দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৫ মে, ২০২২ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

নিষিদ্ধ নগরীর দ্বারপ্রান্তে

যুক্তির ঝাপটায় ঠিক হতাশ না, বলা চলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেবার পিঠাপিঠি, মিস রিনার ভেতর থেকে পেশাদারিত্বের ঝলকানির সাথে জেগে উঠল রমণীয় কমনীয়তাও মনে হয়। ফলে সাথে সাথেই সুর পাল্টে রিন রিন স্বরে অথচ বেশ জোরের সাথে অভয় দিয়ে বলল চিন্তা করার কোনই অবকাশ নাই আমাদের। গোটা ঐ এলাকাটাই নাকি লি খাঁ র কাছে তার নিজের বা হাতের তালুর মতো। একটা না একটা উপায় বের হয়েই যাবে। আমাদের শুধু একটাই করণীয়, তা হল এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকা। এরমধ্যে কোনো মতেই যেন বেমক্কা কোনো টাউট বাটপারের পাল্লায় পড়ে অন্য কোনদিকে চলে না যাই। থাকি যেন সেখানেই আছি যেখানে।
“কি বলছ? পথ হারিয়ে ফেলেছি আমরা? কি হবে এখন তবে”? রিজেন্ট হোটেলের রিনা বেগমের সাথে আমার ফোনালাপ কানে যেতেই স্বভাবতই হয়ে উঠল উদ্বিগ্ন তুমুল পাশে হাঁটতে থাকা লাজু!
“হায়! হায়!! তা হলে হবে কী এখন’’? একই হাহাকারের প্রতিধ্বনি তুলল হেলেন!
হুম বুঝতে যদিও পারছি না, কোথায় এসে পৌঁছেছি, তবে ঘাবড়ানোর কিছু নাই। মিস রিনাকে ফোন করেছিলাম, সে বলেছে চিন্তা নাই, লি খাঁ ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলতে পারবে। আমাদের শুধু ঘোরাফেরা বাদ দিয়ে এক জায়গায় থিতু হয়ে থাকতে হবে। চল সবাই, ঐ যে বেঞ্চিগুলো আছে ওখানে গিয়ে বসি।
“ঐ খোলা জায়গায় এই বাতাসের মধ্যে বসবো কিভাবে? ঠাণ্ডায় তো জমে যাচ্ছি। তার চেয়ে কোন একটা ঘরে ঢুকে থাকি”। বলল হেলেন
“বাবা,বাবা, খুব ঠাণ্ডা। আমার হাত ব্যথা করছে’’। দুই করতলে ঢল ঢল করতে থাকা দস্তানা দুটো নাড়িয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে কঁকিয়ে উঠল অভ্র। শুধু দীপ্রই এখনও হাঁটছে চুপচাপ, তবে আমার জ্যাকেট ধরে হাঁটতে থাকা ওর হাত এ মুহূর্তে জ্যাকেটের কোনা হঠাৎ খামচে ধরতেই বোঝা গেল ভয় পেয়েছে সে ও। যার মানে হল ক্রমশই আস্থা হারাতে শুরু করবে সবাই আমার নেতৃত্বের উপর, যদি না এক্ষণি না ধরি টেনে রাশ!
চৌকোনা এই খোলামেলা মাঠটিকে মাঝে রেখে, ডান আর বা দিকটার পুরোটা জুড়ে, আর সামনের দিকের প্রায় তিন চতুর্থাংশ ঘিরে, মানে মাঠটির পৌনে তিন অংশে জুড়ে থাকা টানা স্কুল ঘরের মতো দালানে আছে ছোট ছোট ঘর তাতো বলেছি আগেই। আবার সেগুলোর বেশিরভাগেরই যে দরজা বা ঝাপ বন্ধ বলেছি তাও। তারপরও কিছু কিছু দোকানের যেগুলোর দরজা, ঝাপ এখনও বন্ধ হয়নি, সে গুলোর দিকে নজর দিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেল যে, তিয়েন আন মেন চত্বরের এ দিকটার কোনো একটা বাজার বা মার্কেট জাতীয় জায়গায় এসে পৌঁছেছি। যার মানে হল এখানেই আছে তাহলে নানান টাউট বাটপার। মিস রিনার আশংকিত প্রশ্নে তো সেটাই বুঝলাম। নাহ, তা হলে এখানে কারো সাথেই কোনো কথাবার্তা বলা যাবে না, আকারে ইঙ্গিতেও। দু পুত্রকে জড়িয়ে ধরে মাঠের এদিকটার মানে ঐ তিয়েন আন মেন চত্বরের দিকটার ডান দিকে পেতে রাখা, সারি সরি বেঞ্চির একটাতে দু পুত্রকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বসতে বসতে অভয় দিলাম যে, লি খাঁ আমাদের যদি খুজেও না পায়, কুছ পরোয়া নেই। ট্যাক্সি ঠিক করে আমরা নিজেরাই চলে যাব হোটেলে।
বললাম তো পুত্রদের সাহস দেবার জন্য ঐ কথা, কিন্তু নিজেই তো জানি না, সেই ট্যাক্সিই বা ধরবো কোত্থেকে? আর ট্যাক্সি নিলেও তো নিতে হবে দুটো ট্যাঙি। ঐ ঝুঁকি আর কোথাও নেয়া গেলেও এই চায়না মুল্লুকে নেয়া যায় না। তারপরও কী না এই হিম দুর্যোগের কালে!
“নাহ এখানে বসা যাবে না। খুব বাতাস। এখানে বসলে জমে বরফ হয়ে যাবো এক্কেবারে “বেঞ্চিতে সামান্য কিছুক্ষণ বসেই এ ঘোষণা দিয়ে তা পরিত্যাগ করল বলা চলে সাথে সাথেই!
“আচ্ছা দাদা, চল না ঐদিকে গিয়ে দাঁড়াই। মানে ঐ যে ঘরটা দেখছি ওটার বারন্দায় দাঁড়াই”।
হেলেনের কথায় ওর আঙ্গুল নির্দেশিত পথে চোখ যেতেই দেখলাম মাঠে পাতা বেঞ্চিগুলোর আরো ডানে মিটার বিশ পচিশ দূরে চুপচাপ মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকা পুরানো দিনের আদলে তৈরি ঘরটি। ভাবেসাবে মনে হল ঐটি কোনো একটা টিকিট ঘর টরই হবে। কিন্তু আপাতত ওখানটায় আছে খাঁ খাঁ শুন্যতা। মানে টিকিট কাটার জন্য কোনো লোক যেমন নেই, তেমনি টিকিট বিক্রি করারও লোক নেই। তবে সেটির বারান্দায় দাঁড়ালে অন্তত একদিক থেকে বাতাসের ঝাপটা আসা বন্ধ হবে, এখানে তো এখন চারদিক থেকে হুড়মুড় করে আসা হিম হাওয়া ঝাপিয়ে পড়ছে আমাদের উপর।
ভাল কথা বলেছিস, চল ঐদিকেই যাই বলে সবাইকে নিয়ে ওইদিকে রওয়ানা দিতেই এতক্ষণে, চোখে পড়ল, এই বেঞ্চি গুলো আর ঐ ঘরের মাঝামাঝি যে হাঁটা রাস্তাটি আছে, তা ধরে এগিয়ে গেলেই আছে একটা গেইট। যে গেইটে আমাদের দেশের রেলগেইটে যেমন লোহার ব্যারিকেড দেয়া হয় রেল চলাচলের সময়, ঐরকম একটা ব্যারিকেড দেয়া আছে।
ঐ ব্যারিকেড অনায়াসে পেরিয়ে চোখ ভেতরে যেতেই, চমকে উঠলাম! অনলাইনে যতো অল্পই ঘোরাঘুরি করে থাকি না এই ভ্রমণে আসার আগে; ঠিকই চিনতে পারলাম যে এ হল চায়নার সেই বিখ্যাত নিষিদ্ধ নগরী বা ফরবিডেন সিটি। সোনালি হলুদ রঙয়ের ইট আর পাথরে নির্মিত এই সিটি হলো এ গ্রহের সবচেয়ে বড় রাজপ্রাসাদ। এই রাজপ্রাসাদে সর্বমোট ২৪ জন চায়নিজ সম্রাট বসবাস করেছেন! আর এর ভেতরেই আছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম সাংষ্কৃতিক যাদুঘর। অতএব পরিষ্কার হল ঐ টিকিট ঘরের মাজেজা। শুনেছি টিকিট করে ঢোকার পরও, এখনও নাকি এর একটা বড় অংশে সাধারণের এবং দর্শনার্থীদের যাতায়াত নিষিদ্ধ। অপরিকল্পিতভাবে নিতান্তই দৈবাৎ এখানে হাজির হয়েছি যখন, এর দ্বার এখন খোলা টিকিট কেটে ঢুকে পড়া যেত। লি খাঁয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে যতোটা পারা যায় দেখে নিতাম। সাথে বাঁচা যেত এই হিমছোবল থেকে। কিন্তু এখন এই নিষিদ্ধ নগরীর এক্কেবারে দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখছি এ’তো পুরাই নিষিদ্ধ আমাদের জন্য! এ হাতাশার পিঠাপিঠিই দেখা গেল আশার আলো।
আরে! যদিও ১০০ ভাগ নিশ্চিত নই, তারপরও বলা চলে আশি নব্বই ভাগ নিশ্চিত হয়েছি যে আছি কোথায় এখন। এক্ষুনিই তো ফোন করা দরকার তাহলে মিস রিনাকে। ভেবেই দাঁড়িয়ে যেতেই
“কি ব্যাপার থামলে কেন?”
একটু ফোন করে জানিয়ে দেই রিনা বেগমকে যে আছি আমরা কোথায়।
“কেন তখন তো বললে, এখন আবার খালি খালি ফোন করতে হবে কেন ঐ বেটিকে?” নারীসুলভ ঈর্ষা নাকি স্ত্রীসুলভ সন্দেহ ওটা ঠাহর করতে পারলাম না এই ঠাণ্ডায়। আর তা নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসৎও নেই।
নাহ তখন তো বলতে পারিনি যে আছি ঠিক কোনো জায়গায়। এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে আছি কোথায়; পেছন ফিরে জবাব দিয়ে ফোন বের করতে গিয়ে, মাঠের বা দিকের একটানা বন্ধ দরোজার মাঝে একটামাত্র খোলা দোকানের দিকে নজর যেতেই, এক্কেবারে লাগসই এই আইডিয়াটা খেলে গেল মাথায়!
অতএব ঘুরে ঐদিকে হাঁটতে হাঁটতে সবাইকে বললাম চল যাই, ঐ দোকানে গিয়ে ঢুকি। তাতে লি খাঁ আসা পর্যন্ত রক্ষা মিলবে।
দ্রুত পায়ে এসে ছোট্ট এই দোকান ঘরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তেই দেখলাম, ভেতরে এক চায়নাকন্যা, অবিরল চুং চিং ফুং ফাং করে দোকানে থাকা পুরুষটিকে কি যেন বলতে বলতে গোছাচ্ছে দোকান। পুরুষটি, কি তার কর্মচারী না স্বামী তা বুঝতে পারছি না। অবশ্য দরকারই বা কি তার। যা ই হউক, এ দুটোর মানে তো একই! তবে যদি ভাই বা অন্য কোন সম্পর্ক হয় তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু কথার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে না ওরকম কিছু।
আবারো ধাক্কা খেলাম। হুড়মুড় করে সবাইকে নিয়ে অপরিসর এই দোকানের সেলফ বাদ দিয়ে যেটুকু জায়গা ফাঁকা আছে ক্রেতাদের জন্য, তার পুরোটা পরিপূর্ণ করে ফার্মগেটের ভিড় তৈরি করার পরও আমাদের উপস্থিতিকে পাত্তা দিল না তারা মোটেই। যেন বা তারা নিজেরা ভিন্ন এখানে আর কারোই উপস্থিতি নেই, হাবভাব তাদের এমনই। তাদের এ মুহূতের্র কাজের ধরণে এটা পরিষ্কার যে স্যুভেনির বিক্রি করার এই দোকান তারা আজকের মতো বন্ধ করে দেয়ার মনস্থ করেছে। আমাদের দেশে কাল বোশেখির ঝড় আসার পূর্বমুহূর্তে গ্রাম্য হাটের শেষ দোকানটি যেরকম ত্রস্ততায় বন্ধ করা হয়, তেমনই তাড়া দুজনের হাতে আর সমস্ত শরীরে।
হ্যালো মিস রিনা, আই এম ইন এ শপ নাউ। প্লিজ টক টু হার। আস্ক হার হয়ার উই আর নাউ। বলেই নিজের কান থেকে ফোনটি সরিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরলাম তা, একমনে একস্বরে চিং চাং ফুং ফাং করা সেই কাউন্টার কন্যার দিকে।
কিছুটা বিরক্ত হয়ে ফোনটির দিকে চোখ ফেলে, পিট পিট করে তাকাল এই প্রথম, এই দোকানের কাউন্টারকন্যা সরাসরি চোখে চোখে যাবতীয় বিগলিত ভাব কণ্ঠে আর চেহারায় এনে আস্তে আস্তে একটা একটা শব্দ উচ্চারণ করে মিনতি করলাম যে, এট্টুশখানি কথা কও কইন্না।
বেশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা নিয়ে, কানের কাছে ধরে কিছুক্ষণ চুপ থেকে, ফের চুং চাং ফুং ফাং করতে থাকল কইন্না, রিজেন্ট হোটেলের কন্সিয়ার্জকন্যা রিনার সাথে। কথা বলতে বলতে পিট পিট করে আমাদের জরীপ ও করলো সে বার কয়েক, অতপর ফোন ফেরত দিতেই
দ্রুত তা কানে তুলতেই, ওপাশে বেশ আনন্দিত স্বরে রিনা জানাল যে, আমাদের সঠিক অবস্থান যেহেতু জানা গেছে, অতি দ্রুতই লি খাঁ চলে আসবে আমাদের উদ্ধারে। আর যেহেতু এই দোকান এখনি বন্ধ হয়ে যাবে বলেছে, এখানে আমাদের আর থাকা চলবে না। তবে তাতেও কুছ পরোয়া নেই, আমরা যদি মাঠ পেরিয়ে সামনের দিকে যাই, তবে ওইদিকটায় আরেকটা গেইট আছে। সেই গেইট পেরুলেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে গিয়ে যেন অপেক্ষা করি।
ধড়ে প্রাণ ফেরা, কাকে বলে? বুঝলাম তা মনে মনে। নিশ্চিন্ত মনে ফোন পকেটে রাখতে রাখতে সেই দোকানি কইন্যাকে ধন্যবাদ দিলেও সে ফিরেও তাকাল না। বরং গজ গজ আর চুং চাং ফুং ফাং করতে করতে নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকল।
চরম অনিশ্চয়তা আর বিপদে যে কোনো প্রাণীরই যে ইন্দ্রিয় প্রখর হয়ে উঠে প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রমাণিত হল তা ফের। কারণ আমার মতোও ঘোরতর দিককানাও অতিদ্রুতই এই ছাই রঙয়ের ঘন ধোঁয়াশায় ঢাকা মাঠের অন্যদিকে, মানে যেদিকটায় পৌনে এক অংশ জুড়ে আছে ঝাপ ফেল দোকান তার মাঝে গা ঢাকা দিয়ে থাকা গেইট টা দেখতে পেলাম পরিষ্কার!
সামনেই আছে আমাদের মুশকিল আসান, এরকম একটা নিশ্চয়তা পেয়ে অনেকটা দৌড়েই এগুতে লাগলাম সেদিকে। পায়ের ব্যথায় কোঁ কোঁ করতে থাকা লাজুরও দেখলাম কোনোই সমস্যা হল না এতে। গেইট পেরিয়েই একদম গেইট লাগোয়া একটা পুরানো দালানের দেখা মিলল। সেটির এখানে সেখানে লেগে থাকা কালির ছোপছোপ আঁচড় নিশ্চিত করলো যে এটিই সেই রেস্টুরেন্ট। অতএব আনন্দে এক্কেবারে আটখানা হয়ে ঢুকে পড়লাম সবে মিলে, লোকে গম গম করতে থাকা সেই দালানে। “বাবা, বাবা এই যে এখানে গ্লোভস আছে’’। দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই পেছন থেকে টেনে ধরল অভ্র। ঘাড় ঘুরিয়েই দেখি, আমার চোখে না পড়লেও পুত্র আমার ঠিকই দেখেছে যে ঐ দালানের বারান্দায়, এক হকার পসরা বসিয়েছে গরম টুপি, মোজা, হাত মোজা, মাফলার, ইত্যাদি ইতাদির।
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএমিলি ডিকিনসন: নির্জনতার কবি
পরবর্তী নিবন্ধভাসমান হাসপাতাল : নদীবেষ্টিত জনপদের আশার বাতিঘর!