ভূগোলের গোল

ডা: কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ১৯ অক্টোবর, ২০২১ at ৭:২৩ পূর্বাহ্ণ

আ-মরি বাংলা-ভাষা। লেখাপড়া করেছে অথচ ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ স্লোগান শোনেননি এমন বাংলাদেশি বিরল। আমাদের স্কুল জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে বলা হত ‘শহীদ দিবস’। একুশে ফেব্রুয়াারি গ্রামগঞ্জেও প্রভাতফেরী হত। এখন বলা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এখন প্রভাতফেরি কম, বেশি হয় লাইনে দাঁড়িয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক প্রদান। ভাষার প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি আপামর জনগণের ভাষা-প্রেমের আনুষ্ঠানিকতা, জৌলুস বিগত সত্তর বছরে বহু বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাকি ৩৬৪ দিন ঘরে-বাইরে বাংলার কদর ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আবার ছোট কাল থেকে অদ্যাবধি ফেস্টুন, ব্যানারে ব্যবহৃত ‘আ মরি বাংলা ভাষা’-কথাটা কার? এটা কি কবিতা-ছন্দ, না গানের কলি তা জানা লোকও দুষ্প্রাপ্য। আ-মরি মানেই বা কি? যা-হোক বাংলা ভাষার যে দুর্গতি তার এফেক্ট থেকে আমিও ব্যতিক্রম না। তবু ও পাঠকের জ্ঞাতার্থে বলতে হয়- আ একটা অব্যয়। মরি র আগে ব্যবহারের ফলে ‘আ মরি’র কাব্যিক অর্থ দাঁড়ায় আশাবাদ, আবেগ, সুখ বোধ প্রকাশ। এই পংক্তিটা অতুল প্রসাদ সেন রচিত একটা গানের কলি।
একুশে ফেব্রুয়াারি বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই দিবসের বর্তমান গুরুত্ব মাতৃভাষায় শিক্ষাদান বিষয়ে সব রাষ্ট্রকে সচেতন করা বিষয়ে। মরণঘাতী রোগ যেমন কোনো ব্যক্তিকে ক্রমান্বয়ে জীবনের সঞ্জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে, তেমনি ৫২ থেকে অদ্যাবধি মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যাপারটা সবার অজান্তে অথবা অবহেলায় অথবা নিস্পৃহতায় লয়ের শেষ প্রান্তে। বাংলাদেশে যেখানে বাংলা ভাষায় শিক্ষার বিস্তার হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক সেখানে ইংরেজি শিক্ষার স্কুলের দ্রুত বিস্তার সত্যিই একটা ফরঃবসধ বা দৈব ব্যাপার। এখন বাস্তবতা হলো রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী কারো সন্তান-সন্ততি বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে না। খুব অল্প সংখ্যক বিত্তবানদের সন্তানরা বাংলা মাধ্যমে পড়তে যায়। এটা রীতিমতো গবেষণার বিষয়।
এযাবত ১৮৫৪ সালের ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা ব্যবহার সম্মিলিত ড়িড়ফং ডেচ পাচ থেকে ২০০৯ সালের টঘঊঝঈঙ র জরমযঃ ঃড় ঊফঁপধঃরড়হ নিয়ে ক্রোড়পত্র -সবাই মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের সুপারিশ করেছে। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্ব নিয়ে ভারতের টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্স হায়দ্রাবাদের শৈলজা মেনন ২০১৮ সালে এক প্রবন্ধে বিগত ৪০-৫০ বছরে ২০০ গবেষণার উল্লেখ করে বলেছেন যে, শিশুদের নৈতিক-মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতা কেবল মাতৃভাষায় শিক্ষার মাধ্যমেই হয়। ২০২০ সালে ১৭ই আগস্ট অক্সফোর্ড ভার্সিটি এক বৃহৎ গবেষণার ফল প্রকাশ করে। যে সমস্ত শিশু মাতৃভাষায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া করে তারা উচ্চশিক্ষায় ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ুয়া ছাত্রদের থেকে ড়ঁঃ চবৎভড়ৎস (এই শব্দটাই গবেষণার ফলে ব্যবহৃত হয়েছে) বা বেশি ভালো করে। টরন্টের ভার্সিটি অধ্যাপক জিম কামিনস ও পি. শ্রী নায়ার বাংলাদেশের ৬৩০৪১ সরকারি প্রাথমিক স্কুলের ও মাধ্যমিক স্কুলের বাংলা মিডিয়ামে পড়া ছাত্রদের সাথে ৫০০ ব্রিটিশ কাউন্সিল রেজিস্টার্ড স্কুলের ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়া ছাত্রদের বুদ্ধিবৃত্তিক গ্রহণযোগ্যতা, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা, শিশুর স্বাভাবিক আনন্দ ইত্যাদি বিষয়ে তুলনা করেছেন। টরেন্টো গবেষণায় সুনির্দিষ্টভাবে নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত মাতৃভাষায় পাঠদান করলে পরবর্তীতে তারা ইংরেজি বা অন্য দ্বিতীয় ভাষা রপ্ত করে সহজে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বুনিয়াদি (নধংরপ) উৎকর্ষতার ফলে পরের শিক্ষা জীবনে তারা সহজেই বিষয়গুলো রপ্ত করে ভিন্ন ভাষায় পাঠ গ্রহণকারী ছাত্রদের থেকে ভালোভাবে।
বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের পরে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। ওই একই সময় শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর সব দেশেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়ার বিস্তৃতি ঘটে। এই প্রবণতা বেশি উপমহাদেশ, আফ্রিকা ও পূর্ব এশিয়ায়। বাংলাদেশের ২০১০ সাল পর্যন্ত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ব্যাপক প্রসার নিয়ে গবেষণা করেন জাপানের হিরোশিমা ভার্সিটির মানজুমা আক্তার ও প্রফেসর তাতসুয়া ফুচাকাবে। তাদের গবেষণার শিরোনাম ছিল চৎড়ভরষব ড়ভ ঊহমষরংয সবফরঁস ঝপযড়ড়ষ ্‌ ইধহমষধফবংয. হিরোশিমা ভার্সিটির দল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র ও অবিভাবকদের থেকে কয়েকটি চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছেন। কেন ছাত্র ও অবিভাবকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান। ছাত্রদের মধ্যে ঃ
বিদেশে উচ্চ ডিগ্রী নিতে চায় ৯২% , দেশে উচ্চ ডিগ্রী নিতে চায় ৮% , বিদেশে স্থায়ী বসবাস করতে চায় ৮১% ,দেশে থাকতে চায় ১৯%, বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি চায় ৮৭% , দেশীয় বা সরকারি চাকরি চায় ১৩% , অভিভাবকরা কেন সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ান? উত্তরে তারা যে কারণগুলো বলেছেন-
১. সরকারি স্কুলের মান সন্তোষজনক নয়, ২. সামাজিক স্ট্যাটাস, ৩. কম ছাত্র , ৪.বিদেশে উচ্চতর পড়াশোনা। ৫. বিদেশে ইমিগ্র্যান্ট হওয়া।
আমাদের দেশে এ পর্যন্ত ৭-৮ শিক্ষা কমিশন হয়েছে। প্রত্যেকটাতে নির্দিষ্ট স্তর ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একমুখী শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। তারপরে পছন্দ অনুযায়ী অন্য ভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলা হলেও জনগণ এর মাঝে ইংলিশ মাধ্যমে শিক্ষার জন্য এক অপ্রতিরোধ্য ‘ক্রেজ’ তৈরি হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে এরকম সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তখন নেলসন ম্যান্ডেলা জীবিত ছিলেন। উনি বলেছিলেন, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিখলে ছাত্রদের যবধৎঃ এ যায়। আর ইংলিশ ভাষায় শিখলে তা শিশুদের ইৎধরহ-এ যায়। আমাদের দেশে একটি যুগান্তকারী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ক্লাস পর্যন্ত আপামর শিশুদেরকে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রশ্নটি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। তার প্রধান কারণ ্তুএলিটিজম্থ বা অভিজাততন্ত্র কিন্তু অনুকরণ এর ধাক্কায় মধ্যবিত্তরাও নিজেদের শিশুদের যুক্তিযুক্ত প্রবৃদ্ধি জলাঞ্জলি দিচ্ছে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। যে কেউ কোন্‌্‌ মাধ্যমে পড়বে, দেশে না বিদেশে স্থায়ী হবে এগুলো নিজস্ব স্বাধীনতার ব্যাপার।
এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার যে, যে জাতি সর্বস্তরে বাংলা চালুর জন্য প্রাণ দিয়েছে সে জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের উন্মুখ, ইংরেজি শিক্ষা গ্লোবাল কানেকশনের জন্য প্রয়োজন সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই, কিন্তু কোমলমতি শিশুদেরকে কোন ক্লাসের পরে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত একমাত্র সরকারই দিতে পারে। সমস্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলে ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ-৭ম ক্লাস থেকে সব বিষয় অন্য মাধ্যমে পড়ালে বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নে সমস্যা হয় না। কিন্তু এদেশে কে কার কথা শোনে। হুজুগ বা ‘অভিজাততন্ত্র’ পুরো প্রজন্মকে অধ:জ্ঞানী করছে একদিকে, অপরদিকে ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ নিভৃতে বিস্মৃতির সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে।
ডা. কিউ এম অহিদুল আলম : লেখক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবারণার ধর্মীয় ব্যাপ্তি ও তাৎপর্য
পরবর্তী নিবন্ধচৌধুরী হারুনর রশিদ : একজন বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ