ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ১৫ মার্চ, ২০২২ at ৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ

মোবাইল সংস্কৃতি : ইয়েস অর নো

প্রথম আলো পত্রিকায় শুক্রবার সংখ্যায় স্কুলের বাচ্চাদের জন্য একটি পাতা থাকে বিশেষ ‘মুদ্রণ’ হিসেবে। শুক্রবারের এমনি একটি সংখ্যায় দশম শ্রেণীর এক ছাত্র পুরোনো দিনের যত খেলা ও বিনোদন আছে তা নিয়ে এক ছড়া লিখেছে। কানামাছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, ডাংগুলি ইত্যাদি খেলাগুলোর উল্লেখ আছে। দশ বছর বয়সী ছেলে দূরে থাক-তার জন্মদাতার বয়স যদি ৪০ এর আশ পাশ হয় সেই পিতাও এসব খেলা খেলেছে কিনা সন্দেহ। গ্রামে-শহরে আগে বিনোদন মানেই হরেক রকম ক্রীড়া।
এখন বিনোদন এর সব অনুসঙ্গকে ছাড়িয়ে গেছে মোবাইল সংস্কৃতি। মোবাইল জীবনের সর্বদিককে এমনভাবে বেষ্টন করে ফেলেছে যে-কম্বল আমি ছাড়লেও কম্বল আমাকে ছাড়ে না অবস্থা!
বর্তমানে স্কুল-কলেজে মোবাইলের ব্যবহার ও অপব্যবহার সম্বন্ধে প্যারাগ্রাফ, রচনা লিখা আসে পরীক্ষায়। পারমাণবিক বোমা অথবা মানুষের চন্দ্রে অবতরণ বিস্ময়কর ঘটনা নিঃসন্দেহে। কিন্তু মোবাইলের মতো এত জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রবেশ অন্য সমস্ত আবিষ্কারকে ম্লান করে দিয়েছে। মাল্টি-মিডিয়া অর্থ অনেক কাজের একত্রীকরণ। মোবাইল একটি বহু কাজ করে এমন যন্ত্র। এখানেই যত সমস্যা।
শুধু ভাল-মন্দ খবর নেয়া হলে এটা অতি প্রয়োজনীয়। চুরি-ডাকাতি, হাইজ্যাক, অশ্লীল ছবি, ইত্যাকার ফাংশন মানুষকে আর মানুষ রাখেনি। আবালবৃদ্ধবনিতা মোবাইল আসক্ত। সত্য-মিথ্যা সব কিছু আপলোড হয় এই যন্ত্রে। মানুষ এত বাছ-বিচার না করে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ে।
মোবাইল প্রথমে আসলেই দূর যোগাযোগের জন্য আবিষ্কৃত হয়েছিল। এটা কোন ‘বিনোদন’ হিসেবে বা ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ হিসেবে যন্ত্র ছিল না। কিন্তু বর্তমানে ‘মোবাইল’ ঘিরে সামাজিক, শারীরিক, মানসিক রোগের আধিক্য ঘটছে।
মোবাইলের নির্মম শিকার বাচ্চারা। জন্ম থেকে তাকে হাসানো, কাঁদানো, খাওয়ানো সবই মোবাইল কার্টুনের মাধ্যমে মায়েরা করে। একটু বড় হলেও মোবাইল না দিলে খেতে চায় না, পড়তে চায়না/ মোবাইল বাচ্চাদেরকে এক ধরনের obsession করে- যেটা পরবর্তী জীবনে মারাত্মক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এ পরিবর্তিত হয়।
সাইবার ক্রাইম সম্বন্ধে সবাই অবগত। শুধু এই একটা অপব্যবহারই যথেষ্ট। দ্বিতীয় একটা মানসিক ব্যাধি মোবাইল ব্যবহারকারীদের মাঝে দেখা যাচ্ছে যেটাকে বলা হয়-NOMOPHOBIA. যখন মানুষ মোবাইল হারিয়ে ফেলে, ব্যাটারী লো চার্জ দেখায় বা মোবাইলে কল করার মত পয়সা শেষ হয়ে যায় তখন মানুষ অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করে। অনেকে সারারাত কল-লিস্ট, মেসেজ চেক করে। মোবাইলের ভাইব্রেশন Mode এ কিছুই এলেই দ্রুত তা দেখার জন্য পাগল হয়ে যায়। ঘুম, বিশ্রাম সবই নষ্ট হয়। তার প্রভাব পড়ে খাদ্য-হজম থেকে মস্তিষ্কের উত্তেজনা পর্যন্ত। রিং টোন নিজের এবং পরিপার্শ্বের অন্য সবার স্নায়ুর একাগ্রতা (Concentration) কমিয়ে দেয়। ফলে মানুষ কোন কিছুতে মন গভীরে নিতে পারে না। এটাকে বলা হয় attention blinding. রিং টোন ও জনসমাগম স্থলে বেপরোয়া মোবাইল ব্যবহার ব্রেইনকে Cognitive load নিতে দেয় না। ব্রেইন কোষগুলোর বিশ্রাম সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন এবং তাও ফিজিওলজিকাল কারণে রাতে মস্তিষ্কের কোষগুলোর বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু আমরা তো মোবাইলের দিবা-রাত্রি ব্যবহার অপরিমিতভাবে করছি।
তাই মোবাইল Real life প্রয়োজনীয় বস্তু হলেও এটা বস্তু হিসেবে অত্যন্ত Inconsiderate এবং বিরক্তিকর। জনসমাগম স্থানে, মসজিদ-মন্দিরে মোবাইলের অপব্যবহার ও অভদ্রতা সমার্থক হয়ে গেছে। এমনিতেই বর্তমান সময়ে বলা হয় নামাজের মত এবাদতের একাগ্রতা নিম্নে তার উপরে মসজিদের নামাজীদের মধ্যে নিয়ত বাঁধার আগেও মানুষ ‘বাজার দর’ নিয়ে ব্যস্ত। আবার নামাজের সালাম ফিরানো মাত্রই কানে মোবাইল এরকম মুসল্লীর আল্লাহর আসলেই প্রয়োজন আছে কিনা ভাববার বিষয়।
ব্যক্তিস্বাধীনতার হাজার হাজার বিষয় কত দেশে, কতভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। শুধু মোবাইলে অজস্র তথ্য অবিরাম স্ক্রোল করলেই মিলে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের চিন্তা ভাবনা করা উচিৎ।
প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের তফাৎ স্বভাবগতভাবে মানুষ বোঝতে চায় না। তাই নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন আসে।
প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু যখন প্রযুক্তি মানুষকে কল্যাণ থেকে অকল্যাণ বেশী করে, মানবিক উৎকর্ষতাকে পশুর পর্যায়ে নিয়ে আসে তখন নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয় বৈকি! পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ না করলে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেত। মোবাইল সংস্কৃতি আরো ভয়ংকর ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে এসেছে সভ্যতাকে।
লেখক-প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচোখের অভ্যন্তরীণ চাপ ও গ্লোকোমা
পরবর্তী নিবন্ধআবদুল নুর চৌধুরী