করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে মহাচিন্তিত আমাদের নীতিনির্ধারকরা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে শুরু হয়েছে লকডাউন। আপাতত ১১ এপ্রিল পর্যন্ত মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় সারা দেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে গণপরিবহণ-বাস, ট্রেন, লঞ্চ, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বন্ধ থাকবে। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত জরুরি প্রয়োজনে সীমিত পরিসরে খোলা রাখা যাবে। শপিং মল-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকবে। কিন্তু অর্থনীতিকে সচল রেখে কীভাবে তার মোকাবেলা করা যায়, তার পরিকল্পনায় ব্যস্ত আমাদের নীতিনির্ধারকরা। নানা ভাবনা তাঁদের ভিতর। অর্থনীতির বড় একটা সেক্টর হলো পোশাক খাত। করোনার প্রথম ঢেউ কাটিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বিভিন্ন দেশে নতুন লকডাউনে আবারও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা। তবে সেটি আগের মতো বড় আকারে হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জানা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বৈশ্বিক পোশাক আমদানি ২৩ শতাংশ কমে যায়। দেশে দেশে করোনার লকডাউনের কারণে মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দেয়। ফলে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে জমে পোশাকের স্তূপ। এতে অনেক ব্র্যান্ড কারখানাগুলোর আগের কার্যাদেশ বাতিল করে, অনেকে দামও কমিয়ে দেয়। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, করোনার কারণে ইউরোপ, আমেরিকায় পোশাক বিক্রি কমে গেছে। এখনো অনেক দেশে লকডাউনসহ কড়াকড়ি থাকায় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের পোশাক প্রস্তুতকারকরা অর্ডার কম পাচ্ছেন। আবার মহামারীর জন্য বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো পোশাক কারখানার মালিকদের সঙ্গে নানা ধরনের দেনদরবারে যাচ্ছে। কেউ অর্ডার কমানোর দাবি জানাচ্ছে, আবার কেউ দেরি করে পেমেন্ট করতে চাইছে। এসব দাবি না মানলে ব্র্যান্ডগুলো অন্য দেশের অন্য কোনো কোম্পানির কাছে চলে যাওয়ারও হুমকি দিচ্ছে। ফলে ব্যবসা হারানোর আশঙ্কায় দাবি মানতে বাধ্য হচ্ছেন পোশাক কারখানার মালিকরা।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশসহ নয় দেশের পোশাক প্রস্তুতকারকরা এক হয়ে নিজেদের মধ্যে একটি নীতিমালা বা চুক্তি তৈরির চেষ্টা করছেন। এ লক্ষ্যে একটি খসড়া ডকুমেন্টও প্রস্তুত করা হয়েছে। চলতি মাসের শেষ নাগাদ সেটি চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হতে পারে। বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, তুরস্ক, মরক্কো ও ইন্দোনেশিয়ার ১৩টি পোশাক সংগঠন এই উদ্যোগের সঙ্গে রয়েছে। জার্মানির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেডের অর্থায়নে পরিচালিত এশিয়ার বিভিন্ন দেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের সংস্থা স্টার নেটওয়ার্ক ও ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগ এটি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থনীতিই হলো রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রাণ। এতে পরিবার সমাজ জড়িত। এমনকি রাজনীতিও কোন পথে চলবে তাও অনেকাংশে নির্ধারণ করে অর্থনীতি। গত বছর করোনাঘাতের আগে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী একটি দেশ। নিম্ন আয়ের গণ্ডি থেকে উন্নয়নশীল শুধু নয়, উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশ। করোনাভাইরাস সেই সোনালি স্বপ্নকে অনেকটাই নিষপ্রভ করে দিয়েছে। ৮ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বদলে অর্জিত হয়েছে দুই শতাংশ। এ বছর প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকবে এমন কথাই বলেছিল বিশ্বের নেতৃস্থানীয় অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আতংকিত ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেই। বাংলাদেশে তার ভয়াল থাবা কতটা বিস্তার করবে এবং অর্থনীতির জন্য তা কতটা বিপদ সৃষ্টি করবে সে সংশয়ে শংকিত সবাই। এক্ষেত্রে পোশাক শিল্পে কীরকম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে- তা নিয়ে চিন্তিত তাঁরা। গার্মেন্টস কারখানা খোলা রেখে স্বাস্থ্যসেবা কীভাবে নিশ্চিত হবে সে ব্যাপারেও তাঁরা ভাবছেন। পোশাক খাতের বাজার নিয়েও ভাবছেন অনেকে। তাঁরা আশাবাদী। তাঁদের মতে, পোশাকের জন্য এখন অনলাইন বাজার গড়ে উঠেছে। নতুন বাজারও তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে দ্বিতীয় ঢেউ তেমন ক্ষতি করতে পারবে না।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, করোনাকালে অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়লে তা হবে আত্মহত্যার নামান্তর। ইতোমধ্যে করোনাকালীন ক্ষয়ক্ষতিতে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে। মানুষের জীবন-জীবিকায় সংকট ঘনীভূত হওয়ায় সহিংসতা উৎসাহিত হচ্ছে। ফলে লকডাউনের ভেতরেও কীভাবে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া যায় সে কৌশল রপ্ত করতে হবে। জীবনও বাঁচাতে হবে, সচল রাখতে হবে অর্থনীতিকেও।