বুদ্ধদেবের আকাশে হঠাৎ আলোর ঝলকানি

নাহিদ ধ্রুব | শুক্রবার , ১০ জুন, ২০২২ at ৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ

প্রবন্ধ নিয়ে ভাবতে গেলেই মনের মধ্যে একটা উচ্চমার্গীয় দৃশ্যের জন্ম হয়, এমন একটা কিছু যা গলাধঃকরণ করা যায় না সহজে। শৈশবে কিংবা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাই প্রবন্ধের ছায়া থেকে খুব সচেতনভাবেই চলেছি গা বাঁচিয়ে। এখন অবশ্য বদলে গেছে বাস্তবতা। সর্বভুক পাঠক হয়ে উঠতে উঠতে প্রবন্ধের দিকেও বেড়েছে ঝোঁক। বুদ্ধদেব বসুর ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’র মতো কোন বই পড়লে এই ঝোঁক বা আগ্রহ সঙ্গত কারণেই হয়ে যায় দ্বিগুণ।

প্রবন্ধ সম্পর্কে আমাদের যে প্রতিষ্ঠিত ধারণা, সে জায়গা থেকে এই বইটি একেবারেই ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য হওয়ার মতো কোন বিষয় এই বইয়ে নেই বললেই চলে বরং আছে এক অদ্ভুত শূন্যতার মাঝে জন্ম নেয়া ব্যক্তিগত যাপন। লেখকজীবন বলতে যে টার্ম প্রচলিত আছে, তার দেখা পাওয়া যায় এই বইয়ে, যদিও নিজেকে লেখক দাবী করতে ভয় হয় আজও, তবুও দুলকি চালে লেখা বুদ্ধদেবের এই প্রবন্ধগুলো পড়তে পড়তে পাঠক আমি মনের অজান্তে ক্রমশই মিলিয়ে ফেলি নিজের সাথে, যেন এইসব আমারই গল্প। মনোলগের সাথে স্টিম অব কনসাস্‌নেসের একটা সূক্ষ্ম প্রেমজাল তৈরি করে বুদ্ধদেব লিখেছেন এই প্রবন্ধগুলো, যা খুবই পলকা কোন পাতার উপর দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তীব্র ঝড়েও, নড়বে না একচুলও।

‘বাথরুম’ নিয়েও এতো প্রাঞ্জল প্রবন্ধ লেখা সম্ভব, এই বই না পড়লে তা হয়তো পাঠক জানতেও পারবে না। ঐতিহাসিক কোন বাথরুম হলে হয়তো বিষয়টা নিয়ে একটা উপসংহারে সহজেই আসা যায়, কিন্তু বিষয়টা আসলে তেমনও না। বুদ্ধদেবের এই বাথরুম কেবলই মানসিক ও শারীরিক অনুভূতির কথাই বলে, যা হয়তো আমাদের জানা, লুকিয়ে থাকে আমাদের উপেক্ষার মাঝে। বুদ্ধদেব প্রবন্ধ লিখেছেন, ব্যক্তিগত ডায়েরি লেখার মতো করে, ফলে পাঠকের মনে চাপ সৃষ্টি হয় না, পাঠক বুঝতে পারে, এই লেখাগুলোর আড়ালে কোন মাস্টারের চোখ নেই, তবে এ কথাও বলে রাখা ভালো, এই প্রবন্ধগুলো পড়তে পড়তে হয়তো কারও কারও সামনে খুলে যাবে নতুন চিন্তার জগত। কখনও কখনও পাঠকের মনে হতে পারে, লেখক হয়তো নিছক প্রলাপ বকছেন, কিন্তু প্রসঙ্গ যখন ‘মৃত্যু- জল্পনা’ তখন পাঠক বুঝে ফেলেন অর্ধমৃত, অবসাদগ্রস্থ মন নিয়ে আর যাই হোক, মশকরা করা যায় না, বরং পাঠক আবিষ্কার করেন জীবনের এক নতুন স্বরূপ। আফ্রিকান কোন নাম না জানা পোকাকেও তখন হয়তো পাঠকের ঈর্ষা করতে ইচ্ছে করে।

বুদ্ধদেবের বর্ণনা কাল্পনিক নয় বরং কাব্যিক। ক্লাইভ স্ট্রিটের ব্যস্ততা যেমন বাস্তবিক ঠিক তেমনই ক্লাইভ স্ট্রিটের কাব্যিক চাঁদও তাই। অতিরঞ্জিত কোন বর্ণনা কৌশল অবলম্বন করে বুদ্ধদেব কব্জির জোর একদমই দেখাতে চাননি বরং, ভাষার স্বচ্ছতা এতো বেশি, জলের মধ্যে মাছের চলাচল দেখার মতো পাঠক চাইলেই দেখে নিতে পারবেন বুদ্ধদেবের মন। আর তাই হয়তো দুর্বার জলরাশি’র মাঝে আমাদের মনে পড়ে যায় পুরনো পল্টনের কথা, আমাদের মনে পড়ে যায় সে’ই বৃষ্টিদিনের কথা, যে বৃষ্টিদিনে ফিরে যাওয়া যায় নির্ঝঞ্ঝাট সুখের খোঁজে। আমাদের ছাপোষা জীবনে যখন এস্কেপ রুট হিসেবে বেছে নিই ছাদকে, যখন আমরা তাকাই খোলা আকাশের দিকে তখন নক্ষত্রের আড়ালে যে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখে আর্দ্র হয় আমাদের মন, এই বইয়ে প্রবন্ধের আড়ালে বুদ্ধদেব মূলত এঁকেছেন, তারই রূপ ও স্বরূপ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে সাড়ে ১৩ লাখ শিশুকে খাওয়ানো হবে ক্যাপসুল
পরবর্তী নিবন্ধবুকার বিজয়ী ঔপন্যাসিক গীতাঞ্জলী শ্রী