ব্যক্তিগত পরিক্রমা

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ১২ এপ্রিল, ২০২৫ at ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ

শৈশবে আমাদের শ্রদ্ধেয় বাবা, নবজাতক সন্তান ঘুমালে খুব জোরে শব্দ করে থালাবাটি ছুঁড়ে ফেলতেন। আম্মার ভীষণ রাগ হতো, এই ভেবে যে কেমন পিতা তিনি? এত ভবঘুরে, এতটা উদাসীন। আদতে আমাদের দাদুমনি(বাবার মা) বোবা ছিলেন, তিনি আসলে কানেই শুনতেন না। আব্বা তাই যতটাই উদাসীন থাকতেন না কেন, সার্বক্ষণিক চিন্তায় থাকতেন এই বুঝি কোনো সন্তান বোবা হলো, কেউ কানা না হয় বধির। ভাগ্যকুলে আমার মায়ের গর্ভের অষ্টধনের কেউই আব্বাকে অপূর্ণ রাখলো না।

বলছিলাম দাদির কথা, জন্ম থেকেই নাকি কানে শুনতেন না ফলে শব্দ না শোনার কারণেই শিখতে পারেননি আর। কিছুটা বয়স বাড়তেই আত্মীয়র সাথে বিয়েতে বসেন। কিন্তু মেজাজের দরুণ প্রায় সময় বাপের বাড়ি নয়তো অন্যত্র ঘুরে বেড়াতেন। যেহেতু বোবা, সার্বক্ষণিক সন্দেহ করতেন কেউ উনার নামে বাজে বলছে, কিংবা প্রতারণার শিকার হবেন এখনই। মাথার এন্টেনা সদা সতর্ক রাখতেন। নানাবিধ জটিলতায় স্বামীর ঘর খুব একটা করা হয়নি। নিজের গর্ভে একটা মেয়ে আর ছেলে। আমার বাবাই ছিলেন বড়।

আমার মাবাবার বিয়েটা বিশাল এক নাটকীয় ঘটনা। আমার নানাভাই আব্বাকে কোনোভাবেই মেয়ে দিতে চাননি। পরে বিশাল সময় করে এই গল্প শোনানো যেতে পারে। আপাতত দাদি আম্মাকে মৃত্যুর আগ অব্দি পছন্দ করেননি এতসব কারণে। আম্মা ভীষণ শান্ত মেজাজের, ধৈর্য্যের মূর্ত প্রতীক। বাসর ঘরে আব্বাকে কথা দিয়েছিলেন, যেহেতু উনি অর্থাৎ দাদি কিছু বলতে পারেন না, অজান্তেও আম্মা কখনো কোনো অন্যায় করবেন না। এর পরিক্রমায় সারাজীবন দাদি নানাভাবে আম্মাকে ত্যক্ত করেছেন, কখনো রান্না ঘরের পোড়া পাতিল নিয়ে মহল্লা করা, কখনো ভুল ওষুধ খাওয়ানোর দায়ে বিবাদ, কখনো আব্বাবড় ভাইয়ের সাথে কূটনৈতিক রাজনীতিএমন কতকিছু। কিন্তু আম্মা খালি হাসতেন। কখনো কিছুটা মেজাজ দেখাতেন হয়তো। দাদিও খানিক ভবঘুরে, চকরিয়া মেয়ের ঘরে প্রায় চলে যেতেন একলা কখনোবা নাতনীদের নিয়ে। সে সময়টা আমাদের অর্থনৈতিক দশা খুব একটা ভালো না। আম্মার পা ফুলে ফেঁপে একাকার, সারারাত মেশিনে কাপড়জোড়া দিয়ে পায়ের পানি আর চোখের পানি এক। ভাইবোনেরা যার যার মতো যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এর মাঝেই দাদি একদিন ফুপুর বাসা থেকে চলে আসলেন, আর গেলেন না। এতটাই অসুখে পড়লেন যে, বিছানায় টানা চার মাস। আমাদের সে দৈন্যদিনে, আম্মা আর বড় আপা মিলে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছিলো বাঁচিয়ে তোলার। দাদি কিন্তু আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, লুকিয়ে ম্যাংগো জুস খেতে দিতেন, কখনো লজেন্স। কখনো আম্মা রসিকতা করে বলতেন, এখন যে যাচ্ছেন না মেয়ের ঘরে, আমাকে তো সারাজীবন অপছন্দই করলেন। এ যে সাক্ষাৎ বাংলা সিনেমার দৃশ্য। দাদি সত্যিই অঝোরে কেঁদে আম্মার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, কারণ আমার দাদি সবার ঠোঁটের চলন বুঝতেন।

আমাদের বাড়ির সামনে উঠান ছিল বিশাল বড়, বাড়ির মাঝেও ছিল খোলা উঠান। আম্মা খুব কম সময়ই বাইরের উঠানে কাপড় দিতেন, আপাদের দিয়েই দেওয়াতেন। আমার কাজ ছিল কিছুক্ষণ পর পর গিয়ে বাইরে কাপড় আর ঘরে দাদিকে পাহারা দেওয়া। একদিন আমি উঠানেই কাপড় পাহারা দিচ্ছি আর খেলছি। দাদির কথা যেন মনেই নেই। হুট করে আম্মা বললেন, কিরে গিয়ে দেখে আস। সত্যিই তখন এত অল্প বয়সে বুঝতে পারিনি, মানুষের মুখ থেকে ধ্বনি বের হওয়া কতটা জরুরি। এরপর ব্যক্তিগত পরিক্রমায় অনেকের মুখের ভাষা বন্ধ হতে দেখেছি, চোখের চাহনি দিয়ে গিলে খেতে দেখেছি, দেখেছি কতটা শক্তিশালী প্রাণ হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চায়।

অনেক বড় হতে হয়েছে, এতটুকু বুঝতে যে দাদি একজন নারী যার কতটা সামাজিক অপূর্ণতা ছিল। কথা বলতে না পারার দায়ে সমাজ বারংবার দাদির সর্বোচ্চ অধিকার কেড়ে নিয়েছে। পিতাস্বামী কারো সম্পত্তির ভাগ পাননি। যৌবনের তুমুল ঝড়ে নিজেকে বটি হাতে একলা ঘরে সন্তান নিয়ে গুটিয়ে থাকতে হয়েছে। নিজের চোখের সামনে তাই অন্যের সংসার, অন্যের সুখ সহ্যসীমার বাইরে ছিল। আমার মা ছিলেন বড়, ফলে তিনি কখনো ত্যক্ত সময়কে আর ঘোলা করেননি। আম্মা মৃত্যুর আগ অব্দি বলতেন, আমার সাথে যা হবে তা অন্যের সাথে হতেই হবে তা বাধ্যতামূলক নয়। আমি সহ্য করেছি তাই বলে অন্যরাও সহ্য করবেন তাও বাধ্যতামূলক নয়।

একটু বড় যদি হয়, বুঝতে পারি আমার মাও তো ছিলেন অল্প বয়সী বাবার আদুরে কন্যা। এতটা সীমাহীন ধৈর্য্য তো ধারণ না করলেও পারতেন। যার যৌবন থেকে বৃদ্ধ বয়স অব্দি কেবল পোহাতে হয়েছে, তার এতটা বুঝদার না হলেও বুঝি চলতো।

এখন কিছুটা তো আশপাশ দেখি, আমার পরিচিত একজনের শাশুড়ি তাদের বৌদেরকে উঠতে বসতে এক প্রকার শব্দের নির্যাতনে নাজেহাল করে ছাড়েন। একটু ভাবলে দেখা যায়, তিনিও তার শাশুড়ির দ্বারা এর চেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জানি, এ গল্প অনেক। বেশিরভাগ বৌশাশুড়ির ইতিহাসে এমনটাই চলে আসছে। পরিক্রমায় নারীদের উপর নির্যাতন এবং নারীদের ব্যক্তিগত পরিক্রমাকে ধ্বংস করে, সমাজের আরোপিত পরিক্রমায় পিষে মরা নারীরই ভাগ্য হয়েছে। দেবতা হয়েছেন পুরুষ তথা ঈশ্বর।

কিন্তু এই পরিক্রমায় নারী বা কেন এতকাল সহ্য করেছেন? সমাজে এখন বেশিরভাগ নারী প্রতিবাদ করে, সব ছুঁড়ে চলেও আসে। তাহলে আগের সাথে এখনের তফাৎ কোথায়? এখনকার নারীরা কি তবে বেহায়া, অভদ্র, স্বার্থপর? সত্য হলো, আগেকার নারী এই সকল শব্দকে ভয় পেতো ভীষণ। কেউ এসে বলবে বৌমা ভালো না, মিলেমিশে থাকতে পারে না, বৌ মা তো ভীষণ বেহায়ানারীর কাছে তার চরিত্র আকাশসম, শব্দগুলো ছিল কালো দাগ। ফলে নিজের চরিত্রকে ধূলিসাৎ যে হতে দেওয়া যায় না। তাকে রাখতে হবে সাদা আসমানের মত ফকফকা।

তবে এখনকার নারীদের প্রতিবাদই কি ঘর ভাঙ্গার কারিগরি জ্ঞান? এ উত্তরও আপনার জানা। নারীরা এখন বুঝতে শিখেছে নিজেদের পছন্দঅপছন্দ, সুখআহ্লাদ, ন্যায়অন্যায়, ভালো মন্দ। সর্বোপরি নিজের মতো বাঁচতে শিখেছে। এখনকার কোনো নারীই আর তথাকথিত বৌমা হতে চায় না, হতে চায় না শাশুড়িও। ব্যক্তিগত পরিক্রমায় প্রয়োজনে আরো এক ধাপ বেশি ঘুরবে বরঞ্চ। ফলে পরিবর্তনই মূল আত্মশুদ্ধি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসরায়েলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান
পরবর্তী নিবন্ধনারী কৃষকদের স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি