বৈবাহিক প্রতারণা প্রতিরোধ প্রসঙ্গে আইন

জেনে নিন আপনার যত অধিকার

জিয়া হাবীব আহসান | শুক্রবার , ২৫ জুন, ২০২১ at ৭:২৯ পূর্বাহ্ণ

বৈবাহিক প্রতারণা প্রতিরোধে সকলের আইন জানা উচিত। কেননা আইন ধরে নেয় যে, সকলেই আইন জানেন। আইন না জানার অজুহাতে অপরাধের শাস্তি থেকে বাঁচা যায় না। আসুন প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে জেনে নিই আমাদের অধিকার।
প্রশ্নঃ এক স্ত্রী বহাল থাকতে আরেক বিবাহ করতে কার অনুমতি নিতে হবে?
উত্তরঃ শুধুমাত্র প্রথমা স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে ২য় বিবাহ করা যায় না । এর জন্য স্বামীকে আরবিট্রেশন কাউন্সিল থেকে ২য় বিবাহের অনুমতি নিতে হবে । মুসলিম আইনের আরবিট্রেশন কাউন্সিল কর্তৃক নিম্নের কারণগুলোর যে কোনটি প্রমাণিত হলে যে কোন স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দিতে পারেন- ১) প্রথমা স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব, ২) তার শারীরিক অসুস্থতা, ৩) তার মানসিক অসুস্থতা এবং ৪) দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখার অক্ষমতা ইত্যাদি । আরবিট্রেশন কাউন্সিলের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে প্রথম স্ত্রীর সম্পূর্ণ মোহরানার টাকা ২য় বিয়ের সাথে সাথেই পরিশোধ যোগ্য হয় এবং প্রথমা স্ত্রী ফৌজদারী আদালতে আইন ভংগের জন্য স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করলে স্বামীর জেল, জরিমানা অথবা উভয়বিধ সাজা হতে পারে।
প্রশ্নঃ সাক্ষী ছাড়া বিবাহ বৈধ হবে কিনা ?
উত্তরঃ মুসলিম আইন অনুযায়ী একটি বৈধ বিবাহ সম্পন্ন করার জন্য দুজন সাক্ষীর প্রয়োজন হয় । সাক্ষীর অভাবে বিয়ে বৈধ (ছহি) হয় না। তবে একে অবৈধ (বাতিল) বলা যায় না। সাক্ষী বিহীন বিবাহ বৈধ ও অবৈধ অবস্থায় মাঝামাঝি আরেকটা অবস্থায় থাকে বলে ফাছিদ বিবাহ । ফাছিদ বিবাহের পরিণতি নিম্নরূপ-
১। স্বামী অথবা স্ত্রী যে কোন জন তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন, ২। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে কোন যৌন মিলন না হয়ে থাকলে ফাছিদ বিবাহের কোন আইনগত পরিণতি নেই, ৩। যদি তাদের মধ্যে সহবাস হয়ে থাকে তাহলে ক) স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে মোহরানা পাবেন, খ) বিবাহ বিচ্ছেদের পর স্ত্রীকে তিন মাস ইদ্দত পালন করতে হয় । এমনকি স্বামীর মৃত্যুর পরও তাকে শুধু তিন মাস ইদ্দত পালন করতে হয়। (গ) তাদের সন্তান আইনে বৈধ হিসেবে পরিগণিত হবে । কিন্তু স্বামী ও স্ত্রী দু’জনের একজন অন্য জনের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে দাবী করতে পারবেন না।
প্রশ্নঃ কোর্ট ম্যারেজ কি? সাবালক যুবক যুবতীর বিয়ের সহজ পদ্ধতি কি ?
উত্তরঃ আইনে কোর্ট ম্যারেজ বলতে কিছুই নেই। এমনকি কোর্ট ম্যারেজ করার জন্য সরকার কর্তৃক কোন লোকও নিয়োজিত নেই । নোটারী পাবলিক কিংবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বর ও কনের সম্পর্কের কথা বলে পঞ্চাশ টাকার স্ট্যাম্পে হলফ করে বলার নামেই এফিডেভিট । এটাকে সচারাচরভাবে সবাই কোর্ট ম্যারেজ বলে থাকেন । অনেক টন্নি টাউট পাঁচ / দশ হাজার টাকা সংশ্লিষ্টদের থেকে হাতিয়ে নেয়। অথচ নিকাহ রেজিষ্ট্রি অফিসে সামান্য কাবিন রেজিস্ট্রি খরচে সমস্ত ঝামেলা চুকিয়ে ফেলা যায় । মুসলিম আইনে বিবাহ অত্যন্ত সহজ । যে কোন সুস্থ সাবালক (মেয়ে ১৮ বছর, ছেলে ২১ বছর) যুবক যুবতী দুই জন পুরুষ বা একজন পুরুষ দুইজন মহিলাকে সাক্ষী রেখে তাদের মোকাবিলায় ইজাব কবুলের মাধ্যমে বিবাহ করতে পারে। এ ধরনের বিয়ের কাবিন রেজিস্ট্রি করতে নিকাহ রেজিষ্ট্রার আইনতঃ বাধ্য । সাবালক ও সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন মুসলিম স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে পারেন, তবে নাবালকের ক্ষেত্রে অভিভাবক এর অনুমোদন আবশ্যক ।
প্রশ্নঃ বাল্য বিবাহের জন্য কারা শাস্তি ভোগ করবেন ?
উত্তরঃ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ এর ৭ ধারায় বলা হয়েছে যে,প্রাপ্ত বয়স্ক কোন নারী বা পুরুষ বাল্য বিবাহ করলে তা একটি অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে এবং তার জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।এছাড়া অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোন নারী বা পুরুষ বাল্য বিবাহ করলে তিনি অনধিক ১ (এক) মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তিযোগ্য হবেন।তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৮ এর অধীন কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বা দণ্ড প্রদান করা হলে উক্তরূপ অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী বা পুরুষকে শাস্তি প্রদান করা যাবে না। আবার এই আইনে বাল্য বিবাহ সংশ্লিষ্ট পিতা-মাতাসহ অন্যান্য ব্যক্তির শাস্তির ব্যাপারে ৮ ধারায় বলা হয়েছে, পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা অন্য কোন ব্যক্তি, আইনগতভাবে বা আইনবহির্ভূতভাবে কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির উপর কর্তৃত্ব সম্পন্ন হয়ে বাল্য বিবাহ সম্পন্ন করবার ক্ষেত্রে কোন কাজ করলে অথবা করার অনুমতি বা নির্দেশ প্রদান করলে অথবা স্বীয় অবহেলার কারণে বিবাহটি বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে উহাও একটি অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে এবং তার জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর ও অন্যূন ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। অন্যদিকে বাল্য বিবাহ সম্পাদন বা পরিচালনা করার শাস্তির ব্যাপারে এই আইনের ৯ ধারা মতে কোন ব্যক্তি বাল্য বিবাহ সম্পাদন বা পরিচালনা করলে তা একটি অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে এবং তার জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর ও অন্যূন ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
প্রশ্নঃ বাল্য বিবাহের অনুষ্ঠান কিভাবে স্থগিত করা যায়?
উত্তরঃ বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে চান কিন্তু ভেবে পান না যে কিভাবে কোন বাল্য বিবাহ বন্ধ করবেন । বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ এর ৪ ধারায় বাল্য বিবাহ কিভাবে বন্ধ করা যাবে তার বিধান রাখা হয়েছে। বাল্য বিবাহ বন্ধে কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধির কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, ধারা ৫ এর বিধানের সামগ্রিকতাকে ক্ষুণ্‌ন না করে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, কোন ব্যক্তির লিখিত বা মৌখিক আবেদন অথবা অন্য কোন মাধ্যমে বাল্যবিবাহের সংবাদ প্রাপ্ত হলে তিনি উক্ত বিবাহ বন্ধ করিবেন অথবা বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।এছাড়া বাল্য বিবাহ বন্ধে আদালতকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাল্য বিবাহ বন্ধে ইচ্ছুক ব্যক্তি আদালতে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ এর ৫ ধারার বিধান মোতাবেক আদালতে বাল্য বিবাহ বন্ধের জন্য আবেদন করতে পারবেন। ৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, আদালত, স্ব-উদ্যোগে বা কোন ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে বা অন্য কোন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে, যদি এই মর্মে নিশ্চিত হন যে, কোন বাল্য বিবাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে অথবা বাল্য বিবাহ অত্যাসন্ন তাহলে আদালত উক্ত বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবেন।আদালত স্বেচ্ছায় বা অভিযোগকারী ব্যক্তির আবেদনের ভিত্তিতে উক্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারবেন। যদি কোন ব্যক্তি আদালত কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করেন, তিনি অনধিক ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ১ (এক) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। পরবর্তী সংখ্যায় এতদ সংক্রান্তে আরো আলোচনার প্রত্যাশা রাখি ।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, সুশাসন ও মানবাধিকার কর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুধীন্দ্রনাথ দত্ত : আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পুরোধা
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা