আমাদের কাজের কোনো শেষ নেই। আয়োজনেরও শেষ নেই। একটার পর একটা উৎসব, একটার পর একটা আয়োজন। ছন্দে থাকা, আনন্দে থাকা। হাসি–খুশি থাকা। দার্শনিকরা বলেন, ‘জীবনটা অনেকের কাছে একটা ভ্রমণ। এখানে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ বা অন্তহীন বেদনা বলে কিছু নেই। চূড়ান্ত সাফল্য এখানে অলীক এক বস্তু। এখানে সব কিছুই আপেক্ষিক। আজ যা মহা মূল্যবান, কাল তা মূল্যহীন মনে হতে পারে। তাহলে আমাদের গন্তব্য বা লক্ষ্যটা আসলে কী? কোথায় পৌঁছতে চাই আমরা? কী উদ্দেশ্যে এই ছুটে চলা? জ্ঞান অর্জন? অর্থ উপার্জন? নাকি মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়ে ক্রমশ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলা?’
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বোধন আয়োজিত ‘রিটন সন্ধ্যায়’ আমার এক প্রশ্নের জবাবে ছড়াশিল্পী লুৎফর রহমান রিটন বলেন, ‘ভালোবাসার ওপরে কোনো কিছু নেই। আমি পাঠকের প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি, আরো চাই। এই ভালোবাসার শেষ নেই।’ আমি দেখছিলাম, বোধনের শিশু আবৃত্তিশিল্পীরা যখন লুৎফর রহমান রিটনের ছড়া–কবিতাগুলো পরিবেশন করছিলো, কবি তখন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন। তাঁর সফলতার সৌন্দর্য আমরা প্রত্যক্ষ করছিলাম তাঁর চোখে–মুখে। যদিও সফলতা কোনো গন্তব্য নয়, সারা জীবনের যাত্রা। অনুষ্ঠানে এক শিশু আবৃত্তি করতে উঠে ভয় পেয়ে গেলো, সামনে বিপুল সংখ্যক দর্শক দেখে ভড়কে গেলো – এরমধ্যেও নিহিত আছে তার সাফল্য। এই কচি বয়সে সাহস করে মাইক্রোফোনের সামনে সে দাঁড়াতে পারলো, সেটাও তার সক্ষমতা। এই শিশুটিকে সান্ত্বনা নয়, সাহস দেওয়ার জন্য আমাদের পাশে থাকতে হয়। গুণাবলি অর্জনের চেষ্টার পাশাপাশি আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে সফলতার চেয়ে জীবন বড়ো। ‘রিটন সন্ধ্যায়’ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই উপভোগ করেছেন এক সফল মানুষের জীবন–প্রকৃতি ও সৌন্দর্যচেতনা। লুৎফর রহমান রিটন তাঁর ছড়ায় এঁকেছেন সুন্দরের প্রতিচ্ছবি। তাঁর ছড়া পাঠে অনুভূত হয় নান্দনিক আনন্দ। সৌন্দর্যকে তিনি নিজে সম্ভোগ করেছেন বলে পরিণত হয়েছেন তারকায়। পেয়েছেন পাঠকের ভালোবাসা ও ঈর্ষণীয় সাফল্য। বিষয়ে, ভঙ্গিতে, শব্দে, ছন্দে তিনি অনন্য। তাঁর রয়েছে জাদুকরী ক্ষমতা। ফলে সব ধরনের বিষয় এসে সহজভাবে ধরা দেয় তাঁর হাতে। ছড়ার জাদুর সঙ্গে সেদিন যুক্ত হয়েছে তাঁর কথার জাদু। চমৎকার এই আয়োজনের পেছনে আবৃত্তিশিল্পী সোহেল আনোয়ার, সুবর্ণা চৌধুরী, সঞ্জয় পালসহ যারা ছিলেন, তাদের ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
আসলে আমরা কাজ করছি জীবনের উন্নতির জন্য, কাজ করছি জীবনকে উপভোগ করার জন্য। প্রতিনিয়ত শিখছি। প্রতিটি কাজের মধ্য থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি। শিক্ষা পাই প্রকৃতি থেকে। এবার বইমেলায় বেশ কয়েকটি নতুন বইয়ের পাঠ উন্মোচন অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। এই বইগুলো থেকেও আমি পাঠ গ্রহণ করেছি। দেখলাম–কত চমৎকার মেধা আর প্রতিভার সমন্বয় ঘটেছে এতে। লেখকদের কেউ প্রবীণ, কেউ তরুণ। কিন্তু প্রত্যেকের ভেতর ছিলো তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। বইগুলোর মধ্যে ছিলো ড. মোঃ আবুল কাসেমের ‘ভাষা বিষয়ক বিবিধ বিবেচনা’, মেজর (অব.)এমদাদুল ইসলামের ‘অশ্রু’, ববি বড়ুয়ার ‘উন্নয়ন ও গণমানুষের প্রত্যাশা’, জাহাঙ্গীর আজাদের ‘যে যৌবন শঙ্খিনীর’; কাসেম আলী রানার ‘চিত্রমানব’, চাঁদ সুলতানা নকশীর ‘দীপ্ত দ্বিপ্রহর‘; বনশ্রী বড়ুয়ার ‘আর্যসত্য’ ও ‘হে দুঃখের অতিথি’, জয়িতা হোসেন নীলুর ‘ভালোবাসার অজুহাত‘; মোহাম্মদ জাভেদ হোসেন ও সাদিয়া আফরিনের ‘শেষটাতেও তুমি দাঁড়িয়ে’; মাইছুরা ইশফাতের ‘বোহেমিয়ান মন’; শিরিন আফরোজের ‘বঙ্গবন্ধু তুমি বাংলাদেশের প্রাণ’, সিমলা চৌধুরীর ‘বাক্সোবন্দী ভূত’, দীপক বড়ুয়ার ‘বন পাহাড়ের দত্যি’, সুবর্ণা দাশ মুনমুনের ‘হাটের কাছে রুপোর সাঁকো’, সৈয়দা করিমুননেসার ‘শব্দ আঁকি’, রত্না বনিকের ‘মায়ের বোলে ছন্দ দোলে’, রায়হান হাসিবের ‘এসো কিংশুক ফাগুনে’ ও ‘মন্টি ও মামনি’ প্রভৃতি। এসব বইয়ের পাঠ উন্মোচনে লেখকের আবেগের সঙ্গে কাজ করেছে তাঁদের মননশীলতা, একই সঙ্গে সৃষ্টিশীলতা। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তাদের সৌন্দর্যচেতনা ও উন্নত চিন্তা।
মূলত আমরা সবাই সুন্দরের পূজারী। তবে একেক জনের কাছে একেক ভাবে ধরা পড়ে সৌন্দর্য। মানুষের সৌন্দর্যচেতনা উঠে এসেছে তার সমাজ জীবন থেকে। মার্কস বলেছেন, ‘পারিপার্শ্বিক জগতে, জীবনে ও শিল্পে সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা মানুষ লাভ করেছে কর্মের মধ্য দিয়ে’। আসলে জীবন, জগৎ ও বিশ্বপ্রকৃতিকে কেন্দ্র করে যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উৎসারিত হয়, তা মানুষের একমাত্র সৌন্দর্য নয়; অন্যভাবেও সুন্দরের মুখোমুখি হওয়া যায়। সংগীত, চিত্রকলা, সাহিত্য প্রভৃতিকে অবলম্বন করে যে সৃষ্টিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়, সেটাই আসল সৌন্দর্য।
একটা সুন্দর বিকেল মানুষের মনকে রঙিন করে তুলতে পারে। ঝলমলে আকাশ করে তুলতে পারে মায়াময়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কণ্ঠ মিলেয়ে আমরাও বলতে পারে: ‘আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসী’। মানুষের মন নানা সময়ে হয়ে ওঠে সুন্দরের অভিসারী। রবীন্দ্রনাথ যে সৌন্দর্য চেতনা গড়ে তুলেছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে, তা আধ্যাত্মিক ও নান্দনিক দৃষ্টিসঞ্জাত। তাতে মানবপ্রেম যেমন আছে, তেমনি আছে প্রকৃতিপ্রেম। সাধারণত সাহিত্যে দুটি দিক থাকে। একটি বিষয়গত দিক বা কনটেন্ট এবং অন্যটি হলো রূপগত দিক বা ফর্ম। বিষয়গত ও রূপগত – উভয় দিকেই অন্বেষণ করতে হয় নান্দনিকতার। কোনো কোনো রচনায় বিষয়গত সৌন্দর্য থাকলেও রূপগত সৌন্দর্য থাকে না।
বলে রাখা ভালো, এবার আমরা আগামী ৮ই মার্চ শুক্রবার শিল্পকলা একাডেমিতে দিনব্যাপী আয়োজন করছি ‘শৈলী লেখক সম্মিলনের’। এতে লেখকরা তাঁদের ভাবনা–বিনিময় করবেন, পারস্পরিক কথোপকথনে যে সব বিষয় উঠে আসবে, সে–গুলো হবে সাহিত্যের বা লেখালেখির জন্য বড় রসদ।
সেখানে এই আয়োজনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের মনের অন্ধত্ব, ভুল বোঝাবুঝি, সংস্কার ও নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে খুঁজে বের করে সুকৌশলে তার দিক পরিবর্তন করে ইতিবাচক দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করবো।
অজ্ঞতা থেকে ভুলের জন্ম হয়; জন্ম হয় ভয়ের। তাই ভয়কে মোকাবেলা করা জরুরি। যেভাবেই হোক ভয়কে জয় করতে হবে। তাহলে আমরা আরো বেশি সাহসী হবে, আমাদের বিচক্ষণতা বৃদ্ধি পাবে এবং মনের শক্তি বাড়বে। বৃদ্ধি পাবে সহযোগিতা ও সহমর্মিতাবোধ। ‘শৈলী লেখক সম্মিলন’ উপলক্ষ্যে আমরা অগ্রিম গ্রাহকও নির্বাচন করছি। যাঁরা যত টাকা দিয়ে অগ্রিম গ্রাহক হবেন, তাঁরা পাবেন দ্বিগুণ পরিমাণের বই। মানুষের মাঝে বইয়ের মাধ্যমে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতেই আমরা কাজ করছি একসঙ্গে। অনেকে অনেক কথা বলতে পারে, বলেও। সেসব কথাকে উপেক্ষা করে আমরা রবিঠাকুরের মতো বলবো :
‘বড়োর দলে নাইবা হলে গণ্য–
লোভ কোরো না লোকখ্যাতির জন্য।
ভালোবাসো, ভালো করো, প্রাণ মনে হও ভালো–
তবেই তুমি আলো পাবে, তবেই দেবে আলো–
আপন–মাঝে আপনি হবে ধন্য।
স্বার্থমাঝে থেকো না অবরুদ্ধ–
লোভের সাথে নিয়ত করো যুদ্ধ।
নিজেরে যদি বিশ্বমাঝে করিতে পারো দান
নিজেরে তবে করিবে লাভ – তখনি পাবে ত্রাণ,
হৃদয়ে মনে তখনি হবে শুদ্ধ।’
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর–৪২২), বাংলা একাডেমি।