জীবনতরী একটি তিন তলা নৌকা। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই জলযানটি বাংলাদেশের নৌপথে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী তীরবর্তী বাইশটি জেলার বত্রিশটি স্থানে এ পর্যন্ত সাত লাখেরও বেশি মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছে এই নৌকা হাসপাতালের মাধ্যমে। পেশাদার চিকিৎসক এবং সেবিকাদের নিয়ে নৌকা হাসপাতালটি বিভিন্ন নদী তীরবর্তী স্থানে নোঙর করে, বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছেন কিন্তু নানা কারণে চিকিৎসা সেবা নিতে পারছেন না, এমন মানুষের জন্য স্বস্তি নিয়ে এসেছে। এটি পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষের অস্ত্রোপচারও করেছে!
১৯৯৯ সালের এপ্রিলে যখন জীবনতরী প্রথম কাজ শুরু করে, তখন এটিই ছিল দেশের প্রথম ভাসমান হাসপাতাল। চল্লিশ মিটার দীর্ঘ এবং দশ মিটার চওড়া নৌযানটিতে একটি অপারেশন থিয়েটার, ক্লিনিকাল ল্যাবরেটরি, ডাক্তারের চেম্বার রয়েছে, যা এটিকে করেছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামে একটি এনজিও এর কার্যক্রম পরিচালনা করলেও স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসকদের অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। দূর্গম যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং বিশ বছর আগের দূর্বল স্বাস্থ্যসেবার কারনে জীবনতরী হয়ে উঠেছিল নদীর তীরে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য আশা ও স্বস্তির বাতিঘর।
সাধারণ চিকিৎসাসেবা প্রদানের পাশাপাশি নৌকা হাসপাতালটি চক্ষু, নাক-কান-গলা, অর্থোপেডিক এবং ঠোঁটের তালু ফাটা সংক্রান্ত ৫০ হাজারেরও বেশি অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেছে। অনেক সময়, বিদেশী প্রখ্যাত সার্জনরা এই ভাসমান হাসপাতালটিতে অস্ত্রোপচার পরিচালনা করেছেন। পাশাপাশি তারা স্থানীয় চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশনের প্রাথমিক অর্থায়নে জাহাজটি নারায়নগঞ্জ ডকইয়ার্ডে একজন স্বনামধন্য ব্রিটিশ নৌ স্থপতির সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়। জীবনতরী জাহাজটি এখনও পরিপূর্ণরূপে কাজ করছে এবং দেশে সরকারের স্বাস্থ্যসেবার পরিপূরক হিসাবে অবদান রেখে চলেছে।
যে কোনো সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা অন্তর্ভুক্তি একটি পূর্বশর্ত। নদী ও জলপথে সজ্জিত ভূখন্ডে বসবাসকারী বিশাল জনসংখ্যার একটি দেশের জন্য, সকল মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার আওতায় আনা সত্যিই একটি কঠিন কাজ। যদিও সারাদেশে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি ভালো নজির স্থাপিত হয়েছে, তবুও ডাক্তার-মানুষের অনুপাতের ব্যবধান অনেক বেশি। অবশ্যই সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং বেসরকারি হাসপাতালে, বিশেষ করে বড় শহরগুলিতে পরিষেবার মান এবং সেবা গ্রহনের ক্ষমতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বেশ কিছু স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত এনজিও সারা দেশে মানুষের কাছে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা পৌঁছে দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ছে এবং রোগও বাড়ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সত্যিই চ্যালেঞ্জিং।
স্বাস্থ্যসেবা যেকোনো সমাজের সামগ্রিক সুস্থতার জন্য একটি অপরিহার্য দিক। এটি ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) জাতিসংঘের চার্টে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। এসডিজি ৩ সব বয়সের, সব সমপ্রদায়ের এবং সব জায়গার সকল মানুষের জন্য সুস্থ জীবন নিশ্চিত করার শর্ত দিয়েছে। এসডিজি ঘোষণায় সকলের স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা নিশ্চিত করে সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের উপর জোর দেওয়া হযছে। এসডিজিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শক্তি, সম্পদের সুবিধা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে কাউকেই পিছিয়ে রাখা উচিত নয় বলে জোর দেয়া হয়েছে।
এটি সত্য যে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাগুলোতে সকলের গ্রহন সক্ষমতা নিশ্চয়তা করা মূল চাবিকাঠি। সুতরাং, সরকারী ও বেসরকারী উভয় খাতই এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে ব্যস্ত। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, কয়েক দশক ধরে এর প্রভাবে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে কারণ নতুন নতুন কাঠামোগত সুবিধাগুলি তৈরি করা হয়েছে, আরও বেশি ডাক্তার এবং নার্স তৈরি করা হয়েছে, এবং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে, রোগ এবং প্রতিকারের গবেষণায় যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
যাইহোক, বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজের চিত্রে এখনও অসমতা এবং জটিলতা রয়েছে। সরকারী স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাগুলি ডাক্তার এবং নার্সের ঘাটতির সম্মুখীন হয় যখন বেসরকারীগুলি বেশি শহরমুখী এবং বাণিজ্যিক মানসিকতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। বেশ কিছু এনজিও রয়েছে যারা এই ক্ষেত্রে কাজ করছে, বিশেষ করে অনগ্রসর এবং দূরবর্তী জনপদের জন্য। তারা ব্যবধানকে কিছুটা সংকুচিত করছে কিন্তু সীমিত সুযোগ এবং অবকাঠামোর কারনে শতভাগ লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে না।
আমাদের দেশে, বৈষম্যের এই ব্যবধান বিশাল। নদী দ্বারা বেষ্টিত একটি ভৌগলিক পরিস্থিতি, চর নামক দ্বীপের আরেক রূপ, হাওরের মতো বিস্তীর্ণ জলাশয় এবং পর্যায়ক্রমিক বন্যা প্রায়শই স্বাস্থ্য খাতে জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। মানুষের, বিশেষ করে যারা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য চরে বসবাস করে, সেইসাথে নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলির মধ্যে দিয়ে বন্যার সময়, স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা কঠিন এবং কখনও কখনও অসম্ভব হয়ে পড়ে। এগুলির সাথে জনস্বাস্থ্য পরিষেবাগুলিতে ডাক্তার এবং নার্সের অভাব কারণগুলি রয়েছে এবং এটি একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে কারণ যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকরা গ্রামীণ বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতে চান না। তাই, স্থানীয় জনগণ, তাদের অসুস্থতা বা চিকিৎসার প্রয়োজনে, অদক্ষ রোগ নিরাময়কারী কিংবা সাধুদের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে ডাক্তার-মানুষের অনুপাতের ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার জন মানুষের জন্য একজনের কম চিকিৎসক রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুযায়ী এর পরিমান প্রতি দশ হাজারে মাত্র ৫.২৬।
যদিও সড়ক যোগাযোগে উল্লেখযোগ্য উন্নতির সাথে সাথে সারাদেশে জনস্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার নেটওয়ার্ক প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে উন্নয়নের একটি ভাল ধাপ পরিলক্ষিত হয়েছে, তবে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলিতে উন্নয়নে গতি ততোটা নয়। নিঃসন্দেহে বেসরকারী খাতের স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলি অনেক উন্নত হয়েছে তবে সেগুলি বেশিরভাগই সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশের জন্য নয়। এমন প্রেক্ষাপটে জীবনতরীর মতো প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসনীয়। সন্দেহ নেই যে এই ধরনের প্রচেষ্টা দেশে স্বাস্থ্যসেবা অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করবে।
লেখক : একজন ফ্রিল্যান্সার