(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দিলু রোড
সময়টা ২০০৬ সাল। আমার তখন দিলু রোডে একটা স্টুডিও ছিল। একই বিল্ডিং এর নীচতলায় আমার আরেক বন্ধুও স্টুডিও ব্যবসা চালাতো।
একদিন শুক্রবার রাতে আমার বন্ধু খালিদ আসলো গাড়ি নিয়ে সাথে তার সুন্দরী স্ত্রী মোনালিসা। তারা অনেকক্ষণ গেইট ধাক্কালো কিন্তু দারোয়ান ছেলেটা ছিলো না বলে কেউ দরজা খুলল না। বিল্ডিং এর নীচে সিঁড়ি ঘর সুতরাং গাড়ি রাখার জায়গা ঐ সরু রাস্তায়। কিছুক্ষণ পরে খালিদ আমাকে ফোন করলে আমি দরজা খুললাম। দেখলাম তার গাড়ির সামনে বখাটে ছেলেদের জটলা। খালিদ আর তার স্ত্রী আমার হাতে টাকা দিয়ে চলে গেল।
আমরা স্টুডিওতে কাজ করছিলাম এমন সময় দরজায় জোরে জোরে ধাক্কার শব্দ শুনলাম। স্টুডিওর রেকর্ডিস্ট, কোয়ারটেকার মালেক কেউ দরজা খুলতে সাহস করলো না। অবশেষে আমিই খুললাম। দেখলাম জসিম নামের হাতাকাটা, গেঞ্জি পরা আর কানে বড় বড় দুল লাগানো নেশাখোর গুন্ডা সাথে কামাল নামের আরেক মাস্তান। তারা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে যাচ্ছে। আমি ঘটনাটা জানতে চাইলাম। তারা বললো, আপনার বন্ধুরে আমরা সাইজ কইরা ছাড়ুম। আমি বললাম, ওর সাথে আপনাদের ঝামেলা হলে আমার কি দোষ? আমি তো সত্যিই কিছু জানি না। তারা খালিদের নাম্বার চাইল, আমি দিতে অপারগতা জানালাম। একপর্যায়ে জসিম পকেট থেকে ছুরি বের করলো। আমি বললাম, দেখুন আমি পৃথিবীর সব মানুষকেই সমান দৃষ্টিতে দেখি; আমি আপনাকেও যেরকম সম্মান করি সে রকম খালিদকেও করি। তারপর আরও বাকবিতন্ডার পর জসিমকে মালেক নিচে টেনে নিয়ে গেল। ঘটনাটা এখানেই শেষ নয়।
স্টুডিওর নিচের দোকানদার ঘটনাটা দেখছিল। যেহেতু খালিদের বৌ সুন্দরী, তাই জসিম আর কামালের চোখ গিয়েছিল মোনালিসার ওপর। তারা যখন খালিদ আর মোনালিসাকে উত্তপ্ত করছিল তখন খালিদও তাদের গালাগালি করতে ছাড়েনি।
দোকানদার আমাদের ব্যাপারটা জানিয়ে দিল শুনে জসিম দোকানে হামলা চালায়। তার কিছুদিন পর স্টুডিওর কেয়ারটেকার মালেক আমাকে জানালো, জসিমকে আচ্ছা তুলোধুনো দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে র্যাব সদস্যরা। কিছুদিন পর আবার জসিম হাজির হলো দিলু রোডে। আগের মতন সে সন্ধ্যার পরে লাল লাল চোখে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাড়া।
সম্ভবত দিলু রোড পুরান-ঢাকার পরে ঢাকার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এটা একটা কানা গলি। অথচ নব্বই এর দশকে এই দিলু রোডটিই ছিলো খুব সুন্দর ছায়া ঢাকা, ছিমছাম কলোনী। বিশ বছর আগে আমার বন্ধু সাহেদের খালামনির বাসাটা ঠিক কোন জায়গায় ছিলো, আমি এখনও ঠিক তা বের করতে পারিনি। এই রোডের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাস্তা খুব সরু, রাস্তার দু’ধারের দোকানগুলোর সামনে মানুষের আড্ডা। এখানে গাড়িও বেশি, মানুষও বেশি। তাই স্বাভাবিকভাবেই, সবাই কথা বলে উচ্চস্বরে।
ছয়-সাত বছর আগে আমি যখন এ এলাকায় থাকতাম তখন সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বখাটে নেশাখোরদের চোখে পড়ত। এ একে গালাগালি করছে মা বোন ধরে, সবার চোখগুলো লাল, জামাকাপড়গুলোও কদর্য, রুচিহীন। মনে হতো স্বয়ং শয়তান যেন এখানে ডেরা বেঁধেছে।
বলাবাহুল্য এসব বখাটে ছেলেগুলো আবার বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পীদের মাদক রপ্তানীকারক। হোমড়া-চোমড়া গোছের একজন সঙ্গীতশিল্পী যিনি একটি ব্যান্ডের প্রধান, তার সাথে আমি পাড়ার মাস্তানদের উঠা বসা করতে দেখেছি অহরহ।
এটা শুধু ওনার ক্ষেত্রে নয়, প্রতিভাবান অনেক ব্যান্ড লিডাররাও গুন্ডা, চামচা পোষেণ অহরহ। অথচ এগুলো না করলেও তার সঙ্গীত ক্যারিয়ারের কিছু এসে যেতো না। এটা স্রেফ একটা নেশা। গীবতের, পরচর্চার নেশা।
এই দিলু রোডে প্রচুর মিউজিশিয়ান দেশের আনাচে-কানাচে থেকে এসে ডেরা বাঁধে। কেউ আসে গ্রামে জায়গা, সম্পত্তি, গরু-ছাগল বিক্রি করে। আছে বেশ বড় বড় কয়েকটি সাউন্ড কোম্পানী, প্র্যাকটিস প্যাড। মূলত এই কারণেই এখানে বাসা ভাড়া অনেক বেশি।
এখন দিলু রোডে অনেকগুলো হাইরাইজ বিল্ডিং। পাল্টে গেছে পাড়ার চেহারা ও জমির মালিকদের ভাগ্য। কিন্তু মারামারি, সন্ত্রাস, খুনাখুনি, মাদক ব্যবসা একচিলতেও কমেনি। এখানে সঙ্গীত, মাদক, মাস্তানি সবকিছু মিলে মিশে একাকার।
সন্ধ্যা নামলে গিটার কাঁধে নব্য সঙ্গীত পিপাসুদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতন। মাঝে মাঝে গিটারের ব্যাগ হাতে, কীবোর্ড নিয়ে ৮/১০ জনকেও একসাথে দেখা যায়। খুব ভোরসকালে টেঙি নিয়ে মিউজিশিয়ানদের দিলু রোডে ঢুকতে দেখা যায়। এটা একটা বেশ উপভোগ করার সময়। অনেকে রাত জেগে প্রোগ্রাম করে সকালে মগবাজারের বড় বড় হোটেলগুলোতে নাস্তা সেরে চা খেতে খেতে আড্ডা মারতে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। আলাপচারিতা চলে গত রাতের কনসাটের্র অথবা অন্য কিছু নিয়ে।
দিলু রোড আর মগবাজারকে ঘিরেই বাংলাদেশের মিউজি-ইন্ডাস্ট্রি। ৮০-এর দশক থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত মগবাজার ছিলো পাটোয়াটুলির কাপড় ব্যবসায়ীদের হাতে। তাদের ক্যাসেট, সিডির প্রোডাক্শনের কাজ করেই এখানকার স্টুডিওগুলো চলতো। এখন বেশিরভাগ স্টুডিও চলে ব্যক্তির উদ্দ্যেগে। অর্থাৎ যে কেউ এ্যালবাম করতে আগ্রহী হলে, একজন মিউজিশিয়ানের আন্ডারে স্টুডিও শিফ্ট ভাড়া করে তারপর ব্যানারের কথা চিন্তাভাবনা করে শিল্পীরা।
নামকরা ব্যানার কোম্পানীগুলোর তাই এখন আর শিল্পীদের টাকা দেয় না, বরং উল্টো টাকা নেয়। অনেক শিল্পী বড় বড় ব্যানারগুলোকে ২-৫ লাখ টাকা দিতেও কার্পণ্যবোধ করে না।
সিডি বের হবে, পোস্টাার ছাপানো হবে, সবাই চেহারা দেখবে। আমার পরিচিতা একজন বরিশালের সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন তিনি সবসময় বলতেন- পোরোসারে পোরোশার। অর্থাৎ প্রচারে প্রসার। এখানে দর্শন এটিই। বিখ্যাত হওয়ার জন্য গান করা।
অথচ কোম্পানীগুলো দু-চার শতের বেশি সিডির কপি বাজারে বের করেও না, আবার দু-একশর বেশি পোস্টারও ছাপায় না। আবার অনেকক্ষেত্রে শিল্পীরা পাঁচ লাখ টাকায় বের করা সিডিগুলোর শত শত কপি নিজেরাই কিনে নেয় কোম্পানির কাছ থেকে। এ যেন মাছের তেল দিয়েই মাছ ভাজা।
তাই এখনও এই ব্যবসা যথেষ্ট লাভজনক। কারণ ১৫ কোটির মানুষের দেশে, দেশের আনাচে-কানাচে থেকে প্রতিদিনই, কেউ না কেউ ছুটে আসছে মগবাজারে এ্যালবাম করার স্বপ্নে, বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্নে।
দিলু রোড বা মগবাজার বাংলাদেশের মিউজিককে কি দিয়েছে বা দিবে? এই প্রশ্নটির উত্তর হবে সোজা ১০০% নেগেটিভ। এখান থেকেই দেশের সঙ্গীতের পতন শুরু এবং সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ হবে এখানেই।
এটি নিউয়র্ক নয়, যেখানে প্রচুর কনসার্ট হয় পার্কে, ক্লাবে, বারে; আর ইহুদি ব্যবসায়ীরা কান পেতে থাকবে ভালো এ্যালবামের অপেক্ষায়! মগবাজারে যে ঢুকে, সেই নিজেকে আসিফই মনে করে। আর বেশিরভাগ মিউজিশিয়ানই, মিউজিশিয়ান হতে চায় না, গায়ক হতে চায়। তাদের বেশিরভাগের আইকনই উটকো তারকারা।
গান শোনার একটা নেশা থাকতে হয়। যারা অন্যের গান শুনে আপ্লুত হয়নি, তাদের গান শুনে মানুষ আপ্লুত হবেই বা কেন? ভালো শিল্পীর গড ফাদারের প্রয়োজন নেই কিন্তু মগবাজারে আসলে মিউজিক্যাল পলিটিঙ গাঢ়ভাবে চোখে পড়ে।
তাই এক কথায় এটাকে বাংলাদেশের মিউজিকের কৃষ্ণ গহ্বরই বলা যায়।
(চলবে)