ভারত : করোনার নতুন ঢেউ
এক এক ঘটনা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ইতিহাস প্রবাহ বদলে দেয়, মহামারী করোনা তেমনি পৃথিবীর কয়েকটি দেশে দৃশ্যমান ছাপ রেখে যাচ্ছে। ছোট্ট দেশ হলেও নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা যেভাবে নিজ দেশকে করোনা মুক্ত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছেন গোটা বিশ্ব অবাক হয়ে তা দেখেছে। এক সমীক্ষা চালানো হয় পৃথিবীর ১৮০ দেশে-তারা কেমন রাষ্ট্রনায়ক চান? প্রায় সব দেশের নাগরিক রায় বলেছেন তারা নিউজিল্যান্ডের জেচিন্ডার মত রাষ্ট্রপ্রধান চান।
করোনা আবার তিনজন রাষ্ট্রপ্রধানকে দারুণ বিপদে ফেলেছে, করোনার প্রথম বলি পপুলিস্ট লিডার ডোনাল্ড ট্রাম্প, দ্বিতীয় বলি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারো। এরা নিজের দেশে করোনার আক্রমণকে হেসে খেলে প্রতিহত করতে গিয়ে দেশের ও জনগণের বারোটা বাজিয়েছেন।
করোনার শেষ বলি নরেন্দ্র মোদি। পপুলিস্ট লিডারগণ জনগণের কথা কমই শুনেন, নিজেকে মহিমান্বিত করার সব প্রয়াস করেন, কিন্তু মাঝে মাঝে প্রকৃতি নিজেই কিছু একটা করে বসে যাতে পপুলিস্ট নেতাদের প্রকৃত মুখোশ উন্মোচিত হয়। করোনার প্রারম্ভে মোদি প্রশাসন বৈজ্ঞানিকদের কথা ও পরামর্শের পাত্তাই দেয়নি। উপরন্তু ঘরে ঢোকার কিছু বৈদিক পরামর্শ, শঙ্খ কাঁসার ধ্বনি, হাততালি ইত্যাদি বিজ্ঞান নয় এমন পরামর্শ দিয়ে জাতির অবিজ্ঞানমনস্থতাকে আরো উস্কে দেয়।
যাহোক, বর্ষব্যাপী গোটা বিশ্বে প্রথম করোনা ঢেউ হালকা হওয়া শুরু করে। এটাও তাদের কৃতিত্ব জাহির করে। ২০২১ সালের ২৯ শে জানুয়ারি DAVOS সম্মেলনে মোদির দম্ভভরে গোটা বিশ্বকে জানান দেয় যে, ভারত সরকার করোনাকে পরাজিত করে। সেই দিনও দৈনিক সাড়ে তিন লাখ এক্টিভ কেস হচ্ছিল।
হঠাৎ এপ্রিলের ২১ থেকে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অপ্রত্যাশিতভাবে মোড় নেয়, কেউ বলছে what went wrong কোথায় ভুল হয়েছে। ভারতীয় পত্র-পত্রিকা এখন পরিস্থিতির ও মোদি প্রশাসনের করোনা যুদ্ধের পোস্টমর্টেম করেছেন।
WORLD VIEW পোস্টে ভারতীয় সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার বর্তমান করোনা বিপর্যয়ের জন্য ভুল কূটনীতিকে দায়ী করেছেন। এখানেও সরকারি পরিসংখ্যানকে মিডিয়া চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছে।
ভারত ভ্যাকসিন মুক্তি প্রোগ্রামের আওতায় ৬৬ মিলিয়ন ডোজ কভিড-১৯ ভ্যাকসিন পাঠায় ৯৫ দেশে। তার মধ্যে ১০ মিলিয়ন উপহার, ২০ মিলিয়ন WHO কে ও ৩৬ মিলিয়ন বিক্রি করে।
চীন ৮০ মিলিয়ন ভ্যাকসিন পাঠায় ৬০ দেশে তাও নিজের প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন নিশ্চিত করার পর, দুর্ভাগ্যবশত দুনিয়ার ্তুসুপারপাওয়ার্থ হওয়ার নেশায় চায়না কে হঠাতে নিজের প্রয়োজন নিশ্চিত না করেই মোদি সরকার বৃহৎ জাহির করতে থাকে। ভারতের ভ্যাকসিন উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর ও নিরবচ্ছিন্ন করার জন্য করোনাকালীন সময়ের জন্য ভারত থেকে ঔষধ উৎপাদনের TRIP ও তুলে নেওয়া হয়। WUAD প্ল্যান দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোকে ভারত ১০০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা, বাস্তবে এর কিছুই করতে পারছে না। বর্তমান ভারতের মহা দুর্যোগ অবস্থায় US State dept: মুখপাত্র কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন আমেরিকা ভারতকে টীকা ও টীকা উৎপাদনের কাঁচামাল দিচ্ছে না? উত্তরে ওই মুখপাত্র বলে আমেরিকার জরুরি স্বার্থ হচ্ছে সকল মার্কিনী যেন ভ্যাকসিন পায়। এতে গোটা বিশ্বরই উপকার।
এখন আসা যাক ভারতে বর্তমান মহাপ্রলয় নিয়ে মোদি প্রশাসন বিশ্বকে দেখানোর জন্য সব – বিধিনিষেধ ঢিলেভাবে নেয়। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হয় উত্তরখণ্ড রাজ্যে মার্চ মাসে ৩৫ লক্ষ মানুষের গঙ্গাস্নান। তারপর ভারতের কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন ও মোদি প্রশাসনের ইচ্ছে অনুযায়ী ৮ দফায় পশ্চিমবাংলা নির্বাচন। শুধু তামিলনাড়ুতে ১৩৫ জন নির্বাচনী কর্মকর্তা কভিডে মারা যায়। প্রধানমন্ত্রী, অমিত সাহা বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে জনসভা করেছেন যার প্রত্যক্ষ ফল পশ্চিমবাংলায় ব্যাপক করোনা বৃদ্ধি।
গত অক্টোবরে ২০২০ মহারাষ্ট্র B1 617 ধরনের দুইটি মিউট্যান্ট এর করোনা ধরা পড়ে । আবার দিল্লিতে B1 617 বা তিন মিউটেন্ট এর করোনা শনাক্ত হয়। আবার L4S2R ও E484K ইমিউন এসকেপ
ভেরিয়েন্ট ভাইরাস ধরা পড়ে। অর্থাৎ শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এড়িয়ে তারা ফুসফুসে ঢুকে যায়, এসব নতুন ভারতীয় ভাইরাসের মোকাবেলা ভারতের ছিল না। যার ফলশ্রুতি আজকের এই অবস্থা।
অক্সিজেনের সংকট নিয়ে সরকারি পরিসংখ্যান ও মিডিয়ার তথ্য এর মাঝে বিরাট গ্যাঞ্জাম। ভারতে চলছে অক্সিজেনের হাহাকার। কিন্তু ১৪ টি দেশে ভারতের অক্সিজেন রপ্তানি শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে করোনাকালীন সময়ে, সরকার বলছে এটা শিল্পের অক্সিজেন। মেডিকেল অক্সিজেন রপ্তানি করেছে মোট উৎপাদনের মাত্র ০.৪%, মিডিয়ার প্রশ্ন তাহলে বাকি মেডিকেল অক্সিজেন গেল কই।
বর্তমানে ভারতে প্রতি ১০০ জনে ১০ জন ভ্যাকসিন নিতে পেরেছে, তাহলে হঠাৎ করে ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি কারক থেকে আমদানি কারক দেশে পরিবর্তিত হয়ে গেল।
এখন প্রশাসনের প্ল্যানিং দূরদর্শিতা ও সততার একটা প্রশ্ন রয়ে গেছে, দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কেরালার কমিউনিস্ট সরকার প্রথম ধাক্কায় সারা দেশের ছোট-বড় সব হাসপাতাল এ কত অক্সিজেন লাগতে পারে তার একটা হিসাব করা হয়, ছয় মাসের মধ্যে কেরালার তিনগুণ বেশি অক্সিজেন প্রস্তুত হচ্ছে।
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পপুলিস্ট রাজনীতির মতো হ্যান্ডেল করতে আজকের এই অবস্থা।
ভারতের অবস্থা থেকে আমাদেরও শেখার আছে নরমাল অবস্থা, দুর্যোগ অবস্থার প্লানিং ও বাস্তবায়ন, বাংলাদেশ ঔষধ শিল্পের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমরা ভ্যাকসিন প্রস্তুতিতে এখনো তাদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারিনি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সবার বুদ্ধি, পরামর্শ প্রয়োজন। কেরালা একমাত্র রাজ্য যেখানে দ্বিতীয় ধাক্কার জেরে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কিভাবে মানুষ চলবে, দোকান চলবে, অনুষ্ঠান চলবে, চিকিৎসা চলবে। এটাও একটা শিক্ষ্যণীয় ব্যাপার।
লেখক : কলামিস্ট, চিকিৎসক।