ভাষা সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে কাজ করতে হবে

অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অঙ্গীকার

| সোমবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালির মননে অনন্য মহিমায় ভাস্বর চিরস্মরণীয় একটি দিন। ইতিহাসের পাতায় রক্ত পলাশ হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউরের রক্তে রাঙানো অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ।
আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষা বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা। এ ভাষার রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা। বাংলা সাহিত্যসম্ভার নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের। এ সবকিছুই বাংলা ভাষার জন্য ইতিবাচক উপাদান। এ ছাড়া সারা বিশ্বে বর্তমানে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। এর মধ্যে বাংলাদেশে ১৬ কোটিরও বেশি; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা মিলিয়ে ১২ কোটি এবং পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা বাঙালির সংখ্যা কম-বেশি এক থেকে দেড় কোটি। এই বিপুলসংখ্যক ভাষী নিয়ে একটি ভাষার টিকে থাকা অত্যন্ত সংগত ও ইতিবাচক। যেখানে শত শত ভাষা নিজস্ব ভাষী হারিয়ে বিপন্নতার মুখোমুখি, সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জয়জয়কার সর্বত্র। এত অর্জনের পরও আমাদের ভালোবাসার বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে দিন দিন। এর জন্য দায়ী কারা, তা নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে।
বাংলা ভাষাকে আজ জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়েছে। এমনকি দেশের সরকারপ্রধানও বাংলায় জাতিসংঘে বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের এই সাধের ও প্রাণের ভাষা নিজ ভূমিতেই কতটা যে অবহেলার শিকার, তার নজির ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।
ভাষাবিজ্ঞানীরা বলছেন, তরুণদের মধ্যে ভাষা ব্যবহারে অসচেতনতা দেখা যাচ্ছে। তারা যেনতেন ভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে চায়। তাই তারা বাংলা আর ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে। মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা লেখার সময়ও তারা ইংরেজিটাই বেশি লিখছে। তাঁরা বলেন, আগে একটা সময় ছিল যখন সবকিছুতেই বাংলা ব্যবহারের চল ছিল। যেমন বাড়ি বা দোকানপাটের নাম রাখা, বিয়ের আমন্ত্রণপত্র ছাপানো- এগুলোতে বাংলা ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেই রীতিটা আর নেই। এখন সবাই ইংরেজি নাম রাখার দিকে ঝুঁকছে। এমনকি অল্প শিক্ষিত লোকজনও ভুলভাল ইংরেজিতে লোকজনকে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে, যেটা দুঃখজনক। এর জন্য তাঁরা মানুষের হীনম্মন্যতাকে দায়ী করছেন। তাঁরা বলেন, মানুষ এখন মনে করে ইংরেজিতে লেখাটা গৌরবের বিষয়। তাই তাঁরা সেটাই করছেন।
ভাষা সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতার বিষয়টা নিয়ে প্রয়াত নজরুল-গবেষক ও ভাষাবিজ্ঞানী রফিকুল ইসলাম পত্রিকান্তরে বলেছিলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করছি, কিন্তু বাংলা ভাষার এমন দুর্গতি আগে কখনো লক্ষ করিনি। শিক্ষকেরা যখন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন, তাঁরাও তখন প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেন না। কথা হচ্ছে যে ভাষার আঞ্চলিক রূপ আছে, প্রমিত রূপ আছে। যেখানে প্রমিত দরকার, সেখানে প্রমিত ব্যবহার করব, যেখানে আঞ্চলিক দরকার, সেখানে আঞ্চলিক ব্যবহার করব। কারণ, আঞ্চলিক ভাষাও আমাদের ভাষা। সমস্যাটা হলো মিশ্রণ।
ইন্টারমিডিয়েট ও কলেজে আগে ইংরেজি মাধ্যম ছিল। তখন একটা আন্দোলন হলো যে যার খুশি সে বাংলায় পরীক্ষা দিতে পারবে। এটা তখন যে বোর্ড ছিল বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তারা সেটা মেনে নিল। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজিটা রইল। তো, পাকিস্তান আমলে যদি এগুলো হয়ে থাকতে পারে, বাংলাদেশ আমলে কেন এগুলো হতে পারবে না? তার মানে এমন একটা হীনম্মন্যতা আমাদের মধ্যে কাজ করছে। আমরা উচ্চতর আদালতকে দোষারোপ করি যে তাঁরা ওখানে বাংলায় রায় দিচ্ছেন না। শুধু রায় দিলে তো হবে না, আমাদের ব্যারিস্টার সাহেবরা কি বাংলায় সওয়াল-জবাব করবেন? কেন আমাদের বাড়ির নাম, দোকানের নামফলক বাংলায় লিখতে বলতে হবে? কেন আমাদের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র বাংলায় লিখতে বলতে হবে? তাহলে এই স্বাধীনতার অর্থ কোথায়? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায়? এর একটাই উত্তর-সপ্তদশ শতকে আব্দুল হাকিম বলে গেছেন, যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
ভাষাবিদদের মতে, রাষ্ট্রের একটা ভাষানীতি এবং ভাষা-পরিকল্পনা থাকা দরকার। আর তা দরকার একটা ভবিষ্যৎ-মুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, আমরা যদি সেসব দিক তুলে ধরতে পারি, তাহলে সমস্যাগুলো মেটাতে আমরা সচেষ্ট হতে পারবো। এজন্য জরুরি ভাষার প্রতি দরদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধশহীদ দিবস