১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে একটি সূচ কারখানার মহিলা শ্রমিকগণ মানবেতর জীবন, মজুরি বৈষম্য, কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করার প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই মিছিলে চলে পুলিশি নির্যাতন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নারীদের সমঅধিকার দিবস হিসাবে দিনটি পালিত হয়। ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে জাতিসংঘ আন্তর্জতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশেও পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
এই যে একটি দিবস তার পিছনে আছে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। আমাদের নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সর্বত্র সরব, সোচ্চার। অর্থনৈতিকভাবে তারা স্বনির্ভর হচ্ছেন। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার বাইরে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন এখনো বাকী থেকে যায়। এখনও নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি। এখনও ব্যাপকভাবে ইভটিজিং, যৌন নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে। যৌতুকের বলি হচ্ছে নারী। বন্ধ হয়নি এখনও বাল্যবিয়ে। বিশ্বের যে কোনো দেশে নারীর অবস্থান বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের নারীর অবস্থানের কথা বিশেষভাবে মূল্যায়িত হবে। তারপরও এই জায়গাটিতে নারীর শতভাগ মুক্তি আসেনি। নারীকে তার অবস্থান ঠিক রাখার জন্য এখনও সোচ্চার হতে হয়।
যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে’– অনেক আগে থেকে প্রচলিত এ–কথাটি তখনকার প্রেক্ষাপটে কতটুকু প্রযোজ্য ছিল জানি না; কিন্তু এখনকার সমাজে এটি সর্বাংশে সত্য।
‘আমরা নারী সব পারি’ –এই স্লোগানকে সামনে নিয়ে নারী এগিয়ে চলেছেন।
পরিবারের সচ্ছলতা আনতে সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি কাজ করেই চলেছেন। সংসার করছে, স্বামী–সন্তানও সামাল দিচ্ছে। স্বামী–স্ত্রী দু’জনই কাজ শেষে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে টিভি দেখায় মজে যাওয়া স্বামীর হাতে গরম চায়ের পেয়ালাটাও তুলে দিচ্ছে নারী। হ্যাঁ, নারী পারে, সবকিছুই পারে।
তথ্য অনুসারে প্রায় ৫ কোটি কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি নারী। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক গবেষণা মতে, ১৯৯৫–৯৬, ২০০২–০৩, ২০০৫–০৬ এবং ২০১১–১২ সালে মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল যথাক্রমে ১৫.৮ শতাংশ, ২৬.১ শতাংশ, ২৯.২ শতাংশ এবং ৩৯.১ শতাংশ।
২০১৩ সালে শ্রমশক্তির বাইরে ছিল ৩ কোটি ৬১ লাখ নারী। পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২–এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ৪২ দশমিক ৬৮, যা ২০১৬ সালের ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। যদিও এই তথ্যমতে, কর্মক্ষম নারীদের ৫০ শতাংশেরও বেশি। যা ২০১৭ সালে কমে ৩ কোটি ৪৫ লাখে দাঁড়িয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর সংখ্যা বেশি। নারীরা পূর্ণকালীন কাজ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।
বাংলাদেশে পোশাক রপ্তানি খাতে অধিংকাশই মহিলা ও শিশু। যারা দরিদ্রসীমার নীচে বাস করছে। এই শিল্প প্রসারের ফলে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পায়। এ–শিল্পে বর্তমানে কাজ করে প্রায় ৯০ ভাগ নারী শ্রমিক। কিন্তু এই খাতে শ্রমিকদের সর্বাধিক অবদান থাকলেও তারা তাদের ন্যূনতম আইনগত অধিকারসহ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন– ন্যায্য মজুরী, ছুটি, ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ সকল আইনগত অধিকার। তারা যেখানে কাজ করে সেখানে তাদের যে সকল অধিকার আইনে স্বীকৃত এবং সেগুলি লঙ্ঘিত হলে কি পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে সম্পর্কে তারা সচেতন নয়। তাই বিভিন্ন কারখানায় দিনের পর দিন তাদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছে। নারী শ্রমিকদের শতকরা ৮০ ভাগ গার্মেন্টস কারখানায় যে–সমস্যাগুলো বিরাজমান তা হলো– আইন অনুযায়ী সঠিক সময়ে নারী শ্রমিকদের মজুরী পরিশোধ না করা ও মজুরী বৈষম্য করা।
বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা মতে, কৃষিতে নারীর অবদান গড়ে ৬০–৬৫ শতাংশ; তারপরও জিডিপিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি।
কৃষিক্ষেত্রে নারীর শ্রমমূল্য অর্ধেক। অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাংকের হিসাব খোলা ও মুঠোফোনে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে আছে। এই পিছিয়ে থাকার কারণে অবাধ তথ্যপ্রবাহ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। দারিদ্র্য ও ভূমিহীন হওয়ার কারণে নারীকে সামান্য মজুরীর বিনিময়ে কৃষিতে কাজ করতে বাধ্য করেন। প্রযুক্তির ব্যবহার সাধারণত পুরুষের হাতেই থাকে। যদিও আইনে কৃষি কাজে স্বনিয়োজিত নারী শ্রমিকদের এই সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করেনি। শুধুমাত্র সহায়তাকারী হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কৃষিকাজে নিয়োজিত এ–সকল নারী শ্রমিকদের সাধারণত জমির উপর কোনো মালিকানা নেই, তাদের ঋণ পাবার, উন্নত প্রযুক্তি ও সেবা পাবার সুযোগ নেই। দেশের বিভিন্ন রাইস মিলগুলোতে অসংখ্য শ্রমিক কাজ করে, এর মধ্যে অনেক নারী শ্রমিক রয়েছে। আর্থ–সামাজিক অবস্থার কারণ মিলগুলিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের বিরাজমান সমস্যাগুলো হচ্ছে রাইসমিলগুলোতে কাজের সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নাই, নারী শ্রমিকদেরকে দৈনিক গড়ে ১৫/১৬ ঘন্টা কাজ করতে হয়। রাইসমিলগুলোতে কর্মরত শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত ন্যায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, মজুরী বৈষম্যের কারণে নারী শ্রমিকদেরকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে অধিক কষ্টদায়ক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকেন।
বিশেষত একটু বয়স্ক যারা উনারাই ইটভাঙা, মাটিকাটা বা মালামাল বহনের কাজ করে। অনেককে সন্তান সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে দেখা যায়। তীব্র রোদ ও বৃষ্টির মধ্যে খোয়ার ওপরে বা পাশে দুগ্ধ পোষ্য শিশুকে বসিয়ে মাথার ওপর ভাঙা ছাতা ধরে কাজ করেন এবং ওড়না, গামছা বা শাড়ির আঁচল দিয়ে সন্তানকে বুকে, পিঠে বেঁধে মাথায় ইট বা মাটির ডালি বহন করেন যা অত্যন্ত কষ্টকর।
নারীরা এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মী হিসেবে যাচ্ছে এবং এ হারও ঊর্ধ্বমুখী। বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী।
ক্ষুদ্রঋণের ৮০ শতাংশ ব্যবহারকারী হিসেবে নারীরা কাজ করছে।
নারীর এই এগিয়ে যাওয়ার পথ কিন্তু এতো মসৃণ , সুরভিত ও নন্দিত নয়। স্বামী, সন্তান ও পরিবারকে সামাল দিয়ে রাস্তাঘাট, যানবাহন ও কর্মস্থলের বহুবিধ প্রতিকূলতাকে তুচ্ছজ্ঞান করেই নারীর টিকে থাকতে হচ্ছে কর্মবাজারে।
পুরুষের সমান কাজ করেও নারী শ্রমিক মজুরি কম পান। অথচ বিআইডিএসের গবেষণায় পাওয়া তথ্যমতে, কর্মক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর মনোযোগ ও আন্তরিকতা বেশি। তারপরও একজন পুরুষ শ্রমিক যেখানে দৈনিক ৩৬১ টাকা পায়, সেখানে একজন নারী শ্রমিক পাচ্ছে মাত্র ২৭৪ টাকা। আর গ্রামাঞ্চলে একই কাজে অনেক কম মজুরী মিলছে।
নারী শ্রমিক পুরুষ শ্রমিকের সমান পারিশ্রমিক কেন পায় না? একজন পুরুষ শ্রমিক যদি সারা দিন ৮ বা ১০ ঘণ্টা কাজ করে, একজন নারী শ্রমিকও সমপরিমাণ সময়ই কাজ করছে।
তাহলে কেন তাকে কম বেতন দেয়া হবে? অনেক শিল্প মালিক বলে থাকেন তাদের বেতন বাড়ালে শিল্প টিকবে না।
নারীরা ঘর, পরিবার, সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাদের মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র। শ্রমিক নারীদের অবদানের কারণে আমরা যতটুকু এগিয়ে গিয়েছি, সেটাও স্বীকার করার প্রবণতাও নেই। এটা খুবই দুঃখজনক।’
নারী তার প্রাপ্য সম্মান, শ্রদ্ধা, সামাজিক স্বীকৃতিটুকু যেন পান। পুরুষের পাশাপাশি নারীও যেন একসাথে পথ চলতে পারে, সম্মানের সহিত তার প্রাপ্যটুকু দিয়ে যেন পুরুষও নারীর পাশে এসে দাঁড়াতে পারে। নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান, শ্রদ্ধা উদযাপন যেন মুখ্য বিষয় না হয়। নারীদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠাটি যেন খুবই গুরুত্ব পায়। সমাজে জনসচেতনতা বাড়ুক। বৈষম্য দূর হোক।