাকারে বসে চারজন করে লোক লুডু খেলছে। টাকার বিনিময়েই খেলা হয়। শ্রীখেল বাজারে দোকান দেখেই থেমে গেলাম। চায়ের তেষ্টা মেটাতে গিয়ে দেখি গরমগরম শিং মাছ চুলা থেকে নামানো হচ্ছে। চায়ের ব্রেক রূপান্তরিত হলো ভাত ব্রেকে। ‘হোটেল আসা যাওয়া’তে হয়তো ফেরত আসার সময় খাওয়া হবে না। তাই যাওয়ার সময়েই খেয়ে নিলাম। শিং মাছটা দারুণ রান্না করেছে। অবশ্য দোকানের হুলো বেড়ালটা বড্ড জ্বালাল। শেষমেশ বাধ্য হয়ে একটা মাছ মেকুরটাকে গলাধঃকরণ করাতে হয়েছে।

আবার সাইকেলে চেপে দরবস্ত হয়ে সারিঘাটে। সারি নদীর সেতু পার হতেই হাতের ডানে দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকল। সমতল ফুঁড়ে যেন উঁকি দিচ্ছে মেঘালয়ের পাহাড়গুলো। সিলেটে আমার দশ তলার বাসা থেকেও পরিষ্কার দিনে মেঘালয়ের আকাশ দেখা যায়। রাতের বেলা মেঘালয়ের দুএকটা জনপদের বৈদ্যুতিক বাতিও চোখে পড়ে জোনাকির আলোর ন্যায়। তবে সে দেখায় আর এ দেখায় অনেক তফাত। সিলেটের বাসা থেকে দেখা পাহাড় কাছে টানে না। ওই পাহাড় যেখানে আছে সেখানেই থাকতে বলে। এই পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকে। জৈন্তাপুর বাজার ছাড়াতেই মেঘালয়ের পাহাড়ের বুক চিরে নামা বিশালাকার ঝরনাগুলো দৃষ্টি কেড়ে নিল। শ্রীপুর চা বাগানের কাছ থেকে আরো ভালোভাবে দৃশ্যমান হয় ঝরনাগুলো। নলজুড়ির পরেই নতুন একটা উপজেলাগোয়াইনঘাট। তামাবিল স্থল বন্দর আর পর্যটন স্পট জাফলং এর অবস্থান গোয়াইনঘাটেই। শেষ চড়াইটা পেরিয়ে প্রবেশ করলাম তামাবিল স্থল বন্দরে। ঘড়ির কাঁটায় তখন আড়াইটা। সীমানার শেষ মাথার পিলারে ছবি তোলার জন্য অনেকেই ভিড় করছে। ও পথ আর মাড়ালাম না। বড় ফটকটা পেছনে রেখে সাইকেলের একটা ছবি তুলে নিলাম। অবশ্য খানিক বাদে শ্রীমঙ্গল থেকে খাতুন, তানভীর আর বেনজীর আসায় সাইকেল সমেত নিজের একটা ছবি তোলার সুযোগ হয়ে গেল। চারদিনে প্রায় ৫৯৮ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে রাইডের এখানেই সমাপ্তি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধশুভ জন্মদিন সেহ্‌ঝিল