ডিসেম্বর, ২০১৯-এ চীনের উহান সিটি থেকে উৎপন্ন করোনা অতিমারির দানবীয় হাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষার প্রয়াসে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা নিরলস প্রচেষ্টায় যুক্ত। আবিষ্কৃত হয়েছে সোনালি আশার আলো-‘ করোনা প্রতিষেধক টিকা’।
‘পৃথিবীর ফার্মেসী হাউস’ বলে অভিহিত ভারত, সারা দুনিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ ওষুধ ও টিকা তৈরি করে থাকে। বর্তমানে দৈনিক ২০ লক্ষ ডোজ করোনা টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে সেখানে। করোনার প্রথম ঢেউ যথাযথভাবে সামলানোর কৃতিত্বও পেয়েছে দেশটির। ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ১৩৮ কোটি বিপুল জনসংখ্যার দেশে দৈনিক সংক্রমণ লাখের নিচে, মৃত্যু শ’য়ের নিচে নেমে এসেছিলো।
দেশীয় টিকা তৈরি, টিকাকরণের সুবন্দোবস্ত, বিশ্বের ৯৫টা দেশে উপহার ও কমার্শিয়াল মিলিয়ে প্রায় ৭ কোটি টিকা প্রেরণপূর্বক বিশ্ব ভূ-রাজনীতিতে অবস্থান ইত্যাদির মাধ্যমে আত্মতুষ্টিতে মগ্ন ছিল ভারত। যে কারণে বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচন, বৃহৎ নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে ভারত-ইংল্যান্ড ক্রিকেট সিরিজ, আইপিএল খেলা, কুম্ভমেলা ও ধর্মীয় নানা উচ্ছ্বাস-আয়োজন, সবখানে ছিল স্বাস্থ্যবিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর বেপরোয়া আচরণ।
ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, দলের রাজনৈতিক কৃতিত্ব ও বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথের ঘোর অপছন্দের ‘অতি জাতীয়তাবাদী চেতনা উদ্দীপ্ত’ উত্তেজনায় বয়ান দিলেন- ‘ভারত হয়তো করোনা নিয়ে খেলা শেষ করতে চলেছে’। এর জবাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রবলভাবে ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে ভারতকে হাড়ে হাড়ে জানিয়ে দিলো ‘অবজ্ঞার ফল’ কী-রূপ হতে পারে। আক্রান্ত রোগীর জন্য শয্যা, অঙিজেন, ওষুধ, এমনকী শেষকৃত্য সামলানো নিয়ে প্রতিটা মুহূর্তে ঘটে চলেছে হৃদয়বিধারক ঘটনা। দুর্ভাগ্যক্রমে এর সাথে যুক্ত ছিল, খ্যাতনামা রোগতত্ত্ববিদ এম.বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে দেওয়া গাণিতিক মডেলের ভুল পূর্বাভাষ, যা ‘মে মাসে’র তৃতীয় সপ্তাহে দৈনিক ১ লাখ থেকে ১.৫ লাখ আক্রান্ত সংখ্যা নিয়ে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানবে বলে সরকারকে অবহিত করেছিল। তা যে এতো আগে ও এতো সর্বনাশা রূপে হানা দেবে তা শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের অনুমানে ছিল না। অবশ্য এর জন্য সারা দেশ থেকে পাঠানো আক্রান্ত হার কম সংখ্যায় দেখানোর কারণে মডেল চিত্র সঠিক হয়নি বলে তাঁদের যুক্তি।
বর্তমানে দৈনিক সংক্রমণ সংখ্যা ৪-৫ লাখের ঘরে। আর আক্রান্ত সংখ্যার ১ শতাংশ গড় মৃত্যু হিসেবে দৈনিক মৃত্যু প্রায় গড়ে ৪০০০-৫০০০ এর মধ্যে থাকবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আগস্ট মাসে এই ঢেউ চুড়োয় পৌঁছুবে, তখন যে কী বিভীষিকা অপেক্ষা করছে-কে জানে। দিল্লীর সাংবাদিক গৌতম নিয়োগীর ভাষ্য-ভারতের চিকিৎসা উন্নত, কিন্তু স্বাস্থ্য অবকাঠামো যে কতো দুর্বল, তা নখ-দন্তসহ বিকট চেহারা নিয়ে প্রকট হয়েছে।
কারো বিপদে উল্লসিতরা মনুষ্য পদবাচ্যে পড়ে না। চিকিৎসাজগতে হিপোক্রেটিস শপথনামা মানবিক নির্দেশনার উজ্জ্বল উদাহরণ। একলা চলা নীতি পরিহার করে সব দেশের একসাথে ‘করোনা প্রতিহত যুদ্ধে’ শামিল হবার প্রয়োজন- এই উক্তি করেছেন পৃথিবী বিখ্যাত রোগসংক্রমণ-তত্ত্ববিদ ডা. ফাউচি। এক্ষেত্রে সাম্যের কবি কাজী নজরুলের কী অসাধারণ কবিতার চরণ- ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনজন? কান্ডারী বল! ডুবিছে সন্তান, মোর মা’র’। মনে রাখতে হবে জাতীয় কবি কেবল কাণ্ডারিকে হুঁশিয়ার করেননি, সাথে ‘দুস্তর পারাবার/ লঙ্গিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার’- এ কথাও উচ্চারণ করেছেন।
পৃথিবী মায়ের বিপন্ন সকল সন্তানের জীবন বাঁচানোর সংগ্রামে প্রয়োজন প্রতিক্ষণ মানবিকতার মশাল জ্বালিয়ে রাখা। অথচ তার বিপরীতে ইতোমধ্যে বিশ্বে উৎপাদিত টিকার ৭৫ ভাগ নিয়ে নিয়েছে কেবল ৭টা উন্নত দেশ। সুখবর এই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো.বাইডেন টিকা উৎপাদনের স্বত্বরোধ করার মানবিক নীতি গ্রহণ করেছেন, ফলে অনুন্নত দেশগুলোতে টিকা উৎপাদন ও টিকা প্রাপ্তি সহজ হবে।
করোনা পরিস্থিতিতে ‘নো ওয়ান ইজ সেইফ, টিল এভরি ওয়ান ইজ সেইফ’ অর্থাৎ সবাই নিরাপদ হয়ে না ওঠা পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নয়-এই বিশ্ব-শ্লোগান বুকে ধারণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ইয়োরোপের অনেক দেশ এইরূপ ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। বিশ্ব-স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী ডা. সৌম্য স্বামীনাথনের মতে যে কোনো দেশ এভাবে করোনার শিকার হতে পারে।
তাই ভারতীয় প্রখ্যাত ভাইরাস-জীবাণু বিশেষজ্ঞ ডা. শাহিদ জামিল যেমনটা বলেছেন- ‘বেশি আগেভাগে করোনার বিরুদ্ধে বিজয় জয়োল্লাস উদযাপনের খেসারত দিতে হচ্ছে তাঁর দেশকে’-সেই সতর্কবাণী সব দেশের জন্য প্রযোজ্য এবং এ মহামূল্যবান হিতোপদেশ আমরা যেন ভুলে না যাই।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।