বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেবের একটা বই আছে–নাম, “নিষ্ফলা মাঠের কৃষক”। এই বইটা স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে আগ্রহী পাঠকের জন্য must read বই। একটা শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্নিহিত নির্যাস অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন এর চর্চা কীভাবে নম্বর অর্জন, চাকরী অর্জন থেকে ব্যবসাতে পরিণত হল তার এক অভিজ্ঞতা প্রসূত মমর্ন্তদ বর্ণনা এই বই। অধ্যাপক আবু সায়ীদ তার ছাত্র থাকাকালীন শিক্ষকদের যে সাবলীল বর্ণনা দিয়েছেন তাতে পুরাতন শিক্ষকদের একটা নির্লোভ, নির্মোহ জ্ঞানাধারী চিত্র উপন্যাসের মত চিত্রিত। তার বিপরীতে স্যারের সমকালীন শিক্ষকরা শুধু যেন ‘বেতনভোগী’ মানুষ। অনেক ছাত্র শিক্ষকদের যেন চিনতেই চায় না। আবু সাঈদ সাহেব ছোটকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কিছু স্যারের পাঠদানরীতি, অভিভাবকসুলভ ব্যবহার ও জ্ঞানের আকর যেন জীবনেও ভুলবে না। সেই সব শিক্ষকদের স্মৃতি বায়োস্কোপের চিত্রের মতো বারবার মানসপটে ফিরে আসে। তার বিপরীতে তিনি স্বয়ং যেন নিষ্ফলা মাঠের কৃষক।
আমি নিজে শিক্ষক নই। আবু সায়ীদ সাহেবদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় গর্ব কাটিরহাট স্কুলের ও পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজের কিছু শিক্ষকের কাছে পাঠ নেয়া। এসব শিক্ষক সার্বিক অর্থেই জ্ঞান–তাপস। সাহিত্য হউক বা সাধারণ জ্ঞান বা বিজ্ঞান হউক স্কুল শিক্ষকদের কাছে যা শিখেছি তার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী জীবনের সব শেখা। আমার এসব শিক্ষকদের আমি বলব “সুফলা মাঠের কৃষক।”
স্কুলের শুরুতে ফেনী অঞ্চলের একজন জ্ঞানী হেডমাস্টার ছিলেন। নাম আবদুল মান্নান সাহেব। উনি চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ‘কালধারার’ শাহ আলম নীপু ভাইয়ের দাদা শ্বশুর। এই হেডমাস্টার ফেনী অঞ্চলের অনেক ছাত্রকে কাটিরহাট স্কুলে এনে ভর্তি করান। কারণ ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন ফেনীর স্কুল–কলেজ সেনা ব্যারাকএ পরিণত হয়। ফেনী থেকে আগত ছাত্রদের মাঝে নিপু ভাইয়ের শ্বশুর জাকির সাহেব ও ড্রাইডকের প্রাক্তন এমডি ইঞ্জিনিয়ার বাকীর বাবা জনাব বাকী অবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এর পরে কুমিরা অঞ্চলের শিক্ষাবিদ মামুন সাহেব ও আনোয়ারার নজির আহমদ দুইজন ধ্রুপদী শিক্ষক স্কুলের ছাত্রদের শিক্ষায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। মামুন সাহেবের বিশেষগুণ ছিল যে এভারেজ ছাত্রকে ভালছাত্রে ও ভালছাত্রকে বেশি ভালছাত্রে পরিণত করার টেকনিক। নজির আহমদ সাহেব সেই জমানার উচ্চতর গণিতকে গ্রামের ছাত্রদের কাছে কীভাবে সহজ ও আনন্দময় করতেন তা আজকের শিক্ষকদের জন্য শেখার ব্যাপার।
ষাটের দশকে দুইজন অসাধারণ শিক্ষক জনাব সাখাওয়াৎ হোসেন ও কুতুবদিয়ার আলমগীর সাহেব এই স্কুলকে ‘স্টেট অফ্্ আর্ট” প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। সাখাওয়াৎ সাহেব পরবর্তীতে কুমিল্লার ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলের প্রধান হন ও অগণিত টেলেন্টেড আর্মি অফিসার তার ছাত্র। সাখাওয়াৎ সাহেব স্কুলের মনন ও নৈতিকতাকে বিকশিত করেন। আর আলমগীর স্যার বেক–বেঞ্চারদেরকেও শুদ্ধ ইংরাজী শেখাতে পেরেছেন। আলমগীর সাহেব আমার বড় ভাইকে (মেট্রিকে ‘স্থান অধিকারী) এমন স্টান্ডার্ড ইংরেজি শিখিয়েছেন যে পরবর্তী কর্মজীবনে এত সুন্দর ইংরেজি ড্রাফট দেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও বিস্মিত হয়েছেন।
এর পরে কাটিরহাট স্কুলে এক ঝাঁক তরুণ বামপন্থী শিক্ষকের সমাবেশ ঘটে। এই শিক্ষকরা স্কুলের শিক্ষার মানকে উন্নত করতে নিরলস চেষ্টা করতেন। আবার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলও উন্নত করা ও চর্চা করায় ছাত্রদেরকে অবিরাম উৎসাহ যোগাতেন। স্কুলে মাসের শেষ বৃহস্পতিবার বিতর্ক প্রতিযোগিতা হত সমসাময়িক প্রসঙ্গের ওপর। এমনকি ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ছাত্রদেরকে বিতর্কের বিষয়ে পাঠ দিতেন।
ষাট–সত্তর দশকের শিক্ষকরাই কাটিরহাট স্কুলে ‘গোল্ড–যুগ’ সৃষ্টি করেন। প্রথমেই বলতে হয় নিম্ন শ্রেণির ব্যাকরণের শিক্ষক কালীপদ পণ্ডিত। পণ্ডিত স্যার ধুতি পরতেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণির গ্রামের ছাত্রদের কারক বিভক্তি নির্ণয় করতে দিতেন মেঘনাদ বদ কাব্যের পঙ্ক্তি থেকে।
“কি পাপে হারালু আমি তোমাহেন ধনে?
চল্ সখি লঙ্কাপুরে যাই মোরা সবে–ইত্যাদি।
এসময় ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির ব্যাকরণের জন্য অসাধারণ এক মহিলা পারুল বড়ুয়া ম্যাডাম যোগ দেন। এই ম্যাডাম প্রথিতযশা গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. প্রীতি বড়ুয়ার বড় দিদি। বোঝানোর এবং ব্যাকরণে পাশ করানোর মন্ত্র জানতেন পারুল ম্যাডাম। ইতিহাস এর ক্লাসও যে উপভোগ্য হতে পারে তার প্রমাণ ভারত চক্রবর্তী স্যারের পড়ানোর স্টাইলে। ভদ্রলোকের বাড়ি পটিয়া। সুধীর স্যার, জহুর স্যার–এরা গন্ড–মূর্খকে অংক শেখানোর কারিগর।
আমি এক গুচ্ছ নামী শিক্ষকের কাছে পড়েছি। এদের মধ্যে ছয়জন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট পদক পেয়েছিলেন। ইংরেজিতে সুরেশদেব, আকতার স্যার, বদিউল আলম স্যার। বাংলায় নৃপেনদের স্যার, হৃদয় বিকাশ মহাজন স্যার ও মোসলেহউদ্দিন স্যার, বিজ্ঞানে কুতুবদিয়ার মোজাম্মেল স্যার। ইংরেজিতে হাশেমস্যার। এই শিক্ষকগুলো আসলেই সুফলা মাঠের কৃষক। নৃপেনদের হচ্ছে প্রখ্যাত গীতিকার পংকজদেব অপুর বাবা, মজার ব্যাপার হচ্ছে অপু বাংলার অধ্যাপক। আমি বাংলা কোন রেফারেন্স তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে–বাবা তো আমাকে পড়িয়েছে, আর শিখায়েছে আপনাকে। পরবর্তীতে নৃপেন স্যার ও মোসলেহ উদ্দিন স্যার সারা বাংলাদেশে স্কুলে পাঠ্য একটা ব্যাকরণ বই রচনা করেন।
মোসলেহ উদ্দিন সাহেব হাস্য রসে মিলিয়ে বঙ্কিম গদ্য, প্রমথ চৌধুরী আর রবীন গল্প পড়াতেন। পরবর্তী এই স্যার ইউএনও হয়েছিলেন। হৃদয় বাবু আর মিত্র বাবু (আনোয়ারা) স্যার আধুনিক ভাষার কারিগর। বিজ্ঞান পেটে ঢুকিয়ে দেয়ার স্যার মোজাম্মেল স্যার। পরবর্তীতে শহরে সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
নৃপেন দেব স্যার সম্বন্ধে বলতে হলে অনেক পৃষ্ঠা লাগবে। আমাকে বাংলা গ্রামার এর কতগুলো সংজ্ঞা ও উদাহরণ শিখিয়ে বলতেন– এগুলো তুই আর আমি ছাড়া আর কেউ পারবে না। উনার আমার জন্য হিসাব সোজা। ব্যাকরণের ৪০, দুই রচনায় ৩০–৩৫, এদিক সেদিক ১০। অতএব বাংলা ২য় পত্রে লেটার পেতেই হবে। হৃদয় মহাজন স্যার এর আধুনিক বাংলায় ১ম পত্রে এমনভাবে সম্ভাব্য প্রশ্নের নোট তৈরি করে দিতেন যে– হেড এক্সামিনারেরও এক্সামিনারের মাথা ঠিকই চক্কর দিত–গ্রাম–গঞ্জে এই ‘মাল’ কোত্থেকে আসল?
বাংলা প্রথম পত্রের শিক্ষক দুইজন। শ্রেণির প্রথম তিনজনের কোন প্রশ্নের উত্তর এক রকম হতে দিত না। এটা আমাদের জন্য আরেক ফ্যামাদ ছিল। এসএসসি পরীক্ষায় নৃপেন স্যার আর হৃদয় স্যার সপ্ত আকাশ থেকে বাংলায় লেটার পাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল। রচনা শিখি বর্ষাকাল, মহামানব, পাট, গরু, ইত্যাদি। হৃদয় স্যার প্রশ্ন বিতরণের পরই কানে কানে বলে গেলেন– খবরদার! ওসব রচনা লিখতে পারবি না। কোনটা লিখব স্যার? তুই লিখবি ‘ভোরের আযান’, ‘চাঁদ আর স্বপ্ন নয়’ (মানুষের প্রথম চন্দ্রে অবতরণ)। কি দিয়ে শুরু করব এই আন–পড়া রচনা? কানে কানে দুটো কবিতা বলে দিলেন। ফল যা হবার তাই হল। হেড–এক্সামিনার ছিলেন বাংলার অন্যতম দিকপাল সৈয়দ আলী আহসান! (তখন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও স্কুল পরীক্ষার হেড এঙামিনার থাকতেন) উনিও ধরে বললেন–মফস্বলে এই ‘মাল’ কোত্থেকে এলো? যা–হোক লম্বা ঘটনা। এখানে না–ই বললাম। এই শিক্ষকগুলোর জ্ঞান হাতে নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হই। এখন ১০/১২ জন গ্রুপ করে ‘টিউটরিয়েল ক্লাস হতো।’ আমার বাংলার স্যার ছিলেন অধ্যাপক তাহের স্যার, ইংরেজির স্যার ছিলেন অধ্যাপক রনজিৎ চক্রবর্তী। উনারা দুজনই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, তোকে স্কুলে কে পড়িয়েছে। আমি সগর্বে নৃপেন স্যার, হৃদয় স্যার, আকতার স্যার, মোসলেহউদ্দিন স্যারদের নাম বলতাম। পরবর্তীতে কলেজে বিজ্ঞানের পেপারগুলোতে ভাল ছাত্রদের মাঝে ২–৪ নম্বরের পার্থক্য থাকত! আমি হয়তো এই নম্বরের ক্রমে পিছিয়ে যেতাম। কিন্তু তুরুপের তাস ছিল ইংরেজি–বাংলার চার বিষয়–যার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল কাটিরহাট স্কুলের সুফলা মাঠের কৃষকরা। আমার তুরুপের তাস ছিল এই শিক্ষকদের ভাষা–যা যুৎসই কাজ করতো। অবশেষে শ্রদ্ধা সেই সব জ্ঞান তাপসদের! লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক।