ভাঙ্গলো মিলন মেলা

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ২৬ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ

এই লেখাটা যখন শুরু করি প্রায় বছরখানেক আগে, মাথায় এটা লিখব সেটা লিখব নানা কিছু গিজগিজ করছিল। লেখার আনন্দে যেমন লিখেছি, আবার অন্যদিকে মনে ছিল, যদি একজন পাঠকেরও ভ্রমণের আগ্রহ তৈরি হয়, কেবল একজন নারীও যদি একা ভ্রমণের সাহস পায় কিংবা একজন মানুষও যদি নারী এবং শরণার্থীদের কথা ভাবে এমন আরো কিছু! আবার লিখতে লিখতে একসময় মনে হল কি হয় এতকিছু লিখে! প্রতিদিন তো খবরের কাগজ, টিভিতে কত কত কিছু ছাপা হচ্ছে, দেখানো হচ্ছে। এইসব নিয়ে কত কত সংগঠন, সরকারি- বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে কয়েক দশক ধরে। কতোটা পরিবর্তন আসলে হয়েছে! তারপর, আবার সব গা ঝাড়া দিয়ে লিখতে বসতাম। ভাবতাম, যে যাই লিখুক বা বলুক সেটা তো তাদের মতো করে লিখেছে বা বলেছে, আমি আমার মতো করে আমার কথাগুলো লিখে যাই। এই লেখা পড়ে কারো জীবনে পরিবর্তন নাইবা আসলো! কিন্তু, যখন পড়ছে তখনকার সময়টা তো পাঠকের পার হয়ে যাচ্ছে। জীবনের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ তো সময় কাটানোর জন্যই। জীবনের জন্য বরাদ্দকৃত সময়টা ভালোমন্দ মিশিয়ে কেটেই তো যায়। ভালো সময় নাকি দ্রুত ফুরায়, আর খারাপ সময় যেন অনন্তকাল ধরে চলে। আইনস্টাইনের সময়ের এই আপেক্ষিকতার কথা বলেই তো বিখ্যাত হয়ে গেলেন। তিনি অবশ্য কঠিন সব অংকের মাধ্যমে সেটা বলেছেন। কিন্তু, মোদ্দা কথা তো একই।
দেখতে দেখতে স্পাইসি রোডের সাথে ভ্রমণের সময়ও ফুরিয়ে এলো। ইয়া আর ইয়ান্নিক লাওস থেকে ভিয়েতনাম গিয়ে এই হিচহাইকিং প্রজেক্টের পর্দা নামাবে। নীনা আর এলিনা যাবে ইন্ডিয়া। আর আমি আশেপাশের আরও দুই তিনটি দেশ ঘুরব। এরপর যে যার নিজের দেশে ফিরে যাবে। কিন্তু, প্রশ্ন হল, স্পাইসি রোড তো শুধু এই ভ্রমণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ওদের তো আরও পরিকল্পনা আছে। জার্মানিতে ফিরে গিয়ে শরণার্থীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন রান্নার রেসিপি নিয়ে একটা বই করার পরিকল্পনা, তারপর একটা রেস্তোরাঁ খোলার পরিকল্পনা যেখানে সেইসব রেসিপির খাবার পরিবেশন করা হবে আর শরণার্থী নারীরাই সেটি পরিচালনা করবে।

কিন্তু, পরিষ্কার করে কেউই কিছু বলছে না আসলে ভবিষ্যতে কি করবে সেটা নিয়ে। এর মধ্যে লক্ষ্য করলাম ইয়ার সাথে নীনা এবং এলিনার খুব একটা বনছে না। মাঝখানে ইয়ান্নিক পড়েছে মুশকিলে, অনেক চেষ্টা করেও গ্রুপের ভেতরকার প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারছে না। সবার সাথে কথা বলে বুঝলাম এ-হল সেই ক্লাসিক প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের ভেতর ভাবনাগত পার্থক্যের ফলাফল। শেষ পর্যন্ত সবাই বসে সিদ্ধান্ত হল, আপাতত ভ্রমণের শেষে এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকবে। যদি কখনও কারো ইচ্ছে হয়, আর অন্যেরা রাজি হয় তাহলে আবার নতুন করে যেখানে শেষ করছে সেখান থেকে শুরু করা যাবে।

আমার ভেতরে তীব্র ব্যথা টের পাচ্ছিলাম। এ-এক অবধারিত চক্রে পৃথিবী চলছে। খুব ভালো কিছু করার পণ নিয়ে একদল মানুষ কিছু শুরু করে, তারপর সময়ের সাথে সাথে দলের মানুষদের ভাবনার পরিবর্তন আসে, লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়ে যায়, আর এভাবে হয় পুরো কাজটার সমাপ্তি ঘটে, বা যে লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল সেই লক্ষ্য থেকে সরে যায়। শেষটা কখনও শুরুর মত থাকে না। এইটাই বাস্তবতা। কিন্তু, এই বাস্তবতা মেনে নিতে কষ্ট হয়। স্পাইসি রোডের এমন কিছু হবে সেটা ভাবতেই পারিনি। অন্তত এতো তাড়াতাড়ি সবার ভেতর মতের অনৈক্য দেখা দেবে এটা খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। মন ভার করে সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সে রাতে ইয়া’র সাথে অনেক গল্প হয়েছিল। ও ছিল না বলে ওর সাথে খুব একটা গল্প করার সুযোগ হয়নি।

দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়ে ইয়া দেশ ছেড়েছিল একটু নিজের মত করে বাঁচবে বলে। ইয়া’র খুব ইচ্ছে ছিল সে পেইন্টিং নিয়ে লেখাপড়া করবে, ছবি এঁকেই জীবন কাটাবে। কিন্তু, এশিয়ার অন্যসব দেশের মত, দক্ষিণ কোরিয়াতেও অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের কেবল ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চায়। ইয়া’র বাবাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। আর দক্ষিণ কোরিয়াতে সায়েন্সের কোনো বিষয় নিয়ে না পড়ে আর্টসের কোনো বিষয়ে লেখাপড়া করলেই সবাই ধরে নেয় ওই শিক্ষার্থী মেধাবী নয়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আর্টসে পড়া সেখানে রীতিমত অভিভাবকের জন্য অপমানজনক। আর দারুণ বৈপরিত্যের বিষয় হল, এই দেশের পপ কালচার আর দুনিয়াকে মাতিয়ে রাখছে। কে-পপ বা বিটিএস ব্যান্ডের নাম শুনেনি, এমন কথা কেউ বললে তাকে ভিনগ্রহের প্রাণী বলে ধরে নিবে মানুষ। এইতো বিশ্বকাপের উদ্বোধনীতেও গান গাইল দক্ষিণ কোরিয়ার বিটিএস ব্যান্ডের এক সদস্য। ইয়া আবার নতুন কথা শোনালো। দক্ষিণ কোরিয়াতে নাকি এই কে-পপ কালচারের বিরুদ্ধে কথা বলছে একদল মানুষ। তাদের মতে এই কে-পপ ছেলে মেয়েদের মাথা নষ্ট করে দিচ্ছে, এবং যেসব এজেন্সি এইসব শিল্পীদের হয়ে কাজ করে, বেশিরভাগ এজেন্সি নাকি শিল্পীদের ঠকায় এবং শিল্পীদের অমানুষিক জীবন যাপন করতে বাধ্য করে। আমাদের দেশে এই অবস্থা নেই বলে দুই এক লাইনের কথায় এই বিষয় বোঝানো একটু কঠিন।

ইয়া’র দেশ ছাড়ার আরেকটি কারণ ছিল, দক্ষিণ কোরিয়ান সমাজের অতিমাত্রার পুরুষতান্ত্রিকটা। ওই সময়ই একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় নব্বইভাগের কাছাকাছি নারীরা কোন না কোন ভাবে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় তাদের স্বামী, প্রেমিক, বাবা, ভাই কিংবা পুরুষ আত্মীয় স্বজনের দ্বারা। আমার তো সন্দেহ হয় আমাদের দেশে প্রায় শতভাগের কাছাকাছি হবে এই নির্যাতনের হার মানে। নির্যাতন মানে তো আর কেবল ঝগড়াঝাটি মারামারি করা না। আরও অনেকরকম হতে পারে। এই যেমন রান্নার বিনেপয়সার ঠিকাদারি তো ঘরের বউদের উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকে হয়ত বলতে পারেন, ঘরের বউরা এখন আর রান্না করে না। বলি, আশাপাশে ভালো করে একটু নজর দিয়ে দেখুন কয়টা বউ-এর এমন রাজার কপাল আছে। আবার ঘরের বউকে রান্না করতে না হলেও, এ-নিয়ে প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয় স্বজনের মধ্যে মুখরোচক আলোচনার কিন্তু কমতি হবে না। যাই হোক, উঠতে বসতে নিত্যদিনের জীবন যাপনে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে দেশ ছেড়ে জার্মানি চলে গেল ইয়া। ওদের আবার আমাদের মত ভিসা নিয়ে অত ভাবতে হয় না। এশিয়ার হলেও, উন্নত দেশের পাসপোর্ট বলে কথা!

কিন্তু, জার্মানি গিয়েও বাধল বিপত্তি! ওখানে আবার পুরুষেরা কেবল শোয়ার ধান্ধা করতো। ওদের কাছে কোরিয়া, জাপান, চীন সব দেশের মানুষের চেহারা একই। আর জাপান পর্ণোগ্রাফির জন্য খুব বিখ্যাত পশ্চিমাদের কাছে। ওদের নাকি ভাবটা এমন যে এশিয়ার এই অঞ্চলের মেয়েদের বললেই ওরা সেঙ করতে রাজি হয়ে যাবে। জার্মানির ভেতরকার এই বিকৃত বর্ণ বৈষম্যের জন্য সেখানেও শান্তির জীবন নেই। ও বলছিল, আরও কিছুদিন দেখবে সহ্য করতে পারে কিনা। একেবারেই মন উঠে গেলে কানাডা চলে যাবে।

একটু নিজের মত থাকা, একটু শান্তির জন্য নারী এবং শরণার্থীর এই ছুটে চলা কোথায় গিয়ে যেন এক হয়ে যায়!
নারীবাদ, শরণার্থী এবং একজন নারী ভ্রমণকারী শিরোনামের লেখাটি শুরু হয়েছিল স্পাইসি রোডের সাথে ভ্রমণে বের হব সেই গল্প দিয়ে। স্পাইসি রোডের সাথে ভ্রমণ শেষের সাথে সাথে এই শিরোনামের লেখাও শেষ করছি। শিরোনামেরও চাপ থাকে লেখকের উপর, সেটা এবার লিখতে টের পেলাম।
এরপর যদি কখনও সময় সুযোগ আর ইচ্ছে হয়, তখন হয়ত অন্য শিরোনামে আমার একা ভ্রমণের আরও গল্প বলবো। তবে সে গল্প সমাজের কোনো পরিবর্তনের আশায় বলবো না, সে গল্প হবে শীতের রাতে আগুনকে ঘিরে যে গল্প হয়, তেমন গল্প।
নোট: স্পাইসি রোড একটি হিচহাইকিং এর মাধ্যমে জার্মানি থেকে ভিয়েতনাম ভ্রমণের উদ্যোগ, যেটির উদ্দেশ্য ছিল শরণার্থীর অধিকার এবং নারীবাদ বিষয়ে এর সদস্যদের জানার পরিধি বাড়ানো এবং ভ্রমণ সঙ্গীদের সাথে অর্জিত জ্ঞান ভাগ করে নেয়া। লেখক তাদের সাথে ২০১৭ সালের কিছু সময় ভ্রমণ করেছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅ্যাক্রেডিটেশন বাংলাদেশের জন্য যুগান্তকারী প্রসেস : নওফেল
পরবর্তী নিবন্ধনীতি বাক্যের পুঁথি, নারীর অগ্রগতি এবং আত্মসচেতনতা