একাত্তরের যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে হাহাকার বেদনাময় বাংলায় স্বাধীনতার সূর্যের হাসি এক অনাবিল প্রশান্তি। প্রথমে গ্রামে, মিরসরায়ে। পরে শিক্ষা ও কৃষ্টির তাগিদে ছুটি নগরের টানে। যুদ্ধ শুরু এই নগরে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষায় ছুটি এক রাতের অন্ধকারে গ্রামে। যুদ্ধের পর আবার শহরমুখী শিক্ষার তাগিদে ঠিকানা হয় আলকরন। সঙ্গীতের একটি ধারা ছোট বেলা থেকেই জন্ম নেয় অন্তরে তা আজও ভক্তিসহকারে লালন করি। সংগঠিত হয়েছে এখানে নবকল্লোল নামে এক সাংস্কৃতিক সংগঠন। চন্দ্রশেখর দত্ত, মুনির ভাই, মঞ্জুভাই সহ পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গীবাজার, আলকরণ সেই সময়কার উদীয়মান শিল্পীদের নিয়ে প্রতিবাদী গান উচ্চারণে শিল্পীরা পথে প্রান্তরে পথ নাটক সঙ্গীতানুষ্ঠান আলোচনায় জনগণকে বিরাণ ভূমিতে আশা সঞ্চারে উদ্বুদ্ধ করতো। ঐ সকল অনুষ্ঠানে বেগম মুশতারী শফীসহ আরও অনেকে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলো। তারা দুঃসময় কালের আলোকপাত করতো। উনার সাথে স্কুল বয়সকালে আমার হৃদ্য পরিচয়। আমার গান খুব ভালোবাসতেন। ৭০ এর দশকে বিআরটিসি স্টেশন তখন মাঠ ছিল। সেখানে চট্টগ্রামের অনেক প্রথিতযশা শিল্পীরা একত্রিত হয়ে মৌলিক অনুষ্ঠান করতেন স্বদেশ প্রিয়তার। আলাউদ্দিন ললিতকলা একাডেমীর নৃত্য গুরু রুনু বিশ্বাস তার ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে। অশোক সেনগুপ্ত বঙ্গশ্রী দল নিয়ে। রবিন দাশগুপ্ত উদীচির দল নিয়ে। ফণীভূষণ বড়ুয়া গণসঙ্গীত দল নিয়ে। নবকল্লোল সংঘ থেকে আমরা। বঙ্গশ্রী থেকেও অনেক অংশগ্রহণ করেছি। তখন অধ্যক্ষ বিভূতি ভূষণ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক রণজিৎ চক্রবর্তী, বেগম মুশতারী শফী তাদের আলোচনা শোনার জন্য মানুষ উম্মুখ ছিল। সেই হরিখোলার মাঠে, জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে, মুসলিম হলের বাইরে, শহীদ মিনার প্রকোষ্ঠে, এসব আয়োজন বাঙালিদের প্রাণে স্বদেশ সংস্কৃতির শ্রদ্ধা অনুরণিত করতো। জাতীয় দিবসগুলি ছাড়া আরও নানান সংস্কৃতি কর্মকাণ্ড তখন প্রকট ছিল। যুদ্ধের পর বাঙালির অপমান কষ্ট ভোলার এই ছিল হাতিয়ার। তখন প্রতিবাদী মুখর বেগম মুশতারী শফী এসব কর্মকাণ্ডের অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে। একাই হেঁটে চলেছে অগ্নিমশাল অন্তরে জ্বেলে। তার শোষকদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর মানুষকে আন্দোলিত করেছে। স্বজনহারা কঠিনতায় তিনি শোষণমুক্ত মানুষ ও নারী মুক্তির পদাবলী গেয়ে গেছেন। তার প্রতিটা বই ও লেখনীতে আছে এই উদাত্ত আহবান। তিনি শিক্ষা নয় বিবেক সংস্কারের শিক্ষায় ব্রতী হতে বলেছেন সকলকে। স্বদেশের ক্ষতি যারা চায় তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। এই সকল আদর্শ চিন্তা ভাণ্ডার তার প্রগতিকে সৃষ্টি শীল মনস্কয়তায় রূপ দান করেছে। তিনি একাধারে লেখক, সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিসেবী, নাট্যকার। চমৎকার বিষয় তিনি নাটক লিখেছেন সমাজকে ন্যায়ের পথে শান্তি- এই মূলমন্ত্র শুধিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রে চাকুরী কালীন মৌলিক নাটক ৯ টি, অন্য লেখকের গল্প উপন্যাস থেকে ৮ টি নাটিকা ও জীবন্তিকা রচনা করেন। তাছাড়া বেতারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা পরিকল্পনা তার কৃতিত্বকে সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।
আমি উনার ছোঁয়া অনেক পেয়েছি পরম আদরে মায়ের মমতায়। একই মঞ্চে গান ও কথামালায় তার আনন্দ উচ্ছ্বাসে আপ্লুত হয়েছি। তিনি একজন নির্ভীক সৈনিক। ১৯৭১ সালে বাটালী রোডের এই মুশতারী লজ এ তিনি উদ্যোক্তা ও প্রধান প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদ সহ দশজনের পাঁচ জনকে নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার প্রথম পরিকল্পনা গড়ে তোলেন এবং এ বাড়িতে গোপনে বিপ্লবী বেতারের কার্যক্রম চালানো হয়। তাছাড়া তিনি একজন জেদী নারী। তার বলিষ্ঠ সাহসিকতায় মুক্তি যোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষণ ও তাদের সাহায্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি একজন প্রগতিবাদী নারী ছিলেন। তিনি নারী প্রগতির জন্য সম্পাদনা করেছেন ‘বান্ধবী’ মাসিক পত্রিকা। তিনি সভাপতি ছিলেন উদীচির, করেছেন প্রগতি ও বাস্তবতার ধারায় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার মানবাধিকার লড়াই। উপদেষ্টা ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ চট্টগ্রাম-এর। যে সময়কার কথা বলছি তখন শিল্পকলা একাডেমী ছোট্ট একটি টিনের ছাউনি ঘর। তার সম্মুখে মাঠে মঞ্চ তৈরি করে নানা অনুষ্ঠানে তিনি আয়োজন করতেন। উদ্দশ্যে ছিলো চট্টগ্রামের প্রগতি। এ মূলমন্ত্র সরকার ও প্রগতিশীলদের উদ্বুদ্ধতায় অনুপ্রেরণা যোগানো। তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতেন সমালোচনার উর্ধ্বে, নিঃস্বার্থ পদচারণায়। উনার সান্নিধ্যে আমরাও নানাভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমায় বলতো সঙ্গীতের মধ্যদিয়ে মানুষের বাঁচার মৌলিক অধিকার ও মানুষের আনন্দের মৌলিক বিষয়গুলো উপস্থাপন করো। আমি নারী অধিকার, স্বদেশপ্রিয়তা নিয়ে গণসঙ্গীতমূলক কিছু গান রচনা ও সুর করে একই মঞ্চে তার উপস্থিতিতে উপস্থাপন করেছি। আনন্দাশীর্বাদ করেছেন ডেকে। সেই গণজাগরণ মঞ্চে, বিশ্ব নারী দিবস মঞ্চে। তিনি নিজে করেন অপরকে করতে শেখান।
তিনি এত প্রতিবাদী ছিলেন যে, ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি অন্যান্য পেশাজীবী ও সংস্কৃতির কর্মীদের নিয়ে আন্দোলন শুরু ও বেগবান করেছেন। শোষণ ও শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের, নারী মুক্তির, একাত্তরে তার জীবন্ত ইতিহাস, ভ্রমণ, এসব প্রসঙ্গে তিনি ২৫ টি গ্রন্থ লিখেছেন।
তিনি মহীয়সী, তার কর্মদক্ষতায় সমাজ রাষ্ট্র তাকে নানাভাবে সম্মাননা ও পদকে ভূষিত করেন। ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ‘’বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ’ প্রদান করে। ২০২০ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘বেগম রোকেয়া পদকে’ ভূষিত করা হয়। আমরা চট্টগ্রামবাসী গর্বিত।
তিনি বাম রাজনীতির প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সমাজতন্ত্রের উপর একান্ত বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করেন পঞ্চাশের শেষ দিকে।
১৯৬৪ সালে নারীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় অবাধ স্বাধীনতা দৃঢ় প্রত্যয়ে দ্বার উন্মোচনে নারীদের লেখা সংগ্রহ করে বান্ধবী সংঘের মুখপাত্র হিসেবে ‘মাসিক বান্ধবী’ বের করেন। এবং দীর্ঘ ১১ বছর তা সম্পাদনা করেন।
নারীদের প্রগতিকল্পে শিক্ষা ,স্বনির্ভরতা, দারিদ্র্য বিমোচন, বিবেচনায় তিনি ‘বান্ধবী সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করে নিয়মিত সাহিত্য সভা, হস্তশিল্প, কারুকাজ, নানান ধরনের সেলাই, কুটির শিল্প, সঙ্গীত, যন্ত্র সঙ্গীত ইত্যাদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এবং বান্ধবীর মাধ্যমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচার লড়াইয়ে নারীদের উদ্বুদ্ধ, সংগঠিত ও শক্তিশালী করেন।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। শুধু তাই নয় তিনি তার সন্তানদের ভিতরেও এই আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছেন। ১৯৭৭-৭৮ সালে আমি যখন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আন্তঃকলেজ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হিসেবে মহকুমা হয়ে কুমিল্লা বোর্ডে যাই। তখন উনারি কন্যা ফারজানা শফী আমাদের প্রতিযোগিতার আর এক সঙ্গী হয়। খুব ভালো গান করেন। আমরা এক সাথে বেগম মুশতারী শফীসহ কুমিল্লায় গেলাম ট্রেনে। পৌঁছে বিচ্ছিন্ন হই। আমার সাথে বাবা গিয়েছিলেন। ১ম স্থান অর্জন করে ফিরি নজরুলগীতিতে। তখনই উপভোগ করলাম সংসারেও সংস্কৃতির সুষ্ঠু চর্চা হয়।
তিনি ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। সেই থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে তার মানুষ ও স্বদেশ প্রেমতার মধ্যে করণীয় ও সৃজনের অদম্য প্রাণতা তিনি ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি ২০২১ সালে ২০ ডিসেম্বর পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগেও ডিসি হিল এ সামপ্রদায়িক বিরোধী আন্দোলনে আলোচনা করে যান। সামপ্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যান ০৬- নভেম্বর। এই ছিল তার শেষ মঞ্চ, বলিষ্ঠ কণ্ঠ, বলিষ্ঠ আওয়াজ, বলিষ্ঠ প্রতিবাদ, বলিষ্ঠ আলোচনা, মঞ্চে দেশকে মানুষকে ভালোবাসার শেষ পদাবলী গাওয়ার যবনিকাপাত টানে। বয়স অসুস্থতা তাকে পিছু হটাতে পারে নি। সেই দিনই ছিল চট্টগ্রামের অগ্নিষ্ফুলিঙ্গ আবার মমতাময়ী মায়ের সাথে শেষ দেখা। তার কর্মজীবন আমাদের গৌরবের প্রেরণার উৎস হয়ে রইলো। প্রিয় গানের সাথী জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগীতজ্ঞ, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক