ভূপেন হাজারিকা (১৯২৬–২০১১)। উপমহাদেশের সংগীত অঙ্গনে অসাধারণ জনপ্রিয় একটি নাম ভূপেন হাজারিকা। তিনি ছিলেন একাধারে কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। তিনি ছিলেন সঙ্গীত জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেও ভূপেন সুখ্যাতি অর্জন করেন। আসামের সদিয়ায় ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ভূপেন হাজারিকার জন্ম। আসামেই কেটেছে শৈশব কৈশোর আর গানের সাথে সখ্য শৈশব থেকেই। মাত্র দশ বছর বয়সে অসমিয়া গান লিখে নিজেই তাতে সুর দেন। অসমিয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে একজন শিশুশিল্পী হিসেবে গানের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। পরবর্তীকালে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় গান গেয়ে ভারত এবং বাংলাদেশে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতা জরিপে তার ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ গানটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটি বাংলা গানের তালিকায় ২য় স্থান লাভ করে। পরবর্তী সময়ে গানের সুদীর্ঘ যাত্রাপথে অসংখ্য বাংলা ও হিন্দি গান গেয়েছেন। পেয়েছেন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। ১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ সম্পন্ন করে ১৯৫২ সালে নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ–ডি ডিগ্রি অর্জন করেন ভূপেন হাজারিকা। ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আসামের গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীসময়ে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে কলকাতা চলে আসেন এবং সংগীতে নিবেদন করেন নিজেকে। তাঁর গানের মূল বিষয়বস্তু মানবতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, সাম্য–সৌহার্দ্য। লোকগীতিকে তিনি উপস্থাপন করেছেন আধুনিকতার ঢঙে। তাঁর গানে প্রণয়, রাজনীতি, সমাজ প্রভৃতি বিষয় চমৎকারভাবে উঠে এসেছে নানা উপমায়। ভূপেন হাজারিকার গাওয়া বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘মানুষ মানুষের জন্য’, ‘আমি এক যাযাবর’, ‘বিস্তীর্ণ দু পাড়ের’, ‘পদ্মা আমার মা’, ‘দোলা’, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি’, ‘মোরা যাত্রী একই তরণীর’, ‘মেঘ থমথম করে’ ইত্যাদি। নিউইয়র্কে অবস্থানকালে বিশ্বখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, মানবতাবাদী পল রবসনের সাথে ভূপেনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাঁর ‘বিস্তীর্ণ দু পাড়ের’ গানখানি পল রবসনের ‘ওহ, ম্যান রিভার’ গানটির ভাববস্তুর ভিত্তিতে লেখা। তাঁর কণ্ঠ ছিল কোমল ও দরদী। কিন্তু তাতেও ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর, মানব প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত বাণী। ভূপেন হাজারিকা নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে: ‘রুদালি’, ‘গজগামিনী’, ‘দামন’, ‘ইন্দ্রমালতি’ প্রভৃতি। এছাড়াও বেশ কিছু চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে, পদ্মবিভূষণ [মরণোত্তর] সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ২০১১ সালের ৫ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।