বুকার বিজয়ী ঔপন্যাসিক গীতাঞ্জলী শ্রী

ভাষান্তর: নিজামুল ইসলাম সরফী | শুক্রবার , ১০ জুন, ২০২২ at ৭:৪০ পূর্বাহ্ণ


গীতাঞ্জলি শ্রী। মূল নাম গীতাঞ্জলি পাণ্ডে। হিন্দি-সাহিত্যের এ নামটি এ-বছর সংযুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের তালিকায়। অথচ, গীতাঞ্জলির ঝুলিতে রয়েছে মাত্র পাঁচটি উপন্যাস আর কয়েকটি ছোটগল্প গ্রন্থ। উত্তর প্রদেশের মৈনপুরার আইএএস পরিবারে জন্ম নেওয়া এ-নারী ২০১৮ সালে হিন্দিতে প্রকাশিত রেত সমাধি উপন্যাসের অনুবাদের জন্য এ-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

মার্কিন লেখক ও অনুবাদক ডেইজি রকওয়েল রেত সমাধি উপন্যাসকে হিন্দি থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। নাম দিয়েছেন টম্ব অব স্যান্ড। ২০২১ সালে লন্ডনের এক্সিস প্রেস এবং ভারতের পেঙ্গুইন বুকস ৬৯৬ পৃষ্ঠার এই অনুবাদ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। হিন্দি ভাষায় এই উপন্যাস আত্মস্থ করেই অনুবাদে নামেন তিনি। সংস্কৃত, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি, ফরাসি ভাষার শব্দ অসাধারণভাবে এ অনূদিত গ্রন্থে সংযোজন করেছেন।

টম্ব অব স্যান্ড পাঠে পাঠক মনে উদিত হতে পারে বর্ডার শব্দটির বহুল ব্যবহার, তার নানা অন্তর্নিহিত অর্থ, ব্যঞ্জনা। সীমারেখা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, লৈঙ্গিক, বয়স, ভৌগোলিক এমনকি ভাষাতাত্ত্বিক অঙ্গনেও হতে পারে; তাই এই শব্দটিও এ-উপন্যাসে শৈল্পিকবেশে অন্তর্নিহিতভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। গীতাঞ্জলি শ্রী এসব নিয়ে চমৎকার শব্দ-নৃত্য-তরঙ্গ দেখিয়ে শুধু আন্তর্জাতিক সম্মাননা নিলেন না, ভারতীয় উপমহাদেশের যে কোনো আঞ্চলিক ভাষা সাহিত্য অঙ্গনকে আরও প্রসারিত হওয়ার দ্বার খুলে দিলেন।

টম্ব অব স্যান্ড-এ যে গল্পটি গীতাঞ্জলি শুনিয়েছেন, তার মূল সুর হলো পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!…

গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ৮০ বছরের এক বৃদ্ধা। প্রেক্ষাপট দেশভাগের। ছত্রে ছত্রে কাঁটাতারের রক্তাক্ত যন্ত্রণা। স্বামী হারানোর পর ঐ বৃদ্ধা সংসার-সন্তানের আপত্তি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে যেতে চান পাকিস্তানে। দেশভাগের ক্ষতের মধ্যে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা আর একজন নারীর উপলব্ধির পরিপূর্ণতাই ফুটে উঠেছে গীতাঞ্জলির দীর্ঘ উপন্যাসে। বুনোট, নিশ্বাসের ওঠাপড়ার মতো এগিয়ে যাওয়া এই উপন্যাস সম্পর্কে বুকারের চেয়ার অফ জাজেস ফ্র্যাঙ্ক ওয়াইন বলেছেন, ক্যালাইডোস্কোপের কাচের মধ্যে দিয়ে সম্পর্ক, বয়স, নারী, পুরুষ, পরিবার এবং সর্বোপরি একটা দেশ, একটা জাতিকে দেখানো হয়েছে এই উপন্যাসে। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দেশভাগের প্রেক্ষাপটে জ্বলন্ত দলিল এটি। আর গীতাঞ্জলি শ্রী বুকার পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছেন বুকার পাব বলে কখনো কল্পনাও করিনি। পেতে পারি বলে মনেও হয়নি। এটা অসম্ভব একটা পাওনা। আমি অভিভূত, আনন্দিত, সম্মানিত এবং বিনীত। গীতাঞ্জলি শ্রীর সৌভাগ্য যে, এই প্রথম হিন্দি ভাষায় রচিত এবং ইংরেজিতে অনূদিত বইয়ের জন্য এককালের উপনিবেশিক দেশ থেকেই তাকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। হিন্দি-সাহিত্যের লেখালেখি আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে, এমন ঘটনা খুবই কম। অন্যদিকে নিম্নবর্ণের মানুষের বিশেষ করে দলিত, নারী শ্রেণির সম্পৃক্ততাও অনেকটা ফাঁকা মাঠের মতো। আবার, উল্টো দিকে এটাও সত্য যে, অনেক ভারতীয় সরাসরি উপনিবেশ ভাষা ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করে কেবল স্বদেশ-সীমানা নয়, সাহিত্যের আন্তর্জাতিক পরিসরেও সম্মানজনক স্থান নিতে সক্ষম হয়েছেন। তার মধ্যে ভি এস নইপল, অরুন্ধতী রায়, কিরণদেশাই, নীরোদ সি চৌধুরী, সলমান রুশদির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব সাহিত্য ব্যক্তিত্ব ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করার জন্য স্বদেশ, স্বভাষীদের কাছে সমালোচিত হয়েছেন, তেমনি আবার বুকার কিংবা ম্যান-বুকার পুরস্কার লাভ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি, আলোচনা, সম্মাননার অংশীদারও হয়েছেন।

গীতাঞ্জলী শ্রীর জন্ম ১৯৫৭ সালের ১২ জুন ভারতের উত্তর প্রদেশের মৈনপুরি জেলায়। তার বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। বাবার বদলি চাকরির সুবাদে ছোটবেলা কেটেছে উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। দেখেছেন মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন। খুব কাছ থেকে অবলোকন করেছেন ঘাটে ঘাটে বাঁধা জীবনের নানা বাঁকগুলো। আত্মার নিবিড়তম অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করেছেন চারপাশের মানুষগুলোর সুখ দুঃখের প্রকাশিত ও নিভৃত গল্পগুলো। শৈশব-কৈশোরের বৈচিত্র্যময় একগুচ্ছ ঘটনার অনবদ্য শিল্পায়ন তার রেত সমাধি উপন্যাস।

গীতাঞ্জলী শ্রীর মতে তখনকার সময়ে আজকালকার মতো ইংরেজি নয়, হিন্দি বই, পত্রিকা ও ম্যাগাজিন সহজলভ্য ছিল বেশি। তাই হিন্দি ভাষায় লেখা বই-ই পড়া হতো বেশি। তখন থেকে হিন্দির প্রতি অনুরাগ আর ভালোবাসার জন্ম। আর মাতৃভাষা হিন্দি হওয়াতে লেখালেখির জন্য হিন্দি ভাষার ক্ষেত্রটি ছিল সুপরিসর ও স্বাচ্ছন্দ্যের। সেখান থেকেই রেত সমাধি হিন্দিতে লেখা।

গল্পের মাধ্যমেই মূলত তার লেখালেখির সূচনা। ১৯৮৭ সালে হান্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় প্রথম ছোটগল্প বেলপত্র। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় ছোটগল্পের বই ‘অনুগুঞ্জ’। এ পর্যন্ত তার মোট পাঁচটি উপন্যাস ও বেশকিছু সংখ্যক ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজিতে অনূদিত তার লেখা ‘মাই’ উপন্যাসটি ২০০১ সালে ক্রসওয়ার্ড বুক অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিল। গীতাঞ্জলী শ্রীর লেখা ইংরেজি ছাড়াও জার্মান, ফরাসি, কোরিয়ান ও সার্বিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
বুকার প্যানেলের বিচারক ফ্রাংক ওয়েইনের মতে, বইটির চিত্রকল্প, কাহিনি ও চরিত্রাবলি খুব সহজে যেমনভাবে পাঠককে বিমোহিত করবে ঠিক তেমনি ঘটনা পরিক্রমা ও বর্ণনা নিমিষেই আবার শোক সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। দেশভাগ ও তার নীরব যন্ত্রণার অবারিত ঘটনার একটি হৃদয়গ্রাহী গল্প আত্মপোলব্ধির নিরিখে আবেগের কুশলতায় উপস্থাপিত করেছেন লেখক এ উপন্যাসে। শৈশবে উত্তর প্রদেশে থাকাকালীন সেখানকার স্থানীয় স্কুল থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করে নয়াদিল্লির লেডী শ্রীরাম কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন গীতাঞ্জলী শ্রী। তারপর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পিএইচডি করেছেন বারোদার মহারাজা সায়াজিরাও ইউনিভার্সিটি থেকে। চৌষট্টি বছর বয়সি এ-লেখক বর্তমানে দিল্লিতে বসবাস করছেন। লেখালেখিতেই নিবিষ্ট আছেন ৬৪ বছর বয়সে ও আর সাহিত্যের জন্য ত্যাগ করেছেন জীবনের যত ইচ্ছেকুঁড়ি।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

পূর্ববর্তী নিবন্ধবুদ্ধদেবের আকাশে হঠাৎ আলোর ঝলকানি
পরবর্তী নিবন্ধচুয়েট ভিসির সাথে অ্যাওয়ার্ডজয়ী এসিআই স্টুডেন্ট চ্যাপ্টারের সাক্ষাৎ