ব্লুমংক

(ঢাকার মিউজিকের গল্প)

কায়সার মোহাম্মদ ইসলাম | সোমবার , ১৮ অক্টোবর, ২০২১ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

বনগ্রাম

আজ অনেকদিন পর ঘর থেকে বের হলাম। তালতলা থেকে মিরপুর থেকে ছেড়ে আসা মতিঝিল গামী বাসে উঠতে হলো অনেক কষ্টে। গন্তব্য গুলিস্তান। গুলিস্তান মানেই ক্যাচাল। আমার মতে পাকিস্তান, আফগানিস্তান নয় সবচেয়ে জটিল স্থান এই গুলিস্তান। বাসা থেকে নেমেই রাস্তার অন্য ধারে সারি-সারি রিক্সা। প্রথম পাঁচজনকে দেখেই মনে হলো এরা কেউ বনগ্রাম যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। কিন্তু ছয় নম্বর রিক্সাওয়ালা লিকলিকে, আমাকে দেখেই বললো বনগ্রাম যাবেন? উঠেন। এই একটা রাস্তা এতোটাই জটিল- এতোটাই সরু, তার ওপর রাস্তার দুধারে দুনিয়ার বাজার। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ যদি হঠাৎ করে একদিন ধনি দেশে রূপান্তরিত হতো তবে নিঃসন্দেহে এখানে হাঙ্গর অথবা নীল তিমির পাখাও পাওয়া যেত। লবণ, গুড়, মরিচ, গরম মশলা তারপর লোহা লক্কর, স্ক্রু-ড্রাইভারের মার্কেট ফেলে বিশাল ময়লা-স্তুপ। তারপর পানির ট্যাঙ্কি ফেলে চারুর বাসা। চারুর বাসায় কেনো যাচ্ছি ?
নিজেকে প্রশ্ন করলাম
তার বাসায় যাতায়াত করছি আজ প্রায় ত্রিশ বছর। তবে এটা ঠিক, চারুর বাসাই একমাত্র বাসা যেখানে জীবনটা থেমে থাকে। এখানে অতীত আর ভবিষ্যত বলতে কিছু নেই।
তাহলে প্রশ্ন হতে পারে বর্তমান বলতেও তো কিছু নেই – বর্তমান হচ্ছে চরম ক্ষণস্থায়ী একটা বিষয় যেটা মুখে বলার আগেই মিলিয়ে যায় নিকট অতীতে।
কলিং বেল দেয়ার আগেই চারু দরজা খুলে বলে- আস্‌সালামু আলাইকুম পাভেল ভাই। আসেন, আসেন, জুতো নিয়ে আসেন।
তার বসার রুমে ঢুকেই আমি সবদিকে তাকাই – এটা আমার পুরনো অভ্যাস। এখানে আমার কল্পনা আর বাস্তবতা পুরোপুরি মিলে যায়। দূর থেকেও এই রুমটার গঠন, সাজানো, আমার মুখস্থ।
পাশের ঘর থেকে অনামিকা আসলো, সে আমাকে সম্বোধন করলো কেমন আছেন পাভেল ভাই? চারু তিন চারটা বোতামে চাপ দিলো আর বললো মেশিনটা তাহলে চালায়।
কিসের মেশিন ?
পাঠকরা এটা কোন আটার মেশিন নয়।
এটা গানের মেশিন।
বাংলাদেশের গান বাজনা নিয়ে যাদের একটু আধটু আগ্রহ আছে এবং অবশ্যই যাদের বয়স ত্রিশের ওপর তারা অনেকেই চারুকে চেনে।
চারু বেশ পোড়া খাওয়া একজন মানুষ। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে মিউজিক নিয়ে জীবন যাপন করছে আজ অনেক দিন।
চেহারাটাও কাঠ মিস্ত্রি গোছের। কানে একটা পেন্সিল রাখলেই তাকে অনায়েশে কাঠ মিস্ত্রি বলা যেতে পারে। চারু হেসে বলে জানেন আমার দাদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের বন্দুক প্রস্তুতকারী। আমি বলি, ঐ একই, কাঠ মিস্ত্রি!
কম্পিউটার চালু হলো। প্রটুল্‌স ফাইল ওপেন হলো। এবার চারু বললো- ও আপনাকেতো বলিনি সেদিন আপনার প্রিয় গানটি রেকর্ড করলাম। শুনেন তাহলে … এখনও কি স্বপ্ন দেখ …।
গান শুনে আমি, মাহীন, অনামিকা সবাই মুগ্ধ;
চারুর প্রশ্ন, গানটা কেমন হলো?
আমি বললাম দারুণ।
কম্পোজিশান ?
আমি বললাম পরিমিত। এটার সাথে আর কিছুর দরকার নেই। কম্পোজিশান মানে যত অল্পের মধ্যে পারপাস্‌ সল্‌ভ।
গায়কী ? আমি বললাম খুব ভালো।
চারু বললো আপনার কাছ থেকে অভিমত পেয়ে আমি খুব সন্তুষ্ট হলাম। জানালা দিয়ে আশে পাশের কার্নিশে অনেক বানর দেখা যাচ্ছে। আমরা সবাই কৌতুহল নিয়ে বানরদের আর্ট অফ লিভিং উপভোগ করছিলাম। একটি বানর আরেকটি বানুরের উকুন বাছাই করছে। একটি আরেকটিকে তাড়া করছে। আবার কোন কোন বানর যৌন কর্মের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটার পাছা দেখে ভীষণ বিশ্রী লাগল, অদ্ভুদ রকমের লাল। তারা অনেকেই লাফ দিচ্ছে এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিং-এ কিন্তু কেউ ফশ্‌কে পড়ছে না।
আমি চারুকে বললাম দেখ এটা হচ্ছে ক্র্যাফ্‌টম্যানশিপ। মিউজিশিয়ানদের নিপুণতা প্রাণীদের মতই হওয়া উচিত।
কলিং বেলের টিং টং শব্দে চারুকে বেশ আতংকিত দেখাচ্ছে। সে বললো এই অসময়ে আবার কে এলো ?
অট্টহাসিতে মুন্নার প্রবেশ। ছোটখাটো মানুষটা চারুর স্কুল জীবনের বন্ধু। গীটার বাজাচ্ছে অনেক দিন ধরে। অনেক কিছুই বাজাতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু দুটি বিষয়ে তার ঘাটতি আছে। একটি ক্র্যাফ্‌টম্যানশিপে, অন্যটি অ্যাসথেটিক সেন্সে।
ঢাকার অনেক মিউজিশিয়ানের নিপুণতা আছে কিন্তু বৈচিত্র নেই। তারা সবাই ক্লাসিক্যাল স্কেল বাজনোতেই অভ্যস্ত। বিবপ্‌ (Jazz), ব্লুজ স্কেল অথবা ক্রোমোটিক স্কেলে অভ্যস্ত গীটাররিস্টের সংখ্যা হাতে গোনার মতন। পাওয়ারফুল চশমার ফাঁকে মুন্নার আত্মবিশ্বাসটা চোখে পড়ার মতন। সে একটা সলো এ্যালবামে হাত দিয়েছে। আমি বললাম তুমি এমন সময় এ্যালবামে হাত দিলে যখন মানুষ সিডি শোনা বন্ধ করে দিয়েছে। সে হেসে বললো, আমিই পারবো। আমার অ্যালবাম বিক্রি হবেই হা-হা-হা।
চারু গীটার বাজাচ্ছে আর অনামিকা গান করছে। … বিমূর্ত এই রাত্রি আমার … গানটা শুনতে আমার খুব বিরক্তি লাগছিল কারণ এতো বেশী গাওয়া হয়ে গেছে যে সেটির ওপর আমার আগ্রহ বলতে আর কিছু বাকি নেই। সে গান করছে ফল্‌স পিচে অর্থাৎ তার স্পীচ লেভেল থেকে অনেক ওপরে। সে সুরেই গাইছে, ধীরে ধীরে আরও সুরে গেয়ে যাচ্ছে, আর যতই সুরে গাইছে ততটাই বিরক্ত লাগছে গানটা। চারুর গিটারের কর্ডেও ভেরিয়েশন পেলাম না আজ; অথচ এই ধরনের ক্রোমেটিক স্কেলের গানে অনেক অগমেন্টেড, অ্যাডেড, ফ্ল্যাটেন ফিফ্‌থ কর্ড চলে আসার কথা। ডিম-লাইটের আলোতে অনামিকাকে আমার বিড়ালের মতই লাগছে। গান শেষে সে তার স্বভাব সিদ্ধ ভাষায় মুন্নাকে বললো, মুন্না ভাই আপনাকে তো একজন বিশ বছরের ছেলের মতই লাগছে। অনামিকার বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই আর চারুর বন্ধুরা সবাই চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, তাই তার কথায় সবসময় বয়সটা চলে আসে। আমি বললাম, তুমি স্পিচ লেভেলে আরও একটা গান ধর। অনেক চেষ্টা করেও দেখা গেল, সে ফল্‌স ভয়েসেই গান গেয়ে যাচ্ছে। সমস্যাটা হচ্ছে অভ্যস্ততা, আমরা গানকে মনে করি এক টুকরো মিষ্টি, সেখানে কেউ আর টক, ঝালের ব্যবস্থা রাখতে চায় না। তাই বাংলাদেশের পপ গানগুলো যতোটাই মিষ্টি ততোটাই বোরিং। এবার যাওয়ার পালা অনামিকা প্রশ্ন করলো – পাভেল ভাই আপনার বয়স কত ? আমি হেসে উত্তর দিলাম বাহাত্তর বছর।
চারুর বাসা থেকে আমরা রওনা দিলাম ব্রাদার্স ইউনিয়নের মাঠে সেখানে নয়ন নামের আরেক জন সিংগার সাংরাইটার, কবি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। অনেক ভিড় ফেলে মাঠে এসে মনে হলো এবার বিধাতার অকৃত্রিম কোথাও পৌঁছালাম। বৃষ্টির গন্ধ সারা মাঠে, আমরা মাঠের কোনায় একটা সিমেন্টের চেয়ারে বসলাম। নয়ন গান করছে “এই শহরে আজ হলুদ … তার কণ্ঠটা চমৎকার। গিটারের রিদম্‌ সোজা সাপ্টা- তালটাও তাই। অনেকদিন পর তাকে দেখলাম। সারা মুখে চাপ দাড়ি গজিয়েছে। তাকে আমার সুদানের অধিবাসিদের মতন লাগছে। চারু বললো, নয়ন ভাই আপনাকে তো যীশুর মতন লাগছে। আমিও তাল মিলিয়ে বললাম রাইট আফ্রিকান যীশু, নয়ন খুব আপ্লুত হলো। মুন্না তার স্বভাবসিদ্ধ বক্তৃতা শুরু করেছে। তার কথাগুলো অনেকটা সিনেমার মতন। এখন এই-টা তারপর হঠাৎ ঐটা, আবার নিজে নিজেই হাসছে সে। নয়ন আর চারু বেশ মজা পাচ্ছে।
চারুর এইটা একটা বড় গুন, সে সব বিষয়ে হাসতে পারে।
মাহীন বললো, চারু তোর গানের এ্যালবাম কবে বের করবি? চারু উত্তর দিল- “যখন হয় তখন দেখা যাবে; আমার গান, বাজনা, জীবন নিয়ে আর কোনো উচ্চাশা নেই; যেমন আছি সারাজীবন তেমন থাকতে পারলেই আমি খুশি।” আমিও সায় দিলাম। আসলেই ঠিক, গান বাজনা এনজয় করতে পারলেই এনাফ।
মাহীন বললো, সে আর আগের মতন গান বাজনা এনজয় করছে না। মুন্না বললো, আমার সময় কাটেনা বলেই আমি গান বাজনা করি।
নয়নকে দেখলাম সে গান শোনার চাইতে গান গাওয়াটা এনজয় করে বেশী। সারা পৃথিবীতে আমি অনেক মানুষ দেখেছি, আমাদের চাইতে বিত্তবান আর উন্নত দেশগুলোতে বেশীরভাগ মানুষই কোন না কোন যন্ত্র বাজিয়ে থাকে, গানও শোনে প্রচুর; গান শোনাটা শুধু অডিওতে সীমাবদ্ধ নয়, সপ্তাহের দুটো দিন তারা লাইভ মিউজিক উপভোগ করে ক্লাবে না হয় বারে।
আর যারা মিউজিশিয়ান তাদের ব্যাপারটা অন্যরকম। তাদের উচিৎ সঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি কিভাবে সঙ্গীত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় সেটা রপ্ত করা। কারণ জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করা উচিৎ নইলে সাধনায় ব্যাঘাত ঘটতে বাধ্য।
ব্রাদার্স ইউনিয়নের মাঠে আমাদের আড্ডাটা বেশীক্ষণ আরামদায়ক হলো না। কারণ কিছুক্ষণ আগে চার/পাঁচ জন আদর্শবান যুবক এসে নয়নকে শাসিয়ে গেল গাঁজা খাওয়ার অভিযোগে অথচ তারাও গাঁজা খাচ্ছিল। নয়নের মুখটা বিমর্ষ, নাকে কপালে খামচির দাগ। ওরা তাকে শাসিয়ে, চড় মেরে শুধু ক্ষান্ত হয়নি বড় বড় নখ্‌্‌ দিয়ে খামচিও মেরে গেল।
রাত্র দশটায় আমরা মাঠ থেকে বেরিয়ে আসলাম। আমি আর মুন্না রওনা দিলাম গুলিস্তানে। হযরত গোলাপ শাহের মাজারের উল্টোদিক থেকে বসে পরলাম মিরপুরগামী বাসে। বৃষ্টি ভেজা রাত, আমি নেমে পড়লাম তালতলা বাস স্ট্যান্ডে।
ঘরমুখি মানুষের একটি গান শুনবেন-
Homeward Bound
(Simon & Garfunkel)
I’m sittin in the railway station
Got a ticket for my destination
On a tour of one night stands
My suitcase and guitar in hand
And every stop is neatly planned
For a poet and a one man band

Homeward bound
I wish I was
Homeward bound
Home, where my thought’s escaping
Home, where my music’s playing
Home, where my love lies waiting
Silently for me

Everyday’s an endless stream
of cigarettes and magazines
And each town looks the same to me
The movies and the factories
And every stranger’s face I see
Reminds me that I long to be
Homeward bound
I wish I was
Homeward bound
Home, where my thought’s escaping
Home, where my music’s playing
Home, where my love lies waiting
Silently for me

Tonight I’ll sing my songs again
I’ll play the game and pretend
But all my words come back to me
In shades on mediocrity
Like emptiness in harmony
I need someone to comfort me

Homeward bound
I wish I was
Homeward bound
Home, where my thought’s escaping
Home, where my music’s playing
Home, where my love lies waiting
Silently for me
Silently for me
Silently for me
(চলবে)

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধতাপদাহ বনাম মানবিকতার দহন