– বাবা, বাবা, কী করছো তুমি?
– দেখছো না কাজ করছি।
– বাবা আজকে ছুটির দিনেও তোমার কাজ! তাহলে বাসায় না থেকে অফিস করলেই তো পারতে।
– ছোটন বড় হও। তখন তুমিও কাজের মূল্য বুঝবে।
– বাবা আমি এখনও কাজের মূল্য যথেষ্টই বুঝি। কিন্তু তাই বলে কাজের জন্য ছুটির আনন্দ মাটি করে দিতে হবে।
– আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। আজ থেকে বাসায় বসে আর অফিসের কাজ করবো না। এখন বলো কী বলতে চাও।
– সে জন্য তোমাকে আগে চোখ বন্ধ করতে হবে।
– ছোটন, ভণিতা বন্ধ করো। কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো।
– বাবা, ভণিতা কী?
– ভণিতা মানে- না মানে এভাবে করো না। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।
– না বাবা তুমি চোখ বন্ধ না করলে সেটা বলা যাবে না।
– আচ্ছা নাও চোখ বন্ধ করলাম। এবার বলো।
– আমি না বললে একদম চোখ খুলবে না।
-আচ্ছা ঠিক আছে খুলবো না। এবার বলো।
ছোটন চুপি চুপি তার বাবার কানে হেডফোন লাগিয়ে দেয়। তারপর হাতে থাকা স্মার্টফোনে একটা অ্যাপস চালু করে। বাবা বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলেন।
– কী ছোটন? এটা কী হচ্ছে?
-আহা বাবা চোখ বন্ধ করো বলছি। আমি বললেই খুলবে।
– আচ্ছা ঠিক আছে। চোখ বন্ধ করলাম। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।
-আচ্ছা বাবা ভালো করে খেয়াল করে বলোতো এইটা কিসের শব্দ?
বাবা খুব গভীরভাবে শোনার চেষ্টা করেন।
– মনে হচ্ছে বৃষ্টির শব্দ।
-হুমম হয়েছে। আরও ভালো করে শুনে বলো।
– বললাম তো বৃষ্টির শব্দ। আর কিছু মনে হচ্ছে না।
– ভালো করে শুনো। তারপর বলো তোমার কী মনে হচ্ছে?
– বৃষ্টির শব্দই মনে হচ্ছে। আর কিছু মনে হচ্ছে না।
– আহা বাবা। ভালো করে শুনে দেখো। অনেক কিছু মনে হবে।
-নাহ বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।
-বাবা তুমি কিছুই বুঝতে পারছো না? এটা কী রকম বৃষ্টি? কোথায় হচ্ছে?
– এটাতো তুমুল বৃষ্টির শব্দ।
– কোথায় হচ্ছে?
– এটা না দেখে কীভাবে বলবো?
– বলো না দেখি। তুমি গ্রামে বড় হয়েছো না।
-হুমম হয়েছি। তার সাথে এটির সম্পর্ক কী?
– বাবা তোমার তো শুনেই বুঝে ফেলার কথা। এটি টিনের চালায় বৃষ্টির শব্দ। একটানা রিমঝিম রিমঝিম। কেমন মধুর না। বাবা অ্যাপসটার নাম না বৃষ্টি অ্যাপস। নতুন অ্যাপস। আজকেই ডাউনলোড করেছি। বৃষ্টির একটানা রিমঝিম শব্দ। খুবই মধুর। একটানা শুনলে ঘোর লাগে।
বাবা চোখ খুলে তাকান। ছোটনকে দেখেন। হেডফোন খুলে টেবিলে রাখেন। ছোটনকে বুকে টেনে নেন।
– ছোটন, বৃষ্টি তোমার খুব পছন্দ?
– অনেক, অনেক। আমি যখন বারান্দার গ্রীল থেকে বৃষ্টির শীতল পানি ছুঁই খুব ভালো লাগে।
– আর বৃষ্টির শব্দ শুনতে?
– এখানে কি বৃষ্টির শব্দ আর শোনা যায়। তাইতো আজকে অ্যাপসটা শুনে খুব ভালো লাগলো। অদ্ভুত মধুর শব্দ।
– কিন্তু বাস্তবে আরও মজার। একটানা রিমঝিম রিমঝিম শব্দে পুরো ঝিম ধরে যায়। ঘোরের মধ্যে পুরো সকাল দুপুর সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়।
– বাবা তা কি এই অ্যাপসের চেয়েও চমৎকার?
– ছোটন, তার সাথে এই অ্যাপসের কোনো তুলনাই চলে না। এই অ্যাপস তো কিছুই না। আগামী বর্ষায় তোমাকে নিয়ে আমি গ্রামে যাবো। বারান্দায় বসে সারাদিন টিনের চালায় বৃষ্টির শব্দ শুনবো। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজবো।
– মাথা খারাপ। মা কিছুতেই রাজি হবে না। ঠান্ডা লেগে আমার জ্বর হবে সেই ভয়ে।
– আরে বোকা বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয় না। বরং শরীরের সব ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়া ক্লিন হয়ে চিরতরে জ্বর ভালো হয়ে যায়।
– সত্যি নাকি?
– হুমম সত্যি। আমাদের ছোটবেলায় জ্বর, সদির্, কাশি এগুলো কখন আসতো, কখন যেতো আমরা টেরই পেতাম না।
– তাই নাকি?
– হুমম। আরও একটি মজার ব্যাপার আছে।
– কী?
– যখন শিলা বৃষ্টি হয় তখন বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে শিলা খেয়ে নিলে জীবনে কখনই টনসিল ব্যথা হয় না।
– সত্যি বলছো! তাহলে গ্রামে গিয়ে সত্যি সত্যি এসব পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
– গ্রামে আরও অনেক মজার মজার ব্যাপার আছে। তোকে গ্রামে নিয়ে আমি সবকিছু দেখাবো।
– যেমন?
– প্রথম যখন বৃষ্টি হয় তখন মাটির ভেতর থেকে অদ্ভুত এক সুঘ্রান বের হয়। পুরো মন উথাল পাথাল করা সুঘ্রান। আর শীতের সকালে ঘাসের ওপর শিশির বিন্দু। ঠিক যেন মুক্তোর দানা।
– বাবা ওরকম একটা অ্যাপসও আছে। আজকেই ডাউনলোড করেছি। নাম- ডিউ ড্রপস। চমৎকার। মোবাইলের স্ক্রীন টাচ্ করলেই টপাটপ শিশির ঝরে। একদম মুক্তোর দানা। দেখবে?
– আরে বোকা আমি অ্যাপসের কথা বলছি না। আমি শীতের ভোরের শিশিরের কথা বলছি। তুই যখন শিশির ভেজা দূর্বাঘাসের ওপর খালি পায়ে হাঁটবি তখন তোর মনও মুক্তোর মতো টলোমল করবে।
বাবা যখন ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন ঠিক তখনই আকাশের দখিন কোণে মেঘ কালো করে বৃষ্টির মহড়া শুরু হয়। বাবা ছোটনকে বলেন-
– চল বৃষ্টিতে ভিজবি?
– না। মা বকবে। বারান্দার গ্রীল থেকে একটু বৃষ্টি ছুঁতে গেলেই মা বকেন। আর ঝুম বৃষ্টিতে ভিজলে তো ঠান্ডা লাগবে। জ্বর হবে।
– দুর বোকা কিচ্ছু হবে না। বাবা সাথে আছি না।
সদর দরজা খুলে বের হতেই মা কিচেন থেকে দৌড়ে আসেন- এই কোথায় যাচ্ছো তোমরা?
– হুররে আজ আমরা বৃষ্টিতে ভিজবো। বলেই ছোটন বাবার সাথে দৌড় দেয়।
-পাগলামি নাকি। ঠান্ডা লাগবে। জ্বর হলে আমি দেখতে পারবো না। মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। লিফট টপ ফ্লোরের দিকে ছুটে চলে। ছোটন আর বাবা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়। জীবনে প্রথম একসাথে অবাধ্যতার হাসি।