ভূগোলের গোল

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ৮ জুন, ২০২১ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

হজ বন্ধ: ইতিহাস পরিক্রমা
সৌদি সরকার বিগত বছরে বাইরের নাগরিকদের হজ করতে অনুমতি দেয়নি। এ বছরেও হজের অনুমতি দিবে কিনা সন্দেহ। এই দুইবার মহামারী জনিত কারণে অন্য দেশের নাগরিকদের হজ পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না। হজ ইসলামের অবশ্য করণীয় পাঁচ বিষয়ের একটি, স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্ব মুসলিমের এটা আবেগের বিষয়। আবার সৌদি সরকারের মুসলিম নেতৃত্বের প্রশ্নের সাথে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের বিষয়ও সম্পর্কিত। তবে মজার বিষয় হচ্ছে যে বর্তমান বিপদ বোধগম্য কারণে এবং ইসলামী চিন্তাবিদরা স্বাস্থ্যবিধি ও মহামারীর ব্যাপকতার জন্য সৌদি সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে কোন ধর্মীয় বিরোধ দেখছে না। তবে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে মক্কা ও মদিনার পবিত্র মসজিদ দুটো ঘিরে কয়েকবার বিপদ এসেছিল। যার কারণে হজ বন্ধ ছিল। এসব কারণ ছিল কিছুই ইসলামের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, কিছুটা পুরোপুরি রাজনৈতিক, এসব ঘটনা থেকে উত্তরণ হওয়া মানে আবারও প্রমাণ করে ইসলাম ও মসজিদকে রক্ষা করার মালিক স্বয়ং আল্লাহ। মানুষ চেষ্টা তদবির করতে পারে মাত্র। বিভিন্ন বর্ণনায় এ পর্যন্ত ৪০ থেকে ৪১ বার হজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়। প্রথমবার বাতিল হয়েছিল ৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের সাথে ইসমাইল ইউসুফের বিরোধের কারণে। ইসমাইল মক্কা আক্রমণ করেও আব্বাসীয়রা বাগদাদে অবস্থান করতেন। এই দুই গ্রুপের বিবাদে কয়েক হাজার হাজী নিহত হয় ও হজ বন্ধ হয়ে যায়। ৯৩০ থেকে ৯৪০ একনাগাড়ে ১০ বছর হজ বন্ধ ছিল। ৯৩০ সালে কারমাতিয়ান নামে শিয়া গ্রুপ জবলের রহমতে হামলা চালায় বাহারাইন থেকে এসে ৩০,০০০ হাজীকে কারমাতিয়ানরা হত্যা করে। অনেক মৃতদেহ তারা জমজম কূপে ছুঁড়ে মারে। ৯৮৩ থেকে ৯৯১ এই আট বছর হজ হয়নি। আব্বাসীয়রা বাগদাদে খেলাফত করতেন। ফাতেমিও মিশরে উত্তর আফ্রিকায় খেলাফত করতেন। দুই রাজ পক্ষের রেষারেষি যুদ্ধে পরিণত হয়। এই যুদ্ধ শিয়া সুন্নী যুদ্ধ ছিল। মিশরে ফাতেমিওরা আলী (রা:) ও বিবি ফাতেমা (রা:) বংশ পরম্পরায় দাবী করতেন। ওরা বাগদাদের আব্বাসীয়দের থেকে বেশি ক্ষমতাবান ছিল। এরা মক্কা বিজয় করে হজের আসওয়াদ পাথরও তুলে নিয়ে যায়। সৌদিরা অর্থাৎ মক্কার কেয়ারটেকাররা বহু টাকা দণ্ড দিয়ে হজের আসওয়াদ ফিরিয়ে আনে ও আবার হজ শুরু করে। ৯৬৭ সালে মক্কায় প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পরে মানুষসহ বহু পশু পাখি মারা যায়। আবার হজ বন্ধ হয়ে যায়। ১২৫৬ থেকে ১২৬০ পর্যন্ত প্রতিবেশী মুসলিম শাসকদের রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে পাঁচ বছর হজ বন্ধ থাকে। এ সময় শুধু হেজাজ এর লোকেরা হজ করার অনুমতি পায়। ১৮৩১সালে ভারতীয় হাজিরা প্লেগ ছড়িয়ে দেয় ৩-৪ ভাগ হাজী মারা যায় ও হজ বন্ধ রাখা হয়। ১৮৩৭-১৮৫৮ পর্যন্ত মহামারীর কারণে হজ বন্ধ ছিল। সীমিত আকারে ৭ বার হজের অনুমতি দেওয়া হয়। ১৮৩৭, ১৮৪৬, ১৮৫৮ সালে মক্কায় কয়েক দফায় কলেরা দেখা দেয় ফলে হজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১২ ও ২০১৩ সালে করোনাভাইরাস এর পূর্বসূরী সবৎং ভাইরাস দেখা দেয়। সৌদি আরবসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যের তখন অসুস্থ বয়স্কদের হজ থেকে বিরত রাখা হয়।২০১৭ সালে কাতারের ১৮ লক্ষ মুসলিমকে হজ করতে দেওয়া হয়নি।
ইরানের মুসলিমদের হজ করতে দেওয়া হয়নি। এছাড়া ৬২৯ সালে আরাফাত ময়দানে হত্যাযজ্ঞ হয় হজ বন্ধ হয়ে যায়। আবার মদিনার মসজিদে নববী সহ মদিনায় ইয়াজিদ বিন মাবিয়া-সৈন্যরা ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়, বহু নিহত হন ও বহু মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। মসজিদের বারান্দায় ইয়াজিদের সেনাবাহিনী ঘোড়ার আস্তাবল করে। চারদিন মসজিদের নববিতে নামাজের আজান হয়নি। প্রকাশ্যে একজন সাহাবী মসজিদ আটকা ছিলেন। উনি পবিত্র রওজা মোবারক থেকে আযানের আওয়াজ শুনে নামাজ পড়তেন। এসবই মুসলিম বিশ্ব অতিক্রম করেছে কোন রোগ যুদ্ধই ইসলামের আলো নেভাতে পারেনি। প্রতি বিপদের পরেই মসজিদ ও ইসলামের রক্ষাকারী স্বয়ং আল্লাহ আবার স্বমহিমায় মক্কা-মদিনায় নামাজ ওমরা পুনঃ চালু করেছেন। বর্তমান দুঃসময় ও নেহায়েত সাময়িক ইতিহাসের অতীত সমস্যা মহামারী যেমন দূরীভূত হয়েছে তেমনি বর্তমান মহামারী ও আল্লাহর বিশাল নৈপুণ্য বিজ্ঞান এর কাছে পরাজিত হবেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিকল্প পাঠদান পদ্ধতি উদ্ভাবন জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধকখনো কারও মতো হতে চাইনি