বৈশাখী মেলায় মুখর লালদীঘি

বসেছে পাটি, পাখা, ফুলঝাড়ুসহ বাহারি পণ্যের পসরা

ঋত্বিক নয়ন | বুধবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

ক’দিন ধরে রুষ্ট প্রকৃতি নগর জীবনকে স্থবির করে দিতে চাইছে। এমনিতেই নগর জীবনে আমোদ প্রমোদের ইচ্ছে, সময়, স্থান ক্রমশ কমছে। বাড়ছে সংকট। এ সময়ে দু’দণ্ড স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিতে গত ২৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে বৈশাখী মেলা।

বাঙালির ঐতিহ্য টিকে আছে বাঙালি সংস্কৃতিতে। যতোই যান্ত্রিকতায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠি না কেন, আমাদের ভেতরে যে নিত্য বইছে লালন, হাছন, রাধা রমণ কিংবা বাউল শাহ আব্দুল করিম, হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ আর চেতনাতে নজরুল। ঐতিহ্যের টানেই শত বছর ধরে চলছে জব্বার সওদাগরের এ আয়োজন। দেশের সবচেয়ে বর্ণিল ও ঐতিহ্যবাহী এই মেলার ভিডিওগ্রাফি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সারা বছর জব্বারের বলী খেলা ও বৈশাখী মেলার অপেক্ষায় থাকে। চট্টগ্রামের মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসব এটি। আয়োজনটি নগরবাসীকে বিরাট আনন্দের উপলক্ষ এনে দেয়। গতকাল মেলার দ্বিতীয় দিনে সময় যত গড়াচ্ছিল মানুষের ঢল বাড়ছিল। বাড়ি ফেরার পথে দেখা যায় ছেলে বুড়ো সকলের হাতে কিছু না কিছু আছেই। কারো হাতে পাখা, কারো বা মাটির ব্যাংক, খেলনা, মুড়ি মুড়কি। মিষ্টি খাবার, মাটির জিনিসপত্র, হাল আমলের মুখোশ, ফুলঝাড়ু, শীতল পাটি নিয়ে ফিরছে সবাই। বাচ্চাদের পাশাপাশি বুড়োদের হাতেও শোভা পাচ্ছে বাঁশি, মাথার লাইট জ্বালানো শিং কিংবা ঢোল। ঢোল বাঁশি যখন হাতে তখন বাজাতে ইচ্ছে করবেই। বেসুরো সুরে, তালে বেতালে বাজছে বাঁশি, বাজছে ঢোল। একসময় বৈশাখী মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাঁশের ও মাটির তৈরি বাঁশি। ছোটবড়, কিশোরকিশোরী এমনকি তরুণদের হাতেও সেইসব বাঁশি দেখা যেত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসেছে বাঁশের বা মাটির তৈরি বাঁশি। তার স্থলে এখন বৈশাখের উৎসবে ভুভুজেলার দৌরাত্ম্য বেড়েছে। সর্বত্রই ভুভুজেলার বিকট আওয়াজে বাঁশের বাঁশির সুর আরো ম্রিয়মান।

প্রতি বছর মেলায় ঘুরে ঘুরে হাতপাখা বিক্রি করেন বাঁশখালীর খায়রুল বাশার। তিনি জানান, এ মেলার কিছু বিশেষত্ব আছে। যেমন প্রথম দুই দিন বিক্রেতারা বেশি দামে পণ্য বেচেন। শেষের দিন বলতে অনেকে লসেও বিক্রি করেন। আবার দিনের বেলা পুরুষদের ভিড় থাকে মেলায়। রাতে ও ভোরে নারীরা পছন্দের জিনিস কিনে নিয়ে যান স্বাচ্ছন্দ্যে। সিলেটের বিখ্যাত শীতলপাটি বিক্রি হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের সামনের কয়েকটি স্টলে। বিক্রেতারা জানান নকশা ও মান ভেদে দেড় হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে একেকটি শীতলপাটি। তবে শীতলপাটির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে প্লাস্টিকের মাদুর। মেলায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ফুলের ঝাড়ু। হাজার হাজার ফুল ঝাড়ু বিক্রি হচ্ছে। মেলা ফেরত বেশিরভাগ সংসারী মানুষের হাতেই দেখা গেছে ফুলঝাড়ু। এক জোড়া ফুলঝাড়ু ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে আড়াইশ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ফুলের পরিপক্বতা, বাঁধাইয়ের মানের ওপর দাম নির্ভর করছে। রাউজানের নোয়াপাড়া থেকে মেলায় এসেছেন অজয় দেব। তিনি জানান, পাহাড়ি এলাকা থেকে ঝাড়ু তৈরির ফুল সংগ্রহ করে শহরেই বাঁধাই করা হচ্ছে। প্লাস্টিকের পাইপ, বেত, প্লাস্টিকের সুতা, অ্যালুমিনিয়ামের তার ইত্যাদি ব্যবহার করে ফুলঝাড়ু তৈরি হচ্ছে। আন্দরকিল্লা মোড়, জেল রোড, জেল গেইট, লয়েল রোড, পুরাতন গির্জা থেকে শুরু করে পুরো মেলা জুড়েই ফুলঝাড়ু ও হাতপাখা বিক্রি হচ্ছে।

ঢাকার কালীগঞ্জ থেকে পাটের তৈরি জিনিস নিয়ে নয়ন ভূঁইয়া এসেছেন মেলায়। দোলনা, চেয়ার, পুতুল, শোপিস, টেবিল ম্যাট ইত্যাদি পঞ্চাশ পদের পণ্য নিয়ে স্টল সাজিয়েছেন তিনি। কালারফুল এসব পণ্য দেখে থমকে দাঁড়াচ্ছেন শৌখিন ক্রেতারা। পছন্দ হলেই শুরু দরকষাকষি।

লালদীঘির মাঠের উত্তর প্রান্তে নাগরদোলা বসানো হয়েছে। নানা বয়সী মানুষ এসব নাগরদোলায় চড়তে ভিড় জমাচ্ছেন। যথারীতি লালদীঘির উত্তরপশ্চিম প্রান্তে ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারার স্টল রয়েছে। এসব চারায় ঝুলছে বাহারি আম, কমলা, লেবু, আমড়া, সফেদা ইত্যাদি। বৃক্ষপ্রেমীরা কিনছেন পছন্দের চারা। লালদীঘির পশ্চিমদক্ষিণ প্রান্তে আছে বেতের তৈরি সোফা, চেয়ার ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের মোড়া বিক্রি হচ্ছে মেলায়। সিনেমা প্যালেস মোড়ে কাঠের তৈরি সস্তা খাট, পালং, ওয়ারড্রব, আলনা, শোকেস ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে।

হাজারী গলির মুখ পর্যন্ত মৃৎশিল্প সামগ্রীর বিশাল পসরা। মৃৎশিল্প সামগ্রী আছে লালদীঘির মাঠের পেট্রোল পাম্পের সামনেও। এবার মৃৎশিল্পসামগ্রীতে শৈল্পিক ছোঁয়া লেগেছে। বর্ণিল রঙের আঁচড়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ফুলদানি, মাটির ব্যাংক ইত্যাদি। শীতল পানির জন্য কিছু মাটির পাত্রে ট্যাব লাগানো দেখা গেছে। বরাবরের মতো বেশি বিক্রি হচ্ছে মাটির ব্যাংক, ফুলদানি, বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিকৃতি, খেলনা ইত্যাদি।

মেলার ঘোষণা মঞ্চ থেকে মাইকে বারবার প্রচার করা হচ্ছেমেলা কমিটি চাঁদা আদায় করে না। কেউ চাঁদা দাবি করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করার জন্য। দোকানিরাও জানিয়েছেন, এবার চাঁদাবাজি নেই বললেই চলে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলালদীঘি মাঠে চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব আজ
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানে পৃথক দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু