ভাস্কর সোমনাথ হোড়

জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি

নেছার আহমদ | বৃহস্পতিবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ


ঐতিহাসিক চট্টগ্রামের যে কয়জন আলোকিত মানুষ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত হয়েছেন এবং দেশকে সম্মানিত করেছেন তাঁদের অন্যতম আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ভাস্কর সোমনাথ হোড়।
১৯২১ এর ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বরমা গ্রামে সোমনাথ হোড় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রেবতীমোহন হোড় ও মা মিনুবালা হোড়। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার বড় ছেলে সোমনাথ। স্থানীয় স্কুলে লেখাপড়ার হাতেখড়ি।
বরমার ত্রাহিমেনকা হাই স্কুলে তিনি নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৩৫ সালে তাঁর বাবা রেবতীমোহন হোড় মারা যান। মানুষ হওয়ার তাগিদে জীবন যুদ্ধের প্রয়োজনে বরমা গ্রাম হতে তাঁকে চলে যেতে হয়। কাকার অধীনে থেকে মালদহে পিসির বাসা থেকে ১৯৩৮ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাস করেন। মেট্রিক পাস করে চট্টগ্রাম এসে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজ হতে ১৯৪০ সালে আইএসসি পাস করে কলকাতা চলে যান। সেখানে রিপন কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। চলে আসেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে এসে কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় হয়ে পড়েন। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ হতে ছবি-পোস্টার এঁকেছেন প্রচুর।
সে সময়ে দেশে চলছে দুর্ভিক্ষ। মানুষের মৃত্যুর মিছিল, নাঙ্গা ভূখা মানুষের ছবি তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। ১৯৪৩ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ম্যাগাজিন ‘জনযুদ্ধ’ নামক প্রত্রিকায় বাংলার দুর্ভিক্ষের চাক্ষুষ ডকুমেন্টেশন এবং রিপোর্টিং করেন। ১৯৪৪ সালে পার্টির জন্য প্রচুর ‘ছবি’ পোস্টার এঁকেছেন। ১৯৪৫ এ কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট এন্ড ক্র্যাস্টে ভর্তি হন। সেখানে তিনি মুদ্রণ তৈরির পদ্ধতি এবং সুক্ষতা ও প্রধানত লিথোগ্রাফি এবং ইনটাগ্লিও নিয়ে কাজ করেন। সেখানে তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, সফিউদ্দিন আহমদ, রমেন চক্রবর্তী, আনোয়ারুল হক প্রমূখের ন্যায় আলোকজ্জ্বোল স্বনামধন্য বিখ্যাত শিল্পীগণকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন।
১৯৫০ এর দশকে সোমনাথ ভারতের প্রিন্ট মেকার হিসেবে বিবেচিত হন। সে সময় তিনি তাঁর নিজস্ব প্রিন্ট মেকিং কৌশল উদ্ভাবন করেন। এর মধ্যে বিখ্যাত পাল্প-প্রিন্ট টেকনিক অন্যতম। কলকাতা আর্ট কলেজ হতে কৃতত্বের সাথে ডিগ্রি নেয়ার পর তিনি কলকাতা আর্ট কলেজ এবং দিল্লি আর্ট কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। ইতিমধ্যে তাঁর সহপাঠি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কুলদাচরণ দাশগুপ্তের মেয়ে রেবা দাশগুপ্তের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সে সময়ে শান্তি নিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র, লক্ষ্ণৌ আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ বিশ্বভারতীর কলাভবনের প্রধান, প্রথিতযশা শিল্পী দিনকর কৌশিক এর আহ্বানে সোমনাথ হোড় ১৯৬৯ সালে শান্তি নিকেতনের কলাভবনে গ্রাফিক্স এবং প্রিন্টমেকিং বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদেন। সে সময় হতে বাকী জীবন তিনি শান্তিনিকেতনেই অতিবাহিত করেন। সে সময়ে তাঁর শিক্ষা প্রতিভার বিকাশ ঘটে। ভাস্কর্য ছাপচিত্র, ড্রইং সহ শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমে অসাধারণ সফলতার কারণে সোমনাথ ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্পী হিসেবে পরিণত হন। সোমনাথের জীবনে ‘শান্তিনিকেতন’ আশির্বাদ হিসেবে দেখা দেয়। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ, ৪৭ এর তেভাগা আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে তাঁর শিল্পসত্তার মানবিক বিকাশ অনন্য সৃষ্টিতে ভাস্বর। শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে মানুষের প্রতি একজন দায়বদ্ধ শিল্পী হিসেবে নিবেদিত প্রাণ সোমনাথ হোড় কাজ করেছেন। হতাশা, ক্লান্তি, বঞ্চনা, ক্ষুধা, পীড়া, দারিদ্র, শোষণ-নির্যাতন তাঁকে সর্বদা তাড়িত করে। তাঁর শিল্পকমের্র মধ্যে এর প্রতিফলন ঘটে।
১৯৭০ এর দশকে হোড় ভাস্কর্য তৈরী শুরু করেন। তাঁর ব্রোঞ্জের মূর্তিগুলি দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধের যন্ত্রণাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সে সময়কালে হোড় আধুনিক ভারতীয় শিল্পের প্রতীকি প্রতীক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর সবচেয়ে বড় ভাস্কর্যগুলির মধ্যে অন্যতম হলো ‘মা ও শিশু’, যা ভিয়েতনামের মানুষের কষ্টের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন।
১৯৭০ এর দশকে বাংলার হিংসাত্বক আন্দোলন ও রক্তের হোলি খেলার সময় স্বাধীনতা সংগ্রামের মৃত্যুর মিছিলকে সামনে নিয়ে ‘উন্ডস’ সিরিজের কাজ শুরু করেন। ছোট্ট মেয়ে চন্দনার হাঁটু ছিড়ে গিয়েছে, সেখানে একটু রক্ত, সেই রক্ত সরাসরি তিনি ‘উন্ডস’ সিরিজের কাজে ব্যবহার করেন। সব রক্তই যেন সকল সন্তানের রক্ত। কফি বানাতে গিয়ে গরম দুধ পড়ে নিম্নাঙ্গ পুড়ে গেল তাঁর। তিনি তাঁর ডায়েরিতে সেই দহন পর্বের কথা লিখেছেন। এ দহন পর্ব হতেই তৈরি হলো জগৎ বিখ্যাত ধাতু ভাস্কর্য ‘দ্রোপদী’ কোমর থেকে নীচ অবধি পুড়ে যাওয়া এক নারীর দাঁড়ানো শরীর। এ পুড়ে যাওয়া শরীর আত্মসম্মানের প্রতীক হয়ে দাঁড়াল।
কমিউনিস্ট পার্টির ম্যাগাজিন ‘জনযুদ্ধে সোমনাথ মেলে ধরেছেন তাঁর সে সব ছবি তাঁর নিজস্ব ব্যথার আঁচড়ে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৩ এপ্রিল ২০২১ সংখ্যায় শৈবাল বসু লিখেন, ‘শান্তিনিকেতনের কলাভবনের শিক্ষক হয়ে আসা তাঁর জীবনে একটি জরুরি বাঁক। এমনটা মনে করতেন সোমনাথ হোড়। অথচ মজার বিষয় শান্তিনিকেতনের প্রাচ্যদেশীয় ধারায় কোনোও নিশ্চিত ছাপ এড়িয়ে গিয়ে পাওয়া গেল এমন এক শিল্পীকে, যার কাজ চুড়ান্ত নাগরিক হয়েও প্রান্তিক। মনে পড়ে যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাজের মূল সুরটিকেই। তাঁর কাজের দিকে বিশ্বে তাকিয়ে রইল বিস্ময়ে। আর আশ্রম তো তখন আচার সর্বস্ব পর্যটক ভূমি ছিলনা। সোমনাথ-রেবার লালবাঁধের বাড়িতে একদিন গনগনে আঁচে পুড়ত ভাস্কর্যের ব্রোঞ্জ, আর কখনও সন্ধ্যাবেলার নিভৃত আড্ডায় এসে বসতেন সুচিত্রা মিত্র, শম্ভু মিত্রের মতো এক সময়ের গণসংগ্রামের শিল্পী সঙ্গীরা। মুড়িমাখা আর কফির অদ্ভুত বিরোধী অনুষঙ্গে, কী গহীন বিনিময় হতো সে আড্ডায়!
১৯ জুন ২০২১ এর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় অতনু বসু লিখেন, ‘আশির দশকে তাঁর শান্তিনিকেতনের বাড়িতে বসে এক স্বাক্ষাৎকারে সোমনাথ হোড় বলেন,‘মানুষের বই বিবিধ যন্ত্রণা, কষ্টগুলো বার বার আমার চেতনায় ধাক্কা মারে। সহজে বিস্মৃত হতে পারিনা’। ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করেছেন। তেভাগা আন্দোলনে নিজেই বিরাট এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি। লিখেছেন তেভাগা নিয়ে অনেক লেখা, গ্রন্থপ্রকাশ ও বহু স্কেচ, ড্রয়িংগুলো সে সময়কার অন্যান্য দলিল।—- বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর তাঁকে সংঘাতিক নাড়া দিয়েছিল। অমৃত্যু বামপন্থি আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তাঁর শিল্পে বহু বাঁক এসেছে, বিবর্তিত হয়েছে কত মাধ্যমগত বৈচিত্র্যে, কিন্তু মানুষই ছিল তাঁর প্রধান ও শেষ প্রেরণা। খুব কাছ থেকে মানুষের দৈনন্দিন যন্ত্রণা, সংকট, দুর্বিষহ অবস্থান থেকে মৃত্যু এবং মানুষের সংগ্রাম-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। অজস্র সৃষ্টিতে সামাজিক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইকে তিনি নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন। মানুষের বিষণ্নতা যন্ত্রণার জ্যান্ত রূপ যখন রূপক হয়ে তাঁর ছবিতে আত্মপ্রকাশ করে, সেখানে তার বেদনাহত মনটি গভীরে গিয়ে অন্তস্থলটিকেও যেন প্রত্যক্ষ করেছেন। তা না হলে ওই ব্যথিত রূপ শরীরী বিভঙ্গে মানুষের ভেঙ্গে চুরে যাওয়া যন্ত্রণাকে অভূক্ত নিরন্নের এই অভিব্যক্তিময় মূহুর্তগুলিকে বিভিন্ন রেখায় এভাবে ব্যক্ত করা সত্যিকার অর্থে দুঃসাধ্য যা তিনি করে দেখিয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালিদের যেভাবে নিগৃহীত ও লাঞ্চিত করা হয়েছে তা সোমনাথ হোড়কে বিচলিত করে তোলে। তাঁর ব্রোঞ্জে করা ভাস্কর্য তাঁর অভিব্যক্তি ও বাংলাদেশের মানুষের অসাধারণ সাহসী যুদ্ধের এক আলেখ্য হয়ে আছে। সোমনাথ হোড়ের শৈল্পিকযাত্রা তার ‘ক্ষত’ সিরিজের কাগজের পাল্প প্রিন্টে শেষ হয়। যেখানে তিনি তাঁর দীর্ঘ চর্চা করা মানবতাকে বিসর্জন না দিয়ে বিমূর্ততায় কটি অনন্য ব্র্যান্ড অর্জন করেছেন। শান্তি পেয়েছেন তাঁর ‘ক্ষত ’সিরিজে ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য। শিল্পমূল্যে অসমাপ্ত কাজ বলে বিবেচিত হলেও তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে।
সোমনাথ হোড় তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশ বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী ‘প্রফেসর ইমিরিটাস’ পদে তাঁকে অভিষিক্ত করে। বিশ্বভারতী থেকে অবসরের পর সোমনাথ শান্তিনিকেতনের গ্রামে শিল্পীর স্ত্রী রেবা হোড় ও কন্যা চন্দনা হোড়কে নিয়ে অনারম্বর জীবনযাপন করেন। তাঁর বিখ্যাত শিল্প কর্মের মধ্যে অন্যতম হলো, (১) মাদার ঊইথ চাইল্ড, (২) দি হ্যাংগিং ব্লেক এন্ড হোয়াইট, (৩) দি খাজানি প্লেয়ার, (৪) রামপ্রসাদ বমর্ণ, (৫) দি চ্যালেঞ্জার।
সোমনাথ হোড়ের প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো (১) তে ভাগার ডায়েরি, (২) চা বাগিচার কড়চা ও (৩) সোমনাথ হোড়ের ভ্রমণ ডায়েরি কালেকশন অন্যতম।
২০০৭ সালে সোমনাথ হোড়কে ভারতের সর্ব্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘পদ্ম ভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করা হয়। বিস্ময়করভাবে কর্মঠ ছিলেন সোমনাথ। সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত অক্লান্ত কর্মঠ ছিলেন তিনি। অথচ শক্ত সমর্থ পুরুষ বলতে যে শরীরের কল্পনা আমরা করি তা কোনদিনই তাঁর ছিলনা। বরাবরই ছিলেন নির্মেদ। প্রায় পেশি শক্ত হাড়ের মানুষ তাঁর অনেক ছবি ও মূর্তির চরিত্রের মতন।
শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে মানুষের প্রতি একজন দায়বদ্ধ শিল্পী হিসেবে সোমনাথ হোড় আমৃত্যু নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গড়া শান্তিনিকেতনের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারাকে প্রবহমান রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্থাপনকারী ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান শিল্পী, চট্টল-গৌরব সোমনাথ হোড় ২০০৬ সালের ০২ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক-শিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালো থাকুক নারী বন্ধুরা
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল