হেলথ ক্যাপিটালিজম
চকচক করলেই সোনা হয় না। একথায় কোন বিতর্ক নেই, তেমনি WHO স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিকে মানুষের মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণাও উপরোক্ত প্রবাদ এর মত। গরিব ধনী বিশ্বের সব দেশেই স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক অধিকার ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে অথচ নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকার পৃথিবীর গরিব দেশ দূর করেন অনেক ধনী দেশই নিশ্চিত করেনি। ধনতন্ত্রের আওতায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা ঝুঁকিতে তার চাক্ষুষ প্রমাণ ঘটেছে সাম্প্রতিক করোনা আক্রান্তের সময়ে। ইতালি ও স্পেন যখন করোনায় মৃত্যুর সংখ্যার ঊর্ধ্বগতির লম্ফনে দিশেহারা তখন তারা সাহায্য প্রার্থনা করে কমিউনিস্ট দেশ কিউবার কাছে, যে কিউবা সম্বন্ধে ধনতন্ত্র মিডিয়া হেন কোন নেগেটিভ প্রচারণায় লিপ্ত ছিল না। সেই কিউবা ২৪ ঘণ্টার নোটিশে তিনশত ডাক্তার পাঠিয়ে দেয় ইতালি ও স্পেনে। ডাক্তাররা শহরের কেন্দ্রে মার্চ করার শর্ত দেয়। সেই অনুযায়ী রোম ও মাদ্রিদে যখন কিউবান ডাক্তাররা মার্চ করে তখন ইতালি ও স্পেনের মানুষরা বাসার ব্যালকনি থেকে করতালি দিতে থাকে। তারা ভাবতে থাকে কিউবা আবার কোন দেশ? এতদিন কিউবা সম্বন্ধে কি শুনে আসছে আর এখন কিউবার ডাক্তার এসেছে করোনার মৃত্যুর কাফেলা রোধ করতে। আরও মজার বিষয় হচ্ছে যে, WHO করোনায় মৃত ব্যক্তির পোস্টমর্টেম নিষেধ করেছিল কারণ এতে সংক্রমণ আরো ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু রোগ শরীরের অঙ্গে কোথায় কি রকম ক্ষতি করেছে তা জানার জন্য পোস্টমর্টেম ছাড়া কোনো গতি নেই। কিউবান ডাক্তাররাই WHO এর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইতালিতে প্রথম পোস্টমর্টেম করে। তখনই ফুসফুসে ব্যাপক ক্ষতির কারণ ও CYTOKINE STROM (এক ধরনের রাসায়নিক হরমোন যা অতিমাত্রায় নির্গত হয় ভাইরাস আক্রমণে) এর ধারণা জন্মে। আর তখন থেকেই করোনা চিকিৎসায় একটা বিশ্বব্যাপী নীতিমালা জানতে পারে ডাক্তাররা।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে প্রথম ‘হেলথ ক্যাপিটালিজম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। শ্রেণী বৈষম্য ধনবাদী সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিছু রোগ ধনী-গরিব সবার হয়, আবার কিছু রোগ নিম্ন আয়ের মানুষদের বেশি হয়। আবার মানুষের হাতে যখন রোগ প্রতিরোধের এমন জ্ঞান ছিল না তখন রোগ ধনী-গরিব সবাইকে মেরেছে। যেমন, ১৬৯৪ সালে বিলাতের রানী মেরী বসন্ত রোগে মারা গিয়েছিলেন। তার ১৭০ বছর পরে ১৮৬১ সালে ভিক্টোরিয়া রানীর স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট (যার নাম অনুসারে রয়েল অ্যালবার্ট হল) টাইফয়েড রোগে মারা যান।
রোগের উপর ধনবাদের কেমন প্রভাব তা দেখতে হলে ডাক্তারদের চেম্বার এ গেলেই হয়। বর্তমান যুগে অনেক রোগের চিকিৎসা আছে কিন্তু পয়সার অভাবে সুচিকিৎসা না মিলায় কেউ মরছে, আর কেউ সব আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে থাকছে। কথাটা এখানেই। স্বাস্থ্য যদি মৌলিক অধিকার হয় তবে সবাই স্বাস্থ্য সেবা পাবে না কেন?
তাহলে স্বাস্থ্য সেবার দুটো দিক। একটা পয়সায় কেনা, আরেকটা রাষ্ট্রীয় সেবা। ধনবাদের মূলমন্ত্র “মুনাফা ও প্রতিযোগিতা”। এই মুনাফা ও প্রতিযোগিতার কারণে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা বিরাট ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। ধনবাদী এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বৈষম্য নিয়ে প্রায় একশ বছর ব্যাপী রিপোর্ট নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ১৯৮০ সালে বিলাতের সরকার। এটাকে বলা হয় Black Report. মার্গারেট থ্যাচার সরকার এই রিপোর্ট সরিয়ে ফেলে। বিলাতই প্রথম ধনবাদই দেশ যেখানে ১৮৫১ সাল থেকে সরকার স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে আসছে। আমাদের দেশের গ্রাম গঞ্জের অসংখ্য হেলথ সেন্টার সেই ব্রিটিশ আমলের ধারাবাহিকতা।
শুধু টাকা থাকলেই হবে না, স্বাস্থ্যসেবার যে মৌলিক অধিকার তা মেনে এবং কিভাবে দেবেন তার উপরে নির্ভর করে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কার্যকারিতা। ধরুন আমেরিকা অনেক ধনী দেশ। ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি ও সিঙ্গাপুর এবং আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে অনেক তুলনামূলক আলোচনা আছে। এই কয়েকটা উন্নত দেশে এক এক মেকানিজমে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয় এই কয়টা দেশে সবচেয়ে খারাপ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হচ্ছে আমেরিকার।
কানাডায় নাগরিকদের প্রেসক্রিপশনসহ সরকারের খরচ ৭০%, বিলাতে ৮০% খরচ সরকার বহন করে। বিলাতে স্বাস্থ্যসেবায় প্রাইভেট হাসপাতালের অবদান ১০% এর মধ্যে সীমিত। ফ্রান্সে অত্যন্ত সুন্দর একটা স্বাস্থ্য ইন্সুরেন্স ব্যবস্থা আছে যা আমেরিকার মত Profit mongering (মুনাফা লোভী) নয়। ফ্রান্সের সরকার ট্যাক্স খাত থেকে একটা non-profit fund রাখে। এই সংস্থা নাগরিকদের হেলথ ইন্সুরেন্স এর ব্যবস্থা করে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে যে ধনীদের শীর্ষ দেশ আমেরিকায় ভেটারেন বা সৈনিকদের স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্ব সরকার নেয়, তাও ৬৫ ঊর্ধ্বে ব্যক্তিদের। বাকি সবাই প্রাইভেট চিকিৎসার আওতায়। বর্তমানে ৩৫ মিলিয়ন আমেরিকান এর কোন হেলথ ইন্সুরেন্স নেই।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেক কুপার মার্কিন হেলথকেয়ার সম্বন্ধে চমকপ্রদ গবেষণা করেছেন। মার্কিনীরা হেলথের জন্য জিডিপির ১৭.২% খরচ করেন। সিঙ্গাপুর খরচ করে ৪.৯%। গরিব দেশ কিউবা খরচ করে জিডিপির ১২%। অথচ কিউবার হেলথ ব্যবস্থা মার্কিন বা সিঙ্গাপুর থেকে উন্নত এবং কেবলমাত্র রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক সার্বজনীন ও অনেক পাকাপোক্ত। ইয়েল ইউনিভার্সিটি গবেষণায় বলা হচ্ছে মার্কিন দেশে একটা Knee Replacement (হাঁটুর প্রতিস্থাপন) চিকিৎসা অঞ্চল ও হাসপাতাল ভেদে ১৭ গুণ কম বেশি হয়। খোদ একই শহরে ৪ থেকে ১০ গুণ হেরফের হয়। অধ্যাপক কুপার এর প্রশ্ন মার্কিন হেলথ বাজেট এর এত বিশাল (১৭.২%) অঙ্কের ডলার কার পকেটে যায়? তার উত্তর, বিশাল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সাপ্লাইকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও বিশাল অংকের বেতনভোগী ম্যানেজমেন্ট ডাক্তার-নার্সদের পকেটে যায়। অধ্যাপক কুপারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল এ ব্যবস্থার উত্তরণ কি? তার উত্তর God Knows । আমাদের দেশে ও উপমহাদেশের পুরো অঞ্চলে এখন স্বাস্থ্যব্যবস্থা কর্পোরেট দখলে চলে যাচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবায় ধনী-গরিব বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। এই সমস্যা নিয়ে ২০২১ সালে জানুয়ারিতে ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়েছিল। ভারতসহ উন্নত দেশের অনেক ডাক্তার ও ম্যানেজমেন্ট এক্সপার্ট সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন। সবচেয়ে নজর কাড়ে ভেলোরের খ্রিশ্চান মেডিকেল কলেজ এর প্রতিনিধির বক্তব্য। তিনি বলেন স্বাস্থ্য সেবার উচ্চ মূল্যের কারণ হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন মেশিন মার্কেটিং এর কারণে। তিনি বলেন ভেলোর হাসপাতাল এর ডাক্তারগণ কম দামি মেশিনে ডায়াগনোসিসও চিকিৎসা করতে পারলে অনেক নতুন মেশিন ক্রয় করেন না। তার মতে কর্পোরেট হাসপাতালে ৩০% যন্ত্রপাতি অতি প্রয়োজনীয় নয়। পন্ডিচেরী অরবিন্দ আই হাসপাতাল এর প্রতিনিধি বলেন, তার হাসপাতাল কম মূল্যে সেবা দিয়েও ঠিকে আছে কি করে? তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন-স্বাস্থ্য সেবা কখনও ‘পণ্য’ হতে পারে না। এই মৌলিক অধিকারকে পণ্য মনে করলে ধনবাদের খপ্পরে পড়বেন। আর ধনবাদের চালিকাশক্তি মুনাফা ও প্রতিযোগিতা। সাম্প্রতিক করোনা চিকিৎসা আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ছে “হেলথ ক্যাপিটালিজম এর বিপদ” । রাষ্ট্র্রের অংশগ্রহণ, নিয়ন্ত্রণই এই বিপদ থেকে দেশকে বাঁচাতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক