বাকলিয়া সরকারি কলেজের সংকট কাটছে না। প্রায় তিন হাজার ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় চারতলার একটি মাত্র পুরনো ভবনই কলেজটির সম্বল। গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট থাকাকালীন সব মিলিয়ে হাজারখানেক শিক্ষার্থীর পাঠদান চলছিল এ ভবনে। ২০১৬ সালে সরকারি কলেজে রূপান্তরের পর এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে তিন গুণ। তবে তিন গুণ বেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রমও চালাতে হচ্ছে এই একটি ভবনে। গত ৪–৫ বছর ধরে এমন দূরবস্থার মধ্যেই চলছে সরকারি কলেজটি।
কলেজটির অবকাঠামো–সুবিধা বাড়াতে উদ্যোগ নেয় সরকার। নতুন একটি ভবন নির্মাণে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে কার্যাদেশও দেয়া হয়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এর কার্যাদেশ দেয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। কার্যাদেশ পায় এম এন ট্রেডার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কার্যাদেশের দুই বছরেও ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। এ নিয়ে চলতি বছরের ১৬ জুলাই দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় ‘সংকটে বেহাল বাকলিয়া সরকারি কলেজ : কার্যাদেশের দুই বছরেও শুরু হয়নি নতুন ভবনের নির্মাণকাজ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কয়েক দিন এ নিয়ে তোড়জোড় চলে। কলেজ কর্তৃপক্ষকে দ্রুত কাজ শুরুর আশ্বাস দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। তবে ওটুকুই। কাজ আর শুরু হয়নি। আজাদীতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রায় ৫ মাস কেটে গেছে। কিন্তু নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নতুন ভবনটি হবে ৬ তলা বিশিষ্ট। তবে শুরুতে পাইলিং ও নিচতলার কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এক কোটি টাকার এ প্রকল্পের কার্যাদেশ পেয়েছে এম এন ট্রেডার্স নামের
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রথম তলার নির্মাণ কাজ শেষ হলে পরবর্তীতে উপরের তলার টেন্ডার আহ্বান ও কার্যাদেশ দেয়া হবে বলে জানায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর।
১৬ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে কার্যাদেশ পাওয়া এম এন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. ইমতিয়াজ উদ্দিন দাবি করেন, কাজটি তারা পেয়েছেন ঠিকই। তবে ‘প্রভাবশালী’ একজনের অনুরোধে আরেক পার্টিকে কাজটি দেয়া হয়েছে। তারাই কাজটি করছেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এম এন ট্রেডার্স কাজটি পেলেও ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা (বর্তমানে মহানগর যুবলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত) কাজটি নিয়ে নেন। মূলত তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই নির্মাণ কাজটি হওয়ার কথা। কিন্তু কার্যাদেশের দুই বছর পার হলেও ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলীয় পরিচয়ের দাপটে ঠিকাদার নির্মাণ কাজ শুরু করেননি।
এ বিষয়ে কথা বলতে কাগজে–কলমে কার্যাদেশ পাওয়া এম এন ট্রেডার্সের ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. ইমতিয়াজ উদ্দিনের মোবাইলে শুক্রবার একাধিকবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কল ধরেননি।
এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু না হওয়ার বিষয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, ঠিকাদারের দলীয় পরিচয়ের দাপটের কারণে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরও দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
১৬ জুলাই আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার সরকার দাবি করেন, তার দায়িত্বভার গ্রহণের আগে থেকেই কাজটি স্তিমিত ছিল। সে বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে পারবেন না। তবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্মাণ কাজ শুরুর উদ্যোগ নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলেছেন। নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে বলেও ওই সময় দাবি করেন তিনি।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ভবনটি নির্মাণে কার্যাদেশ দেয়া হয় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় নির্বাহী প্রকৌশলী পদে ছিলেন মো. জালাল উদ্দিন। ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর এ পদে (নির্বাহী প্রকৌশলী) যোগ দেন প্রদীপ কুমার সরকার। কার্যাদেশের পরও নিজের দায়িত্বকালীন ঠিকাদার নির্মাণ কাজ শুরু না করা প্রসঙ্গে ১৬ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে চট্টগ্রামের বিদায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জালাল উদ্দিন আজাদীকে বলেন, স্বাভাবিকভাবে এতটা দেরি হওয়ার কথা না। কার্যাদেশ দেয়ার পরও কাজ শুরুতে বিলম্ব হলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দেয়া কার্যাদেশ বাতিল করার সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজনে নতুন করে টেন্ডার আহ্বানও করা যায়। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চাইলে যে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে।
অন্যদিকে, ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর যোগদানের পর ইতোমধ্যে এক বছরের বেশি সময় পার করেছেন বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার সরকার। তবে ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরুতে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানালেও সেটি দৃশ্যমান হয়নি। ঠিকাদারের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ৩০ নভেম্বর এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রদীপ কুমার সরকার দাবি করেন, তিনি চেষ্টা করছেন। কয়েকদিন আগেও ঠিকাদারকে অফিসে ডেকে এনে কথা বলেছেন।
সরেজমিনে কলেজে গিয়ে দেখা যায়, কলেজের বিদ্যমান পুরনো ভবনের ডান পাশে পাইলিংয়ের জন্য একটি যন্ত্র দাঁড় করে রাখা হয়েছে। পাশেই বালির স্তূপ। কলেজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত জুন মাসে একটি পাইলিংয়ের কাজ করা হয়েছে আর বালির স্তূপ করা হয়েছে। কিন্তু এরপর তাদের (নির্মাণ কাজের সাথে সংশ্লিষ্টরা) আর দেখা যায়নি। দীর্ঘ সময় পরও নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কলেজের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা।
কলেজ কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, বর্তমানে চারতলা যে ভবনটিতে শ্রেণি কার্যক্রম চলছে, সেটি গভঃমেন্ট কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট থাকাকালীন পুরনো ভবন। ওই সময় কেবল ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ এক হাজার। কিন্তু ২০১৬ সালে সরকারি কলেজে রূপান্তরের পর তিন বিভাগেই (বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকে) শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। প্রথম বছর কেবল একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করানোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কম ছিল। তবে পরের বছর থেকে দুই বর্ষে (একাদশ ও দ্বাদশ) মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়। পরে পর্যায়ক্রমে আসন সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কলেজটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রথম বছরের তুলনায় এখন প্রায় তিন গুণ। বছর বছর শিক্ষার্থী বাড়লেও অবকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা বাড়েনি কলেজটিতে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যমান চারতলা ভবনটির নিচতলা জুড়ে রয়েছে প্রশাসনিক ব্লক। যেখানে ছোট্ট একটি কক্ষে বানানো হয়েছে অধ্যক্ষের কার্যালয়। রয়েছে শিক্ষক মিলনায়তন ও লাইব্রেরি। ছাত্রীদের কমনরুমও বানানো হয়েছে নিচতলায়। সব মিলিয়ে নিচতলায় ক্লাস নেয়ার উপযোগী কোনো কক্ষ অবশিষ্ট নেই। বাকি তিনটি ফ্লোরে ক্লাস নেয়ার উপযোগী মোট ৮টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি ক্লাস রুমে ৭০/৮০ জনের বেশি শিক্ষার্থী বসানোর সুযোগ নেই। একটি ক্লাস রুমকে বানানো হয়েছে ল্যাব।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জসিম উদ্দিন খানসহ আরো বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়। কলেজের নানাবিধ সংকটের কথা তুলে ধরে তারা বলেন, আগে সর্বোচ্চ এক হাজার শিক্ষার্থীর পাঠদানের জন্য এই ভবনটি উপযোগী ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষার্থী প্রায় তিন গুণ। সে হিসেবে কয়েক গুণ বেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে গেলে নতুন অবকাঠামো জরুরি। কিন্তু টেন্ডার কার্যাদেশ সম্পন্ন হলেও নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। এর জন্য কলেজকে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। শ্রেণি কক্ষ সংকটে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান। একটি সেকশনকে দুটি করে পাঠদান করতে হচ্ছে। এখন নতুন করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিছুদিন পরই একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু অবকাঠামো, ক্লাস রুমসহ নানাবিধ সংকটে দুশ্চিন্তা কাটছে না কলেজ কর্তৃপক্ষের।