বিহঙ্গপ্রেমী নিষ্পেষিত মানুষের বন্ধু আলম

রশীদ এনাম | সোমবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

কু ঝিকঝিক কু ঝিকঝিক করে ট্রেন পটিয়া রেলস্টেশনে এসে থেমে গেল। ট্রেনের চালক পোঁ পোঁ করে দুবার হুইসেল বাজালেন যাতে কেউ লেভেলক্রসিং পারাপার না হন। ট্রেনের বাঁশি ভোরের নীরবতাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ছুটতে লাগল পাগলা ঘোড়ার মতো। অন্ধকার দূর হয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। রাজ্যের কাক জড়ো হচ্ছে। ঢাকা থেকে বাড়ি গেলে ইশকুলবেলার বন্ধুরা মিলে হনহন করে প্রাতঃভ্রমণে বের হই। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম হয়ে রেললাইন ধরে একেবারে সুচক্রদণ্ডী গ্রামে। হেমন্তের এক স্নিগ্ধ সকালে রেল স্টেশেনের এক হোটেলের পাশে নানা জাতের পাখির মেলা বসেছে। কাক, দোয়েল, শালিক, ময়না, চিঁহি পাখি। পাখির মেলা দেখে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি এক ভদ্রলোক, বন, পাউরুটি, কেক ছিঁড়ে ছিঁড়ে থালায় নিয়ে পাখিদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছেন। পাখিদের সাথে হেসে হেসে কথাও বলছেন, ‘খা মজা করে খা, তুইও খা কাওয়া।’ ঝগড়া করবি না কিন্তু ভাগাভাগি করে খা। পাখিরাও যে আনন্দের সাথে ভাগাভাগি করে খাচ্ছে। দেশে কাকের সংখ্যাটা একটু বেশি। কাক বেপরোয়া হয়ে শালিক ফিঙের দিকে তেড়ে যায় ওদের মুখের খাবার ছিনিয়ে নেয়। বেপরোয়া কাকের মতো সমাজেও কিছু বেপরোয়া মানুষ আছে যারা প্রতিনিয়ত অন্যর হক মেরে খাচ্ছে। আহা একটু আহারের জন্য কত যুদ্ধ করে দেশর বিহঙ্গপ্রজাতি এবং নিষ্পেষিত মানুষ। কাছে গিয়ে পরিচিত হলাম, গাউছিয়া হোটেলের মালিক নুরুল আলম ভাই। নামটা বেশ সুপরিচিত।

আলম ভাইকে পটিয়ার মানবিক মানুষ হিসেবে চেনেন। একসময় তিনি একবেলা আহারের জন্য জীবন সংগ্রাম করেছেন। গলায় পানের ডালা ঝুলিয়ে পান বিক্রি করেছেন। ভ্যানগাড়ি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তরকারি বিক্রি করেছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করেছেন, দোকানে চাকরি করেছেন। অনেক চড়াইউতরাইয়ের পর আজ হোটেলের মালিক। একটাই দুঃখ বাবার মুখে হাসি ফুটাতে পারেননি। বাবা দেখে যেতে পারেননি তাঁর ছেলের সফলতা। অভাবঅনটনের কারণে বাবাকে চিকিৎসা করাতে না পারায় বাবা চলে যান না ফেরার দেশে। আলম তার হোটেলে নিষ্পেষিত মানুষদের প্রতি সপ্তাহে একবেলা ফ্রি খাওয়ান ‘নিষ্পেষিত মানুষের বন্ধু আলম’। শুধু মানুষকে নয় পাখিদেরও খাওয়াতে ভালোবাসেন আলম। বিহঙ্গপ্রেমী আলম রোজ ভোরে হোটেল খোলার আগে নানা জাতের পাখিদের খাওয়ান। প্রতিদিন পাখিদের সাথে চল্লিশ মিনিট ব্যয় করেন।

আলম বলেন, সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি বিহঙ্গ প্রজাতি। যারা মানুষকে আনন্দ দেয় কখনো মানুষের ক্ষতি করে না। বন উজাড় হওয়ায়, গাছগাছালি কমে যাওয়ায় পাখিরা খাবার পায় না। অবুঝ পাখিগুলো কথা বলতে জানলে মানুষের কাছে গিয়ে খাবার খুঁজে খেতো। ভোরবেলা পাখিরা সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনা করে। আগেকার দিনে মোরগের ডাক শুনে সুবেহ সাদেকের সময় যে হয়েছে তা মানুষ বুঝতে পারত। ভোরবেলা নানাজাতের পাখিরা মধুর কণ্ঠে গান শুনিয়ে নির্মল আনন্দ দেয়। যে আনন্দ কোটি টাকা দিয়েও দামি শপিংমলে পাওয়া যাবে না। পাখির কলতানে মন পুলকিত হয়ে ওঠে। সুপ্রভাতে পাখিদের গান শোনার মজাই আলাদা। পাখিদের গান যেন মনের দাওয়াই। রোজভোরে পাখিদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আলমের ভীষণ ভালো লাগে। পাখিদের প্রতিদিন প্রায় ২০০ টাকার বনরুটি, বিস্কুট খাওয়ান। সাতসকালে আলমের গন্ধ পেলে পাখিরা তার মাথার চারদিকে গান করে উড়তে থাকে। আলমকে ঘিরে ধরে কিচিরমিচির করে আনন্দোচ্ছ্বাস প্রকাশ পাখির দল। আলম ভাই বিশ্বাস করেন কোনো প্রাণীকে খাবার খাওয়ালে খাবার কমে না বরং বাড়ে। মহান আল্লাহ রিজিক আরো বাড়িয়ে দেন। পাখিপ্রেমী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান এর পেছনের গল্প হলো, কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার ‘পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণ’ বইটি পড়ে তিনি পাখিপ্রেমী হয়ে ওঠেন। বাজারে কেউ অতিথি পাখি কিংবা বন থেকে পাখি এনে বিক্রি করতে দেখলে আলম পাখিগুলো কিনে নিয়ে আকাশে ছেড়ে দেন। পাখি শিকারিদেরকে পাখি না ধরার জন্য উপদেশ দেন। ওদের বুঝান পাখিরা যদি কথা বলতে জানত তাহলে পাখি শিকারিদের বিরুদ্ধে থানায় শত শত মামলা হতো।

পাখি মানুষের প্রকৃত বন্ধু যারা বিনা পয়সায় মানুষকে বিনোদন দেয়। আহমেদ ছফা লিখেছিলেন ‘কাক একটু কর্কশ বটে কিন্তু কান খাড়া করে শুনলে তার ভিতর একটা চিকন রেশ পাওয়া যাবে। কেন যে পাখিটিকে নোংরা পাখি বলে আমি তো তার কারণ খুঁজে পাইনি। কাক চেষ্টায় বক ধ্যানং কাকের মতো চেষ্টা করতে হবে, বকের মতো ধ্যান করতে হবে। স্বল্পহার, স্বল্প নিদ্রা এবং গৃহত্যাগ বিদ্যার্থীর পাঁচটি লক্ষণ।’ লেখক বুলবুলি পাখির সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।

বুলবুলি পাখি যে খাবারে ঠোকর দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যে গানের স্বর ঝরে পড়ে সেটাকে তিনি পাহাড়ি ঝরনা বয়ে যে পাথরের ঘষা লেগে যে নরম ভেজা শব্দের সৃষ্টি হয় তার সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহর সৃষ্ট সকল জীবের প্রতি ভালোবাসা দেখানো উচিত। যারা আল্লাহর সৃষ্টি বিহঙ্গকে ভালোবাসে তারা আল্লাহকে ভালোবাসে। আল্লাহও সে সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করেন যারা তাঁর সৃষ্ট জীবের প্রতি দয়া দেখান। কথাগুলো বলতে বলতে আলমের থালার খাবার শেষ হয়ে গেল পাখিরাও আনন্দে কিচিরমিচির করে মুক্ত আকাশে ডানা মেলতে লাগল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধনেগেটিভ রিলের স্মৃতি, ডিজিটাল ক্লিকের দাপট